অটোয়া কানাডার রাজধানী হলেও এটি কানাডার প্রধান শহর নয়। কানাডা দেশটি এতো বড় যে চাইলে হুট করে অন্য শহরে যাওয়া হয়ে ওঠে না।
Published : 14 Nov 2016, 04:41 PM
দীর্ঘ পথ ড্রাইভিং করে, বাসে-ট্রেনে অথবা বিমানে গেলেও প্রস্তুতি নিয়ে যেতে হয়।
আমি থাকি মন্ট্রিয়লে, কানাডার ক্যুবেক প্রদেশের অন্যতম বাণিজ্যিক শহর। অটোয়ায় গিয়েছিলাম কবি মেসবা আলম অর্ঘ্যের সাথে দেখা করতে। তার বাসায় গিয়ে উঠলাম। সে একা থাকে, আমি মিলে দুইদিনের জন্য দোকা।
সেইরকম কেউ না থাকলে 'এয়ারবিনবি' কিংবা কোনও হোটেলে ওঠা হয়। 'এয়ারবিনবি' হচ্ছে একটি অ্যাপ ও অনলাইন সেবা, আপনার পুরো বাড়ি কিংবা কোন খালি কামরা অন্যের সাথে শেয়ার করতে কিংবা কয়েকদিনের জন্য ভাড়া দিতে পারবেন। ফলে নিজের বাড়তি আয় হলো এবং অতিথিরও স্বাচ্ছন্দ্যে থাকা হলো।
অটোয়ায় এর আগে গিয়েছিলাম ২০০৮ সালে। তখন চাচাত বোন ও তার পরিবার সেখানে থাকতো। তখন কানাডার সংসদ ভবন ও আশপাশের এলাকা এইসব ঘুরেছিলাম, যদিও সেইসব স্মৃতি এখন ঝাপসা।
অটোয়াকে কেন যেন আমার এক বিধবা নারীর মতন মনে হয়। তার ভেতর রহস্য আছে, সৌন্দর্য আছে, বিষণ্নতায় ভরপুর। অথচ চারদিকে শীতের কুয়াশার ভেতরে রাখা শীতল হাতের মত নিস্তব্ধতা আর অভিযোগহীনতায় ঘেরা।
একটি দেশের রাজধানী শহর বলতে যে অগণন মানুষের সমাবেশ, পিঁপড়ে আর উঁইঢিবির মতো যত্রতত্র গড়ে ওঠা অট্টালিকা আর যানজটের আশঙ্কা থাকে- অটোয়ায় সেইসব নেই।
আছে রোববারের বিকালে হঠাৎ কী মনে করে আকাশের দিকে তাকিয়ে অনেকক্ষণ দৃষ্টি না ফেরানোর আনন্দ। আছে মায়ের হাতের রান্নার নিপুণতার মতো সুপরিকল্পিত নগরায়নের ছোঁয়া, আর গোপন প্রেমিকার মতো পাব, রেঁস্তোরা, মদের দোকানে দুপুরের বন্দরের কাজ একটু কমে যাওয়ার মতো ঢিলেঢালা ভাব।
মন্ট্রিয়ল থেকে অটোয়া ঘণ্টা আড়াইয়ের পথ। গাড়ি জোরে চালালে হয়তো দুই ঘণ্টার। তবে অন্টারিও প্রদেশে প্রতি ঘণ্টায় ১২০ কি.মি. এর উপরে গাড়ি চালালে হাইওয়ে পুলিশ জরিমানা করে ৯৫ ডলার, ঘণ্টায় ১৪০ কি.মি. চালালে ২৯৫ ডলার।
আমি সাধারণ স্পিড লিমিটের ১০-১৫ কিমি/ঘন্টা বেশি জোরে চালাই। তাছাড়া তখন ডিসেম্বরের তুষারপাত পুরোদমে শুরু না হলেও রাস্তা হালকা পিচ্ছিল। রাতভর টুকটাক মিহি তুষার পড়ে কিংবা কুয়াশা পড়ে তার কারণে।
বিকাল সাড়ে চারটার দিকে পথে নামলাম। ডিসেম্বরের চারটা পাঁচটা মানে চারদিকে সড়কবাতির আলো আর দূরের জনপদের বিচ্ছুরিত আলো ছাড়া পুরো পথ অন্ধকার। তাই চালানো ১০৫-১১০ কি.মি. বেগে ঘণ্টায়।
অটোয়ার অন্যান্য সংস্কৃতিমনা বাঙালিদের অনুষ্ঠান, আড্ডা, গলাবাজি, গানে রাত এগারটা বাজে আমরা যখন ফিরে এলাম তখনও সেই অনুষ্ঠান চলছিলো।
অর্ঘ্য তার বই থেকে কবিতা পড়ে শোনালো। কথায় অকথায় আর গান শুনে মধ্যরাত পর্যন্ত চললো আমাদের প্রথমদিনের আড্ডা। ঠিক হলো কাল শহর দেখতে যাবো।
সন্ধ্যার দিকে এসে অর্ঘ্য আবার গান আর কবিতা নিয়ে বসলো। এবার বিনয়ের কবিতা। বিনয় মজুমদার। অর্ঘ্য বিনয় পাঠ করতে থাকে। অর্ঘ্যের গলা ভালো।
"এতই সহজ, তবু বেদনায় নিজ হাতে রাখি
মৃত্যুর প্রস্তর, যাতে কাউকে না ভালোবেসে ফেলি।''
(ভালোবাসা দিতে পারি/ বিনয় মজুমদার)
অর্ঘ্য কবিতাসক্ত মানুষের মতো একেক করে বিনয়ের কবিতা পড়তে থাকে। আমি শুনি, কবিতা আবৃতি করার মেধা ও কৌশল আমার নেই। কবিতার আবৃতি অনেক সময় কবিতার উপলব্ধিকে পাল্টে দেয়।
অনেক সময় গোত্তা খাওয়া ঘুড়ির মতো কবিতাকে অপমানও করে দেয়, তাই কবিতার আবৃতি বিপদজনক। তবে অর্ঘ্যের পাঠ শুনে মনে হয় সে এইসব কবিতা অসংখ্যবার পাঠে করেছে, হয়তো নিজের জন্যই। নিজের জন্য কবিতা পাঠই শ্রেষ্ঠ পাঠ, অর্ঘ্যের মকশো করা আছে।
আমরা টের পাই উপস্থিতি, পরিস্থিতি ও সময় পাল্টালেও আমাদের চিন্তা মূলত এইসব ঘেষে। মানুষের মস্তিষ্ক বিবর্তনে গড়া, এতো সহজে পাল্টায় কী করে।
লেখক: আশরাফ মাহমুদ। মনোবিজ্ঞানী, কবি ও লেখক।
ছবি: আশরাফ মাহমুদ
ইমেইল: [email protected]