টানা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারা এবারের সম্মেলনকে ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে আসছিলেন।
তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে শনিবার রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্মেলনের উদ্বোধন অনুষ্ঠানটিও ছিল বেশ জাঁকালো।
নৌকা আকৃতির বিশাল একটি মঞ্চে দাঁড়িয়ে বেলুন ও পায়রা উড়িয়ে দুদিনের সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন দলীয় সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বক্তৃতা পর্বের পর বিকালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই শুরু হয় কাউন্সিল অধিবেশন। সন্ধ্যা পর্যন্ত চলার পর তা মুলতবি করা হয়।
রোববার সকালে পাশের ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে রুদ্ধদ্বার কাউন্সিল অধিবেশন হবে। সেখানেই দলের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা ও নতুন নেতৃত্ব গঠিত হবে।
২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে সমৃদ্ধ দেশের কাতারে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন পূরণে ‘সহায়ক নেতৃত্ব’ বের করে আনার পরিকল্পনা নিয়ে ২০তম সম্মেলন শুরু করল স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়া দলটি।
তাদের সম্মেলনের স্লোগানও এই রকম- ‘শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উন্নয়নের মহাসড়কে এগিয়ে চলেছি দুর্বার, এখন সময় বাংলাদেশের মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার’।
সম্মেলনের উদ্বোধনী বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দলের নেতা-কর্মীদের সক্রিয়তা প্রত্যাশা করেন।
ক্ষমতাসীন দলের এই সম্মেলন ঘিরে গত কয়েক দিন ধরেই রাজধানীতে ছিল সাজ সাজ রব। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের আশপাশে নিরাপত্তা জোরদারের পাশাপাশি উদ্যান ঘিরেন সড়কে গাড়ি চলাচলও নিয়ন্ত্রণ করে পুলিশ।
শেখ হাসিনা সম্মেলনস্থলে আসেন ১০টা ০৫ মিনিটে। নৌকা আকৃতির মঞ্চে উঠে হাত নেড়ে যখন তিনি শুভেচ্ছা জানালেন, তখন পুরো সমাবেশস্থল গম গম করে ওঠে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানে।
এসময় দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম তার পাশে ছিলেন। হাত নাড়তে মঞ্চের একপাশ থেকে অন্যপাশে যাওয়ার সময় দলীয় প্রধানের সঙ্গে ওবায়দুল কাদেরকেও দেখা যায়; যিনি সাধারণ সম্পাদক হতে যাচ্ছেন বলে গুঞ্জন উঠেছে।
প্রধানমন্ত্রী উপস্থিতদের শুভেচ্ছা জানিয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন; দলীয় পতাকা তোলেন সৈয়দ আশরাফ। এসময় বাজছিল জাতীয় সঙ্গীত। সাংগঠনিক জেলাগুলোর সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকরা দলীয় পতকা উত্তোলন করেন।
সভামঞ্চ থেকে বেলুন ও পায়রা উড়িয়ে ১০টা ১২ মিনিটে সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ঘোষণা করেন শেখ হাসিনা। এরপর মঞ্চের মাঝখানে বসেন তিনি।
মঞ্চে সামনের সারিতে বসেন আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, ওবায়দুল কাদের, মতিয়া চৌধুরী, সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, মোহাম্মদ নাসিম, কাজী জাফর উল্যাহ, নূহ উল আলম লেনিন, সতীশ চন্দ্র সাহা ও সাহারা খাতুন।
উদ্বোধন ঘোষণার পর ‘আলোর অগ্নিযাত্রা’ শীর্ষক সঙ্গীত ও নৃত্যের সাংস্কৃতিক পরিবেশনার সঙ্গে দলীয় সঙ্গীত, নজরুল সঙ্গীত, লালন গীতি, রবীন্দ্র সঙ্গীত এবং তিনটি দেশাত্ববোধক গান গেয়ে শোনানো হয়।
ধর্ম গ্রন্থ থেকে পাঠের পর শোক প্রস্তাব উত্থাপন করেন দপ্তর সম্পাদক আব্দুল মান্নান খান। এরপর প্রয়াতদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
সম্মেলন অভ্যর্থনা উপ-কমিটির আহ্বায়ক মোহাম্মদ নাসিমের বক্তব্যের পর সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ বক্তব্য রাখেন। তারপর বক্তব্য দেন বিদেশি রাজনৈতিক দলগুলোর আমন্ত্রিত নেতারা। তাদের বক্তব্য শেষে সভাপতির ভাষণ রাখেন শেখ হাসিনা।
সম্মেলন উদ্বোধন সকাল ১০টায় হলেও সকাল থেকে নেতা-কর্মীরা লাইন ধরেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঢুকতে। একের পর এক মিছিল আসছিল। উদ্যানে ঢোকার ফটকগুলোতে শুরু হয় দীর্ঘ লাইন।
শেখ হাসিনা মঞ্চে উঠার আগেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ‘শিখা চিরন্তন’ থেকে চার নেতার মাজার এলাকা পর্যন্ত এলাকা কানায় কানায় ভরে যায়।
উদ্যানে জেলাভিত্তিক নেতাকর্মীদের খণ্ডখণ্ডভাবে জটলা করে সম্মেলনের বিষয়বস্তু ও দলের প্রতি নিজেদের আনুগত্যের কথা বলতে শোনা যায়।
লালমনিরহাট থেকে আসা আরমান আলী নামের এক কাউন্সিলর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রথম সম্মেলনে এসেছি, খুব ভালো লাগছে। আওয়ামী লীগ করাটা সার্থক মনে হচ্ছে।”
বরিশাল থেকে আসা শ্যামল ঘোষ বলেন, “আওয়ামী লীগের সম্মেলন এত সুন্দর পরিবেশে হয়, এটা আমার জানা ছিল না।”
দেশের অন্যতম প্রাচীন ও বড় দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার কারণে তারা সম্মেলনে কী সিদ্ধান্ত নেয় এবং তা বাস্তবায়নের ভার কাদের উপর দেয়, সেদিকে দৃষ্টি এখন সারা দেশবাসীর।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দলকে গত ৩৫ বছর ধরে নেতৃত্ব দিয়ে আসা তার কন্যা শেখ হাসিনা সম্প্রতি বলেছেন, অবসরে যাওয়ার সুযোগ পেলে তিনি ‘খুশি’ হবেন। তবে দলীয় নেতারা বলে আসছেন, আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে শেখ হাসিনার বিকল্প নেই।
সম্মেলনের আগে নেতাকর্মীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচনা চলছে সাধারণ সম্পাদক পদ নিয়ে। সভাপতির পর সাংগঠনিক দিক দিয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই পদে গত দুইবারের সম্পাদক সৈয়দ আশরাফই থাকছেন, না নতুন কোনো মুখ দেখা যাবে- সে প্রশ্ন ঘুরছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতেও।
ছয় হাজার ৫৭০ জন কাউন্সিলর এবং সম সংখ্যক পর্যবেক্ষকের কাউন্সিল অধিবেশনের পর অবসান ঘটবে তা জানার অপেক্ষার।
কাউন্সিলে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনের জন্য দলের উপদেষ্টা পরিষদের তিন সদস্যদের সমন্বয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে। মসিউর রহমানের সভাপতিত্বে অন্য দুই সদস্য হলেন ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন ও রাশেদুল আলম।
আওয়ামী লীগের ১৯তম জাতীয় সম্মেলন হয়েছিল ২০১২ সালের ২৯ ডিসেম্বর। গতবছর ডিসেম্বরে সেই কমিটির মেয়াদপূর্তির পর মার্চ ও জুলাইয়ে দুই দফা পিছিয়ে এবারের সম্মেলন হচ্ছে।
নতুন নেতৃত্বের স্থান সঙ্কুলানে এবারের সম্মেলনে গঠনতন্ত্র সংশোধন করে কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের আকার বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে আওয়ামী লীগ। এ বিষয়ে গঠনতন্ত্র উপ-কমিটির প্রস্তাব গত ১৯ অক্টোবর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের সম্মতিও পেয়েছে। এখন কাউন্সিলে তা চূড়ান্ত অনুমোদনের কথা।
# ৭৩ সদস্যের কার্যনির্বাহী সংসদের আকার বেড়ে হবে ৮১ সদস্যের
# এর মধ্যে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যের সংখ্যা বাড়বে ৪ জন
# কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্যের সংখ্যা বাড়বে ২ জন
# যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদক বাড়বে একজন করে
আওয়ামী লীগের অঙ্গীকারের অনুচ্ছেদেও কিছু পরিবর্তন আনা হচ্ছে। ‘ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ ও সকল প্রকার সাম্প্রদায়িকতার বিলোপ সাধন’ এর জায়গায় সাম্প্রদায়িকতার পাশে যুক্ত হবে ‘মৌলবাদ’ শব্দটি।
আর ‘আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ: সন্ত্রাস ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠন’ লাইনে
সন্ত্রাসের আগে ‘জঙ্গিবাদ’ শব্দটি বসবে।
ইউনিয়ন কাউন্সিল পর্যন্ত জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী মনোনয়নে ‘স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধি মনোনয়ন বোর্ড’ গঠন করা হবে।
জেলা, মহানগর ওয়ার্ড, থানা, পৌর এবং ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের কমিটির সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়েও গঠনতন্ত্র উপ-পরিষদ একটি প্রস্তাব দিয়েছে। সেই সঙ্গে জাতীয় কমিটির সদস্য সংখ্যা ১০ জন বাড়িয়ে ১৮০ জন করার প্রস্তাব রয়েছে।
জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে কেউ দলীয় সিদ্ধান্ত ভেঙে প্রার্থী হলে সরাসরি দল থেকে বহিষ্কার করার কথা বলা হয়েছে একটি প্রস্তাবে।