জাতীয় জাদুঘরের এই আয়োজনে স্থান পেয়েছে শিল্পীর ভাস্কর্য, তাঁর আঁকা চিত্রকর্মের আলোকচিত্র এবং ব্যক্তিগত কিছু ছবি।
Published : 11 Oct 2015, 10:20 PM
কলাবাগান থানার পাশে সবজির ব্যবসা করেন এবাদুল হক মোল্লা। অনেকের কাছেই শুনেছেন জাতীয় জাদুঘরের কথা। শনিবার বিকেলে অবসর সময়ে তাই ঘুরতে ঘুরতে চলে এসেছিলেন সেখানে। আর কোথাও যাননি, তার আগেই নলিনীকান্ত ভট্টশালী গ্যালারিতে এসে যেন বিহ্বল ভাব কাটিয়ে উঠতে পারছিলেন না।
“খুব সুন্দর লাগসে। সিমেন্ট দিয়া কি সুন্দর মানুষ বানাইসে। ওরা অবলা কিন্তু কত্ত সুন্দর। কয়ডা বইসা আসে, কয়ডা জাগা (দাঁড়ানো)। কিন্তু খুউব শক্ত (ক্ষমতা বোঝাতে)। কথা কইতে পারে না কিন্তু মনে হয় জাতা (জীবিত)।”
এবাদুল হকের এই অভিব্যক্তি ঢাকার জাতীয় জাদুঘর আয়োজিত ভাস্কর নভেরা আহমেদের ভাস্কর্য ও চিত্রকর্মের আলোকচিত্র দেখে।
গেল শতকে বাংলাদেশে শুরু হওয়া ভাস্কর্য শিল্পচর্চার প্রথিকৃত নভেরা আহমেদ। ১৯৩০ সালে সেই সময়কার অবিভক্ত বাংলার রাজধানী কলকাতায় জন্ম নেওয়া এই শিল্পী ৬ মে ফ্রান্সের প্যারিসে মারা যান। অবহেলা আর অভিমানে জীবনের লম্বা সময় সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন করা এই শিল্পীর প্রতি সম্মান জানাতেই ১৩ দিনের এই আয়োজন।
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের নকশা করা সময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করলেও পরবর্তী সময়ে উপেক্ষা করা হয়েছে। এরপর ১৯৬০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ইনার গেজ’ শিরোনামে নিজের প্রথম একক ভাস্কর্য প্রদর্শনী করেন শিল্পী। তবে এর আগে ১৯৫০ সালে, পারিবারিক অনুপ্রেরণায় আইন বিষয়ে পড়তে লন্ডনে যান নভেরা।
তবে বিষয় পাল্টে পড়ালেখা করেন ভাস্কর্য শিল্প নিয়ে। পরে ইতালিতেও ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি।
জীবনের শেষদিকে অবশ্য চিত্রকর্মের দিকে ঝুঁকেছিলেন শিল্পী। যার মধ্য থেকে ২৮টি চিত্রকর্মের অলোকচিত্র দেখতে পাওয়া যাবে এই প্রদর্শনীতে।
‘দা ফিনিক্স’, ‘ফর দ্যা ব্যারন’, ‘রোড লালুমিয়েখ’ এইসব চিত্রকর্মের পাশাপাশি নভেরাকে দেখা যাবে স্টুডিওতে কিংবা স্বামী গ্রেগোয়া দ্য ব্রুসের সঙ্গে।
জাতীয় জাদুঘরের সংগ্রহে থাকা শিল্পীর ৪০টি ভাস্কর্যের ৩৪টি প্রদর্শিত হচ্ছে এই আয়োজনে। নভেরা কাজ করেছেন মূলত সিমেন্ট দিয়ে। তবে এর মাঝে মার্বেল কণাও ব্যবহার করেছেন। টেপা পুতুল, নারী কিংবা পশুদের অবয়বভিত্তিক ভাস্কর্য রয়েছে প্রদর্শিত শিল্পকর্মগুলোর মধ্যে। নারী অবয়বে এক ধরনের অদ্ভুত শীতলতার মধ্য দিয়ে হয়ত নিজের শক্ত অবস্থানকে ফুটিয়ে তুলেছিলেন নভেরা। তার করা নারী ভাস্কর্যগুলো যতটাই শক্তিশালী কখনও কখনও ঠিক ততটা, বিষন্নতা এনে দেয়।
কথা প্রসঙ্গে সোহেল রানা জানালেন, “অধিকাংশ নারী মূর্তিই উপরের দিকে তাকিয়ে আছে। দৃষ্টিসীমানা যেন আকাশকে অতিক্রম করতে চাচ্ছে। আমার মনে হয় এই ভাস্কর্যগুলো শিল্পীর নিজের জীবনেরই প্রতিচ্ছবি। অনেক অভিমান নিয়ে এগুলো তৈরি করেছিলেন তিনি।”
তবে জাহিদুলের মাথায় অন্য চিন্তা। অসাধারণ এই শিল্পীর কাজগুলো কতটাই বা সংরক্ষণ করছে জাতীয় জাদুঘর তা নিয়ে প্রশ্ন করলেন তিনি।
“ভাস্কর্যগুলো দেখলেই বোঝা যায় ঠিকমত সংরক্ষণ করা হয়নি। যতটুকু জানি, আমাদের সংগ্রহে খুব বেশি কাজ নেই। তাই বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শিল্পীর কাজগুলো সংগ্রহ করা উচিত। আর যেগুলো আছে, সেগুলো দেখেই বোঝা যাচ্ছে কতটায় অবহেলার শিকার হচ্ছে এই শিল্পকর্মগুলো। মৃত্যুর আগেও তাকে সম্মান দিতে পারিনি, এখনও তার প্রাপ্য সম্মান ঠিক মতো দিচ্ছি কিনা তাও সন্দেহ।”
নভেরা আহমেদের এই শিল্পকর্মগুলো এক কথায় বাংলাদেশের শিল্পকলা চর্চার ইতিহাসের অনন্য সম্পদ। ১৯৯৭ সালে সরকার তাকে সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদক প্রদান করতে চাইলেও তিনি তা গ্রহণ করতে দেশে ফেরেননি।
‘নভেরা আহমেদ এক্সিবিশন ২০১৫’ শিরোনামে ৭ অক্টোবর রাজধানীর শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরের নলিনীকান্ত ভট্টশালী মিলনায়তনে শুরু হওয়া এই প্রদর্শনী শেষ হবে ১০ অক্টোবর। শনি থেকে বুধবার পর্যন্ত সকাল সাড়ে ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত ও শুক্রবার দুপুর আড়াইটা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা পর্যন্ত সবার জন্য উন্মুক্ত এ আয়োজন।
ছবি: ফায়হাম ইবনে শরীফ।