মাদার তেরেসা

সিঁড়ির নিচে এসেই পিলু থেমে গেল। ঘাড়টা আকাশের দিকে করে (ঠিক আকাশের দিকে নয়; বাবা এত লম্বা যে, বাবার মুখের দিকে তাকাতে গেলে পিলুকে ঠিক সেভাবেই ঘাড় ফেরাতে হয়, যেভাবে ঘাড় ফিরিয়ে মানুষ আকাশ দেখে) পিলু বলল, “ভুল হয়ে গেছে!”

>> আবুল কালাম আজাদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 March 2014, 10:56 AM
Updated : 29 March 2014, 10:56 AM

“আবার ভুল কী! কোনো বই রেখে এসেছ?”

“পানির ফ্লাস্ক আনিনি।”

“তোমাকে কত বার বলেছি যে, আমরা লিফটওয়ালা দালানে থাকি না। নামার সময় সব কিছু খেয়াল করে নিয়ে তারপর নামবে। এখন আর পাঁচতলায় উঠতে পারব না।”

“তাহলে পানি নেব না?”

“না।”

“তাহলে টিফিন পিরিয়ডে পাউরুটি-ডিম খেয়ে...।”

“বন্ধুদের কাছ থেকে পানি চেয়ে খাবে।”

“বন্ধুদের কাছ থেকে?”

“হ্যাঁ, বন্ধুদের কাছ থেকে। পানি কি ডিজেল-পেট্রল নাকি, যে অনেক দাম দেখে কেউ দিতে চাইবে না?”

“পানি না নিয়ে গেলে আমার ভাল্লাগে না। শুধু কি টিফিন পিরিয়ডে পানি খাই? এমনিতেই তো খেতে হয়। বারবার বন্ধুদের কাছে চাওয়া যায়?”

“আমি এখন পাঁচতলা বেয়ে উঠতে পারব না। একদিনের ব্যাপারই তো...।”

“বাবা!”

“প্লিজ, আড়ি করবে না। চল, দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

এ রকম কথাবার্তার মধ্যেই পিলু শুনতে পেল মায়ের কণ্ঠ। মা বলছেন, “এই যে পানির ফ্লাস্ক।”

মা পানি নিয়ে একেবারে নিচে চলে এসেছেন। মাকে কাছে পেলে বাবার বিরুদ্ধে পিলুর অভিযোগ জানানো চাই-ই চাই। পিলু বলল, “বাবা বলছিল বন্ধুদের কাছ থেকে পানি খেতে।”

এ অভিযোগের প্রেক্ষিতে মার কাছ থেকে কেমন জবাব পাবে, পিলুর তা ভালোই জানা। মা বললেন, “তোমার বাবার যা বুদ্ধি! এই কাঠ-ফাঁটা গরমে কত বার অন্যের কাছ থেকে পানি খাওয়া যায়? কত বার অন্যকে বলা যায়, তোমার ফ্লাস্কটা একটু দাও তো-- তোমার ফ্লাস্কটা একটু দাও তো।”

“তাই বল মা। অন্যরা বিরক্ত হবে না?”

“হবে না আবার? মহা বিরক্ত হবে। মহা বিরক্ত হয়ে আমারই বদনাম করবে। বলবে-- এই মেয়ের মা-টা না কেমন! মনে করে মেয়েকে পানিটাও দিয়ে দেয় না।”

“বাবা কি তা বোঝে?”

“কোনো কোনো মানুষ আছে, যারা সবকিছু বোঝে না। তোমার বাবা তেমন একজন।”

বাবা বললেন, “এখন আমাদের যাওয়া উচিত। রিকশা পেতে দেরি হলে ক্লাশ মিস হয়ে যাবে।”

রিকশা পেতে দেরি হল না। রাস্তার পাশে দাঁড়াতেই একটা রিকশা এসে ভিড়ল পাশে। বাবা পিলুর হাত ধরে তাতে উঠে পড়লেন।

হুট করে রিকশা পেলে হবে কী! ক্লাশে দেরি হয়েই যাবে। যে জ্যাম শহরে!

হ্যাঁ, কিছুটা এগোতেই বিশাল জ্যাম-- যাকে বলে অসম্ভব জ্যাম। দেখেই বাবার মুখ বিকৃত হল। বললেন, “তোমাকে মর্নিং শিফটে ভর্তি করতে পারলে কী যে ভাল হত! সকাল সাতটায় জ্যাম-ট্যাম কম থাকে। আবহাওয়া-ও ঠাণ্ডা থাকে। ফেরার পথে যা একটু ঝক্কি।”

পিলু যেন বাবার কথা শুনতেই পেল না। সে তখন রিকশার হুডের ফাঁক দিয়ে রাস্তার পাশে তাকিয়ে। সে খেয়ালি মেয়ে। কোন দিকে খেয়াল গেছে কে জানে! বাবার মন অস্থির, কখন জ্যাম ছাড়বে।

জ্যাম যখন ছাড়ছে, রিকশা-গাড়ির সারি একটু একটু করে নড়াচড়া করছে, ঠিক তখন পিলু বলল, “বাবা, ঐ যে দ্যাখো!”

পিলু আঙুল দিয়ে নির্দেশ করল রাস্তার পাশে, ফুটপাতে। বাবা তাকিয়ে দেখলেন, দেয়ালের সঙ্গে একটা পানির কল। জীর্ণ পোশাক পড়া এক বৃদ্ধ সেই কলের তলে একটা বোতল ধরে রেখেছে আর কলের চাবি এদিক-ওদিক ঘোরাচ্ছে। কিন্তু তাতে বিশেষ কোনো ফল পাচ্ছে না সে। কলের মুখ দিয়ে এক ফোঁটা পানিও পড়ছে না। পিলু কি এই দৃশ্যটাই দেখাচ্ছে?

বাবা বললেন, “কী?”

“লোকটা পানি খেতে চাচ্ছে।”

“হু, তবে কলের মুখ দিয়ে এক ফোঁটা পানিও বের হবে বলে মনে হয় না।”

এরই মাঝে লোকটা শূন্য বোতল নিয়ে কাঁপতে কাঁপতে ফিরে এসে ফুটপাতের পাশে দুই হাঁটুর মধ্যে মাথা গুঁজে বসে পড়ল। এমনভাবে বসল, যেন মাথাটা কঠিন পাথরের রাস্তায় ঠেকে যাবে। পিলু বলল, “বাবা, চল তার কাছে যাই।”

“কেন?”

“আমি তাকে একটু পানি দেব।”

“তোমার স্কুলের দেরি হয়ে যাচ্ছে যে!”

“একদিন স্কুলে দেরি হলে অত কি ক্ষতি হবে?”

কাছে গিয়ে বাবা লোকটাকে ডাকলেন, “চাচা মিয়া?”

বাবা অপরিচিত বয়স্কদের ‘চাচামিয়া’ ডাকেন। কিন্তু বাবার বয়সি বা তারচেয়েও ছোটদের ‘ভাইমিয়া’ না বলে ডাকেন ‘ভাইসাহেব’। দুই বার ডাকার পর লোকটা মাথা তুলল। ঢুলুঢুলু চোখে তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল, “কে...”

“আপনি কি পানি খাবেন?”

লোকটা বোতলের দিকে আঙুল তুলে হাত নেড়ে বোঝাল, পানি নেই। সে বোধহয় কথাও বলতে পারছে না। বাবা বললেন, “আমার মেয়ে আপনাকে পানি দিতে এসেছে। আপনি বোতলটা তুলে ধরেন।”

লোকটার চোখ চকচক করে উঠল। বৃষ্টি আর নদীর এই দেশে পানিও কতটা দুর্লভ, তার চাহনিতে তা স্পষ্ট। সে বোতলটা তুলে ধরল। পিলু ফ্লাস্কের মুখ খুলে পানি বোতলে ঢালতে লাগল। কিছুটা ঢালতে না ঢালতেই বোতলটা মুখের মধ্যে উপুর করে ধরল লোকটা। ঢকঢক করে পানিটুকু খেয়ে তবেই শান্ত হল। তারপর আবার বোতল এগিয়ে দিল। পিলু তার বোতলের সবটুকু পানি ঢেলে দিল বৃদ্ধের বোতলে।

লোকটা আরও একটু পানি খেল। বাকিটুকু রেখে দিল, পরে খাবে। তারপর অনেকটা সতেজ কণ্ঠে বলল, “মাগো, বড় হয়ে তুই মাদার তেরেসা হবি। পথের ছেলে-মেয়েদের জন্য মাদার তেরেসার এমনই ভালোবাসা ছিল।”

পিলু বলল, “তোমার কেউ নেই?”

“আছে। দুইটা বাপ আর একটা মা আছে। তারা আমাকে ফেলে গেছে।”

“দুইটা বাবা, একটা মা!”

রিকশায় উঠে পিলু কিছুক্ষণ নীরব থাকল। তারপর বলল, “দুইটা বাবা?”

বাবা প্রশ্নটা বুঝে নিয়ে বললেন, “আজ তুমি ছোট। তোমাকে যত্ন-আত্মি করে বড় করে তুলছে তোমার বাবা-মা। একদিন তারা বৃদ্ধ হয়ে যাবে। তখন তাদের আর কাজ করার শক্তি থাকবে না। বুড়ো শরীরে বাসা বাঁধবে নানা অসুখ-বিসুখ। তখন তারা হবে তোমার সন্তান। তোমার যত্ন-আত্মি তখন তাদের দরকার হবে। প্রতিটি মানুষের জীবনে একটা সময় আসে, যখন সন্তান হয়ে ওঠে বাবা-মা, আর বাবা-মা হয়ে যায় সন্তান। আজ তোমার বাবা-মা তোমাকে দেখাশোনা না করলে তুমি যেমন চলতে পারবে না, একদিন তুমি তোমার বাবা-মাকে দেখাশোনা না করলে তাদেরও চলতে কষ্ট হবে। একদিন এই বৃদ্ধের শরীরে শক্তি ছিল। অক্লান্ত পরিশ্রম করে সে দুইটি ছেলে আর একটি মেয়েকে বড় করে তুলেছে। এখন

সে অক্ষম, এখন তারা ফেলে দিয়েছে তাদের বাবাকে-- বুড়ো সন্তানটাকে। সে এখন পথে পড়ে আছে। ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত।”

“আর মাদার তেরেসা?”

“মাদার তেরেসা সম্পর্কে জানো না কিছু? তিনি ছিলেন সেই মহীয়ষী নারী, যিনি নিজের জীবনের সব সুখ-শান্তি বিসর্জন দিয়ে রাস্তার শিশুদের জন্য কাজ করেছেন। তাদের শিক্ষা, খাদ্য ও আবাসের ব্যবস্থা করেছেন। ... না, তিনি নিজের সুখ-শান্তি বিসর্জন দিয়ে এসব করেছেন, তা বলা যায় না। বঞ্চিত শিশুদের জন্য কাজ করাই ছিল তার সুখ, তার শান্তি। তিনি শান্তিতে নোবেল পুরস্কারও পেয়েছেন। এই বৃদ্ধ তোমার মধ্যে সেই মহীয়ষী নারীর ছায়া দেখেছে।”

বাবা থামলেন। তিনি এখন প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলবেন। একটা প্রসঙ্গ থেকে অন্য প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে বাবা একটু বিরতি নেন। প্রসঙ্গ পাল্টে বাবা বললেন, “আমার খুব ভাল লাগছে যে, এই বয়সেই আমার মেয়েটা হৃদয় দিয়ে মানুষের কষ্ট বুঝতে চায়। সে কিছু করতে চায় মানুষের জন্য। আমার মনে কিছুটা গর্বও জাগছে। ... তুই যেন আরেকটা মাদার তেরেসা হতে পারিস, তোর জন্য আমার সেই প্রার্থনা। এই পৃথিবীতে যত বেশি মাদার তেরেসা আসবে, পৃথিবীর দুঃখ তত কমবে। আয় মাদার তেরেসা, আয় তোর মাথাটা আমি একটু বুকে নিয়ে থাকি।”

বাবা পিলুর মাথাটা বুকে টেনে নিলেন। বাবার বুকে মাথা রেখে পিলু তাকিয়ে রইল আকাশের দিকে। হয়তো তার চোখে ভাসছে একটি মেয়ের ছবি। যে মেয়ে বড় হয়ে গেছে। বড় হয়ে অবহেলিত-বঞ্চিত শিশু-বৃদ্ধ সবার জন্য নিজের জীবন বিলিয়ে দিচ্ছে। এই বিলিয়ে দেওয়াতেই তার সুখ, এই বিলিয়ে দেওয়াতেই তার শান্তি।