পহেলা বৈশাখের কথকতা

কী করে এল বাংলা সন, পহেলা বৈশাখ? কবে শুরু হল রমনা বটমূলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আর শোভাযাত্রা?

>> জামীউর রহমান রনিমবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 April 2014, 12:28 PM
Updated : 13 April 2014, 12:28 PM

পহেলা বৈশাখের দিন নির্ধারণ

পহেলা বৈশাখ আমাদের বাংলা পঞ্জিকার প্রথম মাস বৈশাখের ১ তারিখ বা প্রথম দিন। গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জি অনুসারে পহেলা বৈশাখ পালন করা হয় ১৪ এপ্রিল। আর তা নির্ধারণ করে দিয়েছে বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ-ই।

বাংলা সনের প্রবর্তন

হিন্দু সৌরপঞ্জিকা শুরু হতো গ্রেগরিয়ান পঞ্জিকায় উল্লিখিত এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে। তবে এই সৌরপঞ্জিকাতে বাংলার বারটি মাস অনেক বছর আগে থেকেই পালিত হয়ে আসছিল বলে দাবি করেছেন অনেক ইতিহাসবিদ।

হিন্দু সৌরপঞ্জিকার আমলেও নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখে উৎসব পালন করা হত। তবে সে উৎসব ছিল ঋতুধর্মীয় উৎসব। মূলত তখনকার কৃষিকাজ-ভিত্তিক সমাজেই নিহিত ছিল এই উৎসবের তাৎপর্য। বঙ্গ, নেপাল, ত্রিপুরা, আসাম, উড়িষ্যা, কেরালা, মনিপুর, পাঞ্জাব, তামিলনাড়ুর অধিবাসীরা পালন করত এ উৎসব। পালন করত তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির এক অপরিহার্য অংশ হিসেবেই।

খেয়াল রাখা দরকার, বাংলা সনের সঙ্গে হিজরি সন ও খ্রিস্টীয় বা গ্রেগরিয়ান সনের অনেক পার্থক্য আছে। যেমন, হিজরি সনের দিনগণনা শুরু হয় সন্ধ্যার নতুন চাঁদের আগমনের মধ্য দিয়ে। অন্যদিকে, গ্রেগরিয়ান সনের দিনগণনা শুর হয় মধ্যরাতে ঘড়ির কাঁটা বারটার ঘর ছুঁলে। আর বাংলা সনের দিন শুরু হয় সূর্যোদয়ের মধ্য দিয়ে। আর তাই বাঙালির পহেলা বৈশাখ বা বর্ষবরণও শুরু হয় ভোরের হাস্যোজ্জ্বল সূর্যোদয় দিয়ে।

ভারতবর্ষের মোগল সম্রাটরা কৃষি পণ্যের খাজনা আদায় করতেন হিজরি পঞ্জিকার দিন-তারিখ অনুযায়ী। কিন্তু হিজরি সন আবার নির্ভর করে সম্পূর্ণ চাঁদের উপর। ফলে খাজনা আদায় করা নিয়ে প্রচুর বিপত্তি হতে শুরু করল। তখন তৎকালীন মোগল সম্রাট আকবর সুষ্ঠুভাবে খাজনা আদায়ের লক্ষ্যে এক নতুন পঞ্জিকা প্রবর্তন করেন। এই পঞ্জিকাটির সনই বাংলা সন হিসেবে পরিচিত।

সম্রাট আকবরের আদেশক্রমে তৎকালীন বাংলার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ ফতেহউল্লাহ সিরাজী হিন্দু সৌর সন এবং আরবি হিজরি সনের ভিত্তিতে সম্পূর্ণ নতুন এই বাংলা সনের পঞ্জিকা তৈরি করেন। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ মার্চ (মতান্তরে ১১ মার্চ) থেকেই এই নতুন প্রবর্তিত সন গণনা শুরু হয়। তবে সম্রাট আকবরের সিংহাসন-আরোহণের বা অভিষেকের স্মরণে ধরা হয়, তার অভিষেক থেকেই এই বাংলা সন গণনা শুরু হয়েছে। অর্থাৎ, ৫ই নভেম্বর, ১৫৫৬ ইংরেজি সন থেকেই। উল্লেখ্য, সর্বপ্রথম এই বাংলা সনের নামকরন করা হয়েছিল ‘ফসলি সন’। পরে কালের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই ‘ফসলি সন’ই ‘বঙ্গাব্দ’ বা ‘বাংলা সন’ হিসেবে পরিচিতি পেতে শুরু করে।

