সেই ঝরনার রূপ আর তিন্দুর আশপাশের এলাকা নিয়ে লিখেছেন পরিব্রাজক ও চিত্রগ্রাহক ফারুখ আহমেদ।
ছয়টা তো হবেই। সারারাত নির্ঘুম কাটিয়ে পথে নামলাম। আবছা সরের মতো কুয়াশা চারিদিকে। কেমন ঘোর লাগা ভোর। শান্ত চারিদিকে স্বপ্নের মতো ঝিরিঝিরি হাওয়া বইছে। আবেশে আচ্ছন্ন নাসরিন নিপা, বাবু ভাই, অম্লান আর জামান ভাইসহ আমরা ক’জন এগিয়ে চললাম পাহাড়ের পাদদেশের শঙ্খনদীর তীরে।
আহা, আমাদের মনের বাঁধন খুলে যাচ্ছে অজান্তে। শঙ্খনদী আর আশপাশের পাহাড়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে বিমোহিত সবাই। তখনও পাহাড়ি রোদ ডানা মেলেনি। প্রকৃতি দেখতে দেখতেই একঝাঁক বকপাখি উড়ে যেতে দেখলাম, গত সন্ধ্যাকাশে এদেরই নীড়ে ফিরে যেতে দেখেছি।
এমন মনোরম প্রকৃতির বুকে ভেসে ভেসে আমরা চলে এলাম শঙ্খনদীর তীরে। নদীও আমাদের নিরাশ করল না, ভালোবাসায় জড়িয়ে নিল।
তিন্দু ভ্রমণ এটাই আমার প্রথম নয়। দেশের সবচেয়ে প্রিয় জায়গার কথা কেউ জানতে চাইলে চোখ বন্ধ করে তিন্দুর কথাই বলব। তিন্দুর সঙ্গে আমার এক গভীর সম্পর্ক-আত্নীয়তা। খুব প্রয়োজন না হলে আমি দুবার এক জায়গায় ঘুরে বেড়াই না অথচ তিন্দুতে এলে আমার মধ্যে ক্লান্তি বা বিরক্তি কোনোটাই কাজ করে না। তাই তো থানচি থেকে রেমাক্রি হয়ে নাফাখুম ঘুরে দুদিন পর আমি তিন্দুকে বেছে নিলাম প্রাণ খুলে থাকার জন্য, রয়ে সয়ে ঘুরে দেখবার জন্য।
গল্পের শুরু হয়েছিল ঢাকা থেকে। সতের জনের দল একরাতে বান্দরবান হয়ে থানচি চলে আসি, তারপর রেমাক্রি নাফাখুম হয়ে তিন্দু। এখানে পাহাড়, শঙ্খনদীর আর কুমারী ঝরনার মায়াবী আপ্যায়নে মাতোয়ারা হয়েছিলাম।
তিন্দুর পাহাড় আর শঙ্খনদীর গল্প করেছি এবার চলুন কুমারী ঝরনার কাছে!
সেই ভোরবেলা আমরা নদীর বুকে দাপাদাপি করে রুমে এসে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, ঘুম ভাঙে ট্রলার চালকের ডাকে। সে আমাদের কুমারী ঝরনার কাছে নিয়ে যাবে, তাই এই অবেলায় ডাকাডাকি।
কালো পাহাড়ের পাদদেশের কুমারী ঝরনার এমন নামকরণ সম্পর্কে স্থানীয় সাংবাদিক অনুপম মারমাকে প্রশ্ন করলে তার হাস্যোজ্জ্বল উত্তর, “বর্ষার সময় ছাড়া এই ঝরনায় বছরের বাকি সময় পানি থাকে না সে জন্য এর নাম কুমারী ঝরনা।”
আমি হাসবো না কাঁদবো ভেবে পাইনি। ইতোমধ্যে সঙ্গীসাথীরা দ্রুত কুমারী ঝরনার কাছে চলে গেছে। চঞ্চু, নিপা, জামান ভাই, ভাবি, সুরভীসহ অনেককেই দেখা গেল ঝরনার জলে ঝাঁপিয়ে পড়তে। আমি শুধু রয়ে গেলাম অনুভবে কল্পনাতে মিশে কুমারী ঝরনা উপভোগের জন্য।
অবাক বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে দেখতে থাকলাম ৩০ থেকে ৫০ ফুট উপর থেকে গড়িয়ে পড়া ঝরনাটিকে। অরণ্যের গভীরে নয়, একবারে নদীর তীরে পাহাড়ের পাদদেশের অঝোর পাহারের কান্না আমাদের মনকে সত্যি সত্যি নাড়া দিয়ে গেলো।
ভুল বললাম, আসলে আমাদের সবার মনকেই নাড়া দিয়ে গেল। এত সুন্দর ঝরনা দেখে মনে হল নির্জনে এ যেন ঠিক কুমারীর হাসি!
প্রয়োজনীয় তথ্য: তিন্দু বান্দরবানের থানচি উপজেলার একটি ইউনিয়ন। যে কোনো ছুটি ছাটায় ঢাকা থেকে বাসে বান্দরবান চলে যান। তারপর থানচি থেকে রেমাক্রি খালের উপরের দিকে ট্রলার বেয়ে উঠতে উঠতে ঠিক দুই ঘন্টা পর তিন্দু চলে আসবেন।
তিন্দু এলাকায় তিন্দু বাজার থেকে কুমারী ঝরনায় যাতায়াত সময় দশ মিনিট। এই এলাকা শীত কিংবা বর্ষা সমানভাবেই দারুণ জনপ্রিয় হলেও কুমারী ঝরনায় যাওয়ার মোক্ষম সময় নভেম্বর পর্যন্ত।
খাবার নিয়েও নির্ভাবনায় সময় কাটাতে পারেন। মারমাদের দোকানে বলে দিলে তারা খাবারের ব্যবস্থা করবে। এর বাইরে আপনি নিজে থানচি থেকে বাজার করে এনে নিজেরাই রান্না করে খেতে পারবেন।
তিন্দুর অসাধারণত্ব বলে শেষ করা যাবে না। তিন্দু থেকে ডানে গেলে পাবেন লংলক ঝিরি, বাজার ঘেসে আছে মাউক ঝিরি। বড় পাথর এলাকায় পাবেন কুমারী ঝরনা।
তারপর- তার আর পর নেই, শুধু মনে হবে আপনি রয়েছেন স্বপ্নের ভেতর, ঘোর লাগা যে স্বপ্নের দৃশ্য চোখ থেকে কোনো দিন মুছবে না!
সচেতনতা: থানচি থেকে তিন্দু যেতে হবে পানি পথে। পানি পথে যাতায়াতে একটু বাড়তি সর্তকতা অবলম্বন করতে হবে। অবশ্যই লাইফ জ্যাকেট সঙ্গে রাখবেন।
একটা বিষয় খেয়াল রাখবেন আপনার বা আপনার ভ্রমণ সঙ্গীদের মাধ্যমে পরিবেশ হুমকিতে পড়ে এমন কোনো কিছু অবশ্যই করা চলবে না, পলিথিন বা প্লাস্টিকের বোতলসহ পরিবেশ বিপন্ন হয় তেমন কিছু ফেলে আসবেন না।