অস্ট্রেলিয়ার পাহাড়ে গিয়ে ব্লু-বেরি চুরি

অস্ট্রেলিয়ায় এখন পুরোদস্তুর গ্রীষ্ম। সাথে ক্রিস্টমাসের লম্বা ছুটি। সব মিলিয়ে পুরো অস্ট্রেলিয়া এখন উৎসবমুখর। আমার স্ত্রী নোভা আসাতে আমার জন্যও এই ছুটিটা আরও বর্ণিল।

শুভংকর বিশ্বাস,অস্ট্রেলিয়া থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 Jan 2017, 11:57 AM
Updated : 4 Jan 2017, 12:20 PM

গত ফেব্রুয়ারিতে পিএইডি শেষ করেও কাজের ব্যস্ততায় আর ছুটিজনিত জটিলতায় সেলিব্রেশন করা হয়ে ওঠেনি। তাই ব্যস্ততার ফাঁকে উঁকি দিয়ে অবকাশ যাপনের জন্য এক টুকরো অখণ্ড অবসর খুঁজছিলাম।

অবশেষে নোভাকে নিয়ে এই ছুটিতে বেরিয়ে পড়লাম। উদ্দেশ্য নিউ সাউথ ওয়েলসের মগুড অঞ্চলের গভীর পাহাড়ি জঙ্গলের পাদদেশে অবস্থিত ব্লু-বেরি পিকিং।

ছবি: ক্যারাভ্যানের ভেতরের দিক

অস্ট্রেলিয়ায় পাহাড় আর সমুদ্র মিলেমিশে একাকার। সমুদ্র আমাকে খুব একটা কাছে না টানলেও পাহাড়ের প্রতি আমার আকর্ষণ প্রবল। এই আকর্ষণের কারণেই আমার বাসা নিউ ক্যাসল থেকে প্রায় ৪৫০ কিলোমিটার দূরে, পাহাড়ের পাদদেশে 'বাইটম্যান্স বে' নামক ছোট্ট একটা শহরের এক নির্জন এলাকা ভ্রমণের জন্য বেছে নিয়েছিলাম।

একটা ক্যারাভ্যানও ভাড়া করে ফেললাম ব্লু-বেরি গার্ডেনে যাওয়ার আগে মধ্যবর্তী ক্যাম্প হিসেবে। এই ক্যারাভ্যানে থাকাটাও একটা মজার অভিজ্ঞতা। ক্যারাভ্যান হচ্ছে এক শয়নকক্ষ বিশিষ্ট চাকাওয়ালা বাড়ি, যেটিকে কোন সুবিধাজনক স্থানে পার্ক করে দিনের পর দিন থাকা যায়।

ছবি: ফিজরয় জলপ্রপাত

খুব সকালে ঘুম থেকে উঠেই রেডি হয়ে আমার টু-হুইল গাড়িতে গিয়ে বসি। মোবাইলে আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেখে তো চক্ষু চড়ক গাছ! বৃষ্টি! বেরি ক্ষেত অর্থাৎ বাইটম্যান্স বে এলাকায় ৭০ ভাগ বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা আজকে। কালও বৃষ্টি।

অস্ট্রেলিয়ার আবহাওয়ার পূর্বাভাস মোটামুটি নির্ভূল। সুতরাং যাই করি, বৃষ্টির সম্ভাবনাকে মাথায় রেখে করতে হবে। যেহেতু আগে থেকেই ক্যারাভ্যান ভাড়া করা ছিল,আর ২৪ ঘণ্টার নিচে চেক-ইনের সময় হওয়ায় বুকিং বাতিলের সুযোগও নাই, অগত্যা রওনা দিলাম।

