গাছপালা ও আমরা

গাছপালা আমাদের কী কী উপকারে আসে? কেন গাছপালা আমাদের প্রিয় বন্ধু?

>> রহীম শাহবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 March 2014, 08:56 AM
Updated : 27 March 2014, 08:56 AM

গাছপালার উপর আমরা নির্ভরশীল খাদ্যের জন্য, বস্ত্রের জন্য, বাসস্থানের জন্য, ওষুধের জন্য, আসবাবপত্রের জন্য, জ্বালানির জন্য, বিশুদ্ধ বায়ুর জন্য এবং স্বাস্থ্যকর পরিবেশের জন্য। শুধু তাই নয়, গাছপালার সুন্দর শ্যামলিমা আমাদের মনে অনাবিল আনন্দও সৃষ্টি করে।

আমরা প্রধানত কী খাই? কেউ ভাত খাই, আবার কেউ রুটি খাই। ভাত আসে ধান থেকে আর রