সোমবার মেঘালয়ের শিলংয়ে একটি সভায় বক্তব্য দিতে দিতেই অসুস্থ হয়ে মারা যান দেশবাসীর কাছে ‘মিসাইলম্যান’ নামে পরিচিত কালাম, যিনি ভারতের প্রথম মহাকাশ যান এসএলভি-৩ তৈরিতে প্রধান ভূমিকা রেখেছিলেন। ওই মহাকাশ যান দিয়েই ১৯৮০ সালে ভারত প্রথম ক্ষেপণাস্ত্র রোহিনী উৎক্ষেপণ করে।
খ্যাতিমান এই বিজ্ঞানীর মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টার মাথায় তাকে নিয়ে ফেইসবুকে একটি পোস্ট দেন সৃজন পাল, যিনি কালামের সঙ্গে যৌথভাবে ‘টার্গেট ৩ মিলিয়ন’ বইটি লিখেছিলেন।
কাজ করতে করতে মৃত্যুকে কালাম ‘আশির্বাদ’ হিসেবে দেখতেন বলে জানিয়েছেন তিনি।
সৃজন পাল লিখেছেন, “প্রায়ই তিনি (কালাম) আমাকে জিজ্ঞেস করতেন, ‘তুমি যুবক, সিদ্ধান্ত নাও, কীভাবে তুমি নিজেকে স্মরণীয় রাখতে চাও?’ আমি নতুন নতুন আকর্ষণীয় জবাবের কথা ভাবতাম।
“অবশেষে একদিন আমিই তাকে পাল্টা প্রশ্ন করলাম, ‘প্রথমে আপনি আমাকে বলুন, আপনি কীভাবে আপনাকে স্মরণীয় করতে চান? রাষ্ট্রপতি, বিজ্ঞানী, লেখক, মিসাইলম্যান, ইন্ডিয়া ২০২০, টার্গেট থ্রি মিলিয়ন.... (শেষ দুটি কালামের দুটি বই) কোনটা?
“আমি ভাবলাম, অপশন রেখে আমি প্রশ্নটি তার জন্য সহজ করে দিয়েছি। কিন্তু তিনি আমাকে বিস্মিত করে জবাব দিলেন, ‘শিক্ষক’।”
“এরপর একটু থেমে তিনি বলেন, বড়দেরও দুটি বিষয় মাথায় রাখা উচিত। ‘কখনও মৃত্যুশয্যায় সম্পদ রেখে যেও না- যা তোমার পরিবারকে সংঘাতময় করে তোলে’। দ্বিতীয়ত- সেই ব্যক্তিই আশির্বাদপ্রাপ্ত যিনি কাজ করতে করতে মৃত্যুবরণ করেন, দীর্ঘ রোগভোগ ছাড়াই বিদায় নেন। বিদায়টা সংক্ষিপ্তই হওয়া উচিত, সত্যি সংক্ষিপ্ত।”
এ পি জে কালামের মৃত্যুর সময়ও তার পাশে থাকা সৃজন পাল লিখেছেন, “যে কাজ দিয়ে তিনি স্মরণীয় হতে চাইতেন, শিখিয়ে যাওয়া, তা করতে করতেই তিনি চিরবিদায় নিলেন। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি দাঁড়িয়েছিলেন, কাজ করছিলেন এবং বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। একজন মহান শিক্ষক হিসাবে, কাজ করতে করতে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন।
“তিনি তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে কিছু জমা না করেই পৃথিবী ছেড়ে গেলেন, তবে পেয়ে গেলেন মানুষের ভালোবাসা ও শুভকামনা।”
এ পি জে কালামের ঘটনাবহুল জীবনের সমাপ্তির দিকে ইঙ্গিত করে সৃজন পাল বলেছেন, “শেষ মুহুর্তেও তিনি একজন সফল ব্যক্তিই ছিলেন।”
অগণিত মানুষকে স্বপ্ন দেখতে উৎসাহ যুগিয়ে যাওয়া কালামের বিদায়ে তার শেষ জীবনের এই সহচর বলেন, “আমি আপনার সঙ্গে সব লাঞ্চ, ডিনার মিস করব। মানবতাবোধ দিয়ে চমকে দেওয়ার, জানার আগ্রহ দিয়ে বিহ্বল করে দেওয়ার সময়গুলোও মিস করব। কাজ ও কথায় যে সব শিক্ষা দিয়ে গেছেন, সেগুলোও মিস করব।
“ফ্লাইটে থিতু হওয়ার সংগ্রাম আর ট্রিপ এবং দীর্ঘ বিতর্কগুলো মিস করব। আপনি আমাকে স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছেন, আপনি আমাকে বুঝিয়েছেন- স্বপ্ন এমন হতে হবে, যা অর্জন করা সম্ভব নয় বলে মনে হবে। অন্য কিছু হলে সেটা হবে সামর্থ্যের সঙ্গে আপোস। তিনি চলে গেছেন, তবে মিশন রয়ে গেছে। দীর্ঘজীবী হোন, কালাম।”
ওই সময়ের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, “বহরের প্রথম খোলা জিপে তিনজন সৈন্য ছিলেন, যাদের দুজন দুইপাশে বসেছিলেন, অপরজন ছিলেন দাঁড়িয়ে। চলার সময় বারবার ওই সৈনিককে বসতে বলতে আমাকে তাগাদা দেন তিনি (কালাম)।
“গন্তব্যে পৌঁছানোর পর উনি সেই সৈনিককে ডেকে এনে বলেন, তুমি কি ক্লান্ত, তুমি কি কিছু খেতে চাও? আমার কারণে তোমাকে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে বলে আমি দুঃখিত।”
৮৪ বছর বয়সে পৃথিবী ছেড়ে যাওয়া বিজ্ঞানী এ পি জে আব্দুল কালাম বলতে ও শোনাতেই বেশি স্বচ্ছন্দ ছিলেন। গত দুই দশকে এক কোটি ৮০ লাখ তরুণের সঙ্গে মতবিনিময়ের কথা গত বছর ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে জানিয়ে গিয়েছিলেন তিনি।
বিষয়টি উঠে এসেছে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর শোক বার্তায়ও। এক টুইটে তিনি লিখেছেন, “ড. কালাম মানুষের সঙ্গ উপভোগ করতেন.... তিনি ছাত্রদের ভালোবাসতেন, শেষ সময়টিও তাদের সঙ্গেই ছিলেন তিনি।”
সোমবার সন্ধ্যায় শিলংয়ে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্টে এক অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন কালাম, সেখানেই হঠাৎ ঢলে পড়ে যান তিনি। সঙ্গে সঙ্গে তাকে নেওয়া হয় হাসপাতালে। তার মৃত্যুর পর ৭দিনের শোক ঘোষণা করে ভারত।