জিপিএসে 'বাইটম্যান্স বে' যাওয়ার দু'টি বিকল্প পথ দেখায়। একটা সমুদ্রের কোল ঘেঁষে প্রিন্সেস হাইওয়ে দিয়ে,আরেকটি হিউম হাইওয়ে হয়ে পাহাড়ের মধ্য দিয়ে। উভয় পথেই গন্তব্যে পৌঁছানোর দূরত্ব মোটামুটি একইরকম। যথারীতি পাহাড়ি রাস্তার চ্যালেঞ্জটিকেই বেছে নিলাম।

ছবি: ব্লু-বেরি গার্ডেনে যেতে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ

সাথে নোভা থাকায় ভেবেছিলাম যাত্রাপথটা অন্তত আগের মত বিরক্তিকর হবে না। সেটা আর হল কই! গিন্নি মাত্র বাংলাদেশ থেকে আসায়, আর বাংলাদেশ থেকে অস্ট্রেলিয়ার সময় পাঁচ ঘণ্টা আগে হওয়ায় ওনার 'জেট লাগ' (বিমান ভ্রমণজনিত অবসাদ) এখনও কাটেনি।

টেনেটুনে আমার সাথে সিডনি পর্যন্ত প্রায় ঘণ্টা দেড়েক সঙ্গ দিয়ে ঘুম বাবাজির কাছে শেষ পর্যন্ত হেরেই গেলেন!ভেবেছিলাম সিডনির ভেতর কোন এক রেস্তোরাঁয় আমরা নাস্তাটা সেরে নেব।কী আর করা, বেচারির কাঁচা ঘুমটা নষ্ট না করে ছুটে চললাম গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।

আরও প্রায় ঘণ্টা দেড়েক হিউম হাইওয়ে দিয়ে ড্রাইভ করার পর আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তায় উঠতেই ঝাঁকুনিতে নোভার ঘুম ভেঙ্গে গেল। পাহাড়ি রাস্তার শুরুতে কয়েকটি জলপাই বাগান দেখতে পেলাম। জায়গাটা এত সুন্দর ছিল যে গাড়ি থামিয়ে ছবি তোলার লোভ সামলাতে পারছিলাম না। কিন্তু রাস্তাটা এত সরু ছিল যে গাড়ি পার্ক করার কোন সুযোগও ছিল না। কি আর করা! অগত্যা গাড়ি নিয়ে ছুটে চললাম গহীন পাহাড়ের দিকে।

এতক্ষণে আমরা ক্ষুধায় চৌচির। ভ্রমণ পথে আমার শুকনো খাবার রাখা খুব একটা পছন্দের না, যেখানে অস্ট্রেলিয়ার সব হাইওয়েতে নিয়মিত দূরত্বে কেএফসি, ম্যাকডোনাল্ডসের মত চেইন ফাস্টফুড শপগুলি জালের মত বিস্তৃত। কিন্তু আমরা চলেছি পাহাড়ি পথে, সেখানে মানুষ বা গাড়ির আনাগোনা তুলনামূলকভাবে কম, তাই চোখে পড়ার মত কোন দোকানও নাই।

ছবি: ব্লু-বেরি গার্ডেনে যেতে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ

আরও কিছুদূর যেতে 'ইয়ারুঙ্গা ভ্যালি' নামক স্থানে আসলে রাস্তার পাশে একটি ছোট ক্যাফে দেখে সেখানে দাঁড়াই। তখনও বুঝতে পারিনি প্রকৃতি আমাদের জন্য কি সাজিয়ে রেখেছে! ক্যাফের এক প্রান্তে প্রসাধন কক্ষে যাওয়ার সময় ছোট্ট একটা তীরচিহ্ন দিয়ে লেখা 'ফিজরয় ওয়াটার ফল- ১৫০ মিটার'।

কৌতুহল মেটাতে সেখানে গিয়ে তো চক্ষু ছানাবড়া! সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় সাতশ' মিটার উঁচু থেকে জলপ্রপাত এক নয়নাভিরাম দৃশ্যের সৃষ্টি করেছে! প্রকৃতি বোধহয় দুর্গম এলাকায় তার রূপের সমস্ত পসরা বসিয়ে রাখে!

যাহোক, ভ্রমণ পথে বোনাস হিসেবে পাওয়া ফিজরয় জলপ্রপাত কিছুক্ষণ দেখে রওনা দিলাম আজকের জন্য আমাদের মূল গন্তব্য 'বাইটম্যান্স বে'- এর দিকে। ভয়ংকর সব পাহাড়ি রাস্তার বাঁক (যেখানকার সর্বোচ্চ গতিসীমা ঘণ্টায় মাত্র ১৫ কিলোমিটার) পেরিয়ে সন্ধ্যার একটু আগে অবশেষে রাত্রিযাপনের জন্য আমাদের ক্যাম্প হিসেবে ভাড়া করা ক্যারাভ্যানে এসে উঠলাম।

ছবি: ব্লু-বেরি বাগান

আগের দিন রাতে নিউ ক্যাসেলে আমাদের বাসায় এসি ছেড়ে ঘুমালেও আজ ক্যারাভ্যানে রুম হিটার চালিয়ে ঘুমাতে হলো। এটাই হল অস্ট্রেলিয়ার আবহাওয়ার বৈশিষ্ট্য।

পরদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে রওনা দিলাম আমাদের ক্যাম্প থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার পাহাড়ি জঙ্গলের ভেতরে অবস্থিত একটি পাহাড়ের পাশে 'ক্লেইড' নদীর পাশ ঘেঁষে চাষ করা ব্লু-বেরি গার্ডেনের দিকে।

যাওয়ার রাস্তাটা এতই অমসৃণ ও পাথুরে নুড়িময় ছিল যে একটু এদিক-সেদিক হলে প্রায় এক কিলোমিটার নিচে সোজা পাহাড়ি খাদে! কিছু কিছু জায়গায় অবস্থাটা এমন ছিল যে, আমার স্ত্রী রীতিমত ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা শুরু করে দিয়েছিল।

যাহোক, এভাবে ছোট ছোট আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে বেরি গার্ডেনের সাইন অনুসরণ করে এক সময় পৌঁছালাম আমাদের আকাঙ্খিত 'ক্লেইড রিভার বেরি ফার্মে'।

ছবি: ব্লু-বেরি তুলছেন লেখক

ব্লু-বেরি একটি মৌসুমী ফল, যেটি অস্ট্রেলিয়াতে সাধারণত ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে পাওয়া যায়। যদিও সুপার মার্কেটগুলিতে প্রায় সারা বছরই পাওয়া যায়, তবে তা গ্রিনহাউজে উৎপাদিত।

যাহোক, বেরি গার্ডেনে ঢোকার সময় কর্তৃপক্ষ আমাদের দু'জনের কাছে দুটি প্লাস্টিকের বালতি ধরিয়ে দিয়ে বেরি ক্ষেতের নিয়মাবলী বলে দিল। নিয়ম হচ্ছে, আমরা যতটুকু ব্লু-বেরি তুলব, তা পরে ওজন করে দাম মেটাতে হবে (অবশ্য দাম প্রায় খুচরা বাজারের এক-তৃতীয়াংশ)।

আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম ছিল। ব্লু-বেরি তোলা যাবে বটে, কিন্তু তোলার সময় একটিও খাওয়া যাবে না। যতক্ষণ না ওজন করে কড়ায়-গণ্ডায় দাম মেটানো হয়!

নিয়মটা আমার জন্য অত্যন্ত কঠিন ছিল, কারণ জীবদ্দশায় আমি এত বড় সংযম কোনদিনই করিনি। আমার শৈশবই কেটেছে অন্যের গাছের নারকেল, আম ইত্যাদি চুরি করে! বলতে দ্বিধা নেই- ব্লু-বেরি তোলার সময়ও সে সংযম দেখাতে পারিনি।

লেখক: গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব নিউ ক্যাসেল, অস্ট্রেলিয়া