হালখাতা থেকে পহেলা বৈশাখ

সম্রাট আকবরের সময় থেকেই ‘পহেলা বৈশাখ’ উদযাপন শুরু হয়। কিন্তু তখনকার পহেলা বৈশাখ উদযাপন এখনকার মতো ছিল না। তখনকার পহেলা বৈশাখ পালনে ভিন্নতা ছিল। যেমন, বছর শুরুর আগের দিনে, অর্থাৎ চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যেই সকলকে সকল প্রকার খাজনা-মাশুল-শুল্ক পরিশোধ করতে হত। আর পরের দিন, অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিকরা, অর্থাৎ জমিদাররা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদের মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করতেন।

খাজনা পরিশোধ করা উপলক্ষ্যে বিভিন্ন উৎসবেরও আয়োজন করা হত।

আগে পহেলা বৈশাখের এই দিনে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ‘হালখাতা’ খোলা হত। সে দিন প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় দেনা-পাওনার হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করা হত। অর্থাৎ আগের বছরের হিসাবের পাঠ চুকিয়ে নতুন হিসাব শুরু করা হত। নতুন হিসাবের খাতা খুলে এই হিসাব হালনাগাদ করাকেই বলা হত হালখাতা। হালখাতার দিনে দোকানিরা ক্রেতাদের মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করে থাকে। এত বছর পরে আজও কিন্তু এই প্রথাটি অনেকাংশে প্রচলিত রয়েছে। বিশেষ করে স্বর্ণের দোকানদাররা ক্রেতাদের এখনও পহেলা বৈশাখে মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করেন।

১৯১৭ সালের উৎসবটি একটু বিশেষভাবেই উদযাপন করা হয়েছিল। সে বারে অবশ্য একটা আলাদা উদ্দেশ্যও ছিল-- প্রথম মহাযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা। তবে পরবর্তীতে সে উদ্দীপনা আর ছিল না। পরে ১৯৬৭ সালে আবার জাঁকজমকের সঙ্গে পহেলা বৈশাখ উদযাপন শুরু হয়।

বাংলাদেশের পহেলা বৈশাখ

আমাদের দেশে পহেলা বৈশাখের সবচেয়ে বড় উৎসব হয় ঢাকা শহরে। আর সে উৎসবের প্রাণকেন্দ্র বলা যেতে পারে রমনা বটমূলে আয়োজিত ছায়ানটের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ছায়ানটের শিল্পীরা এ দিন খুব ভোরবেলা থেকেই সম্মিলিত কণ্ঠে বৈশাখী আগমনী গানের মাধ্যমে নতুন বছরের সূর্যকে স্বাগত জানান। তবে রমনা বটমূলে বলা হলেও, প্রকৃত পক্ষে যে গাছের ছায়ার নিচে প্রতি বছর মঞ্চটি তৈরি করা হয়, সেটা আসলে একটা পুরনো অশ্বত্থ গাছ।

এই উৎসবটিরও কিন্তু ইতিহাস আছে। পাকিস্তানি শাসনামলে শাসকরা বাঙালি সংস্কৃতি দমিয়ে রাখার জন্য অনেক কিছুই করেছিল। একবার তো ওরা রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গানের উপরই নিষেধাজ্ঞা জারি করে বসে। এর প্রতিবাদেই ছায়ানট ১৩৭৫ বঙ্গাব্দে অর্থাৎ ১৯৬৫ সালে রমনা পার্কে পহেলা বৈশাখ উদাযাপনের আয়োজন করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো’ গানের মধ্যে দিয়ে স্বাগত জানানো হয় বৈশাখকে। সেই ধারা আজও অব্যাহত আছে। আর ১৯৭২ সালে থেকে এটিকে জাতীয় উৎসব হিসেবেই এক রকম স্বীকৃত দিয়ে দেওয়া হয়।

ঢাকার পহেলা বৈশাখের জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজনের আরেক আকর্ষণ ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজিত হয় ১৯৮৯ সালে। এখনকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ তখন ছিল চারুকলা ইন্সটিটিউট। সেই চারুকলা ইন্সটিটিউটের উদ্যোগে ও আয়োজনেই পহেলা বৈশাখের সকালে এই শোভাযাত্রাটি বের হয়। তারপর শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে আবার তা ফিরে আসে চারুকলায়। আর সে শোভাযাত্রায় রং-বেরঙের মুখোশে আর বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিমূর্তি দিয়ে একেক বছর তুলে ধরা হয় আবহমান বাংলার সংস্কৃতি। একেক বছর এই শোভাযাত্রার জন্য একেক থিম বেছে নেওয়া হয়। কোনো বছর থিম রাখা হয় হাতি, কোনো বছর কুমির, কোনো বছর বাঘ। আবার কখনও এই শোভাযাত্রার মাধ্যমে প্রতিবাদও জানানো হয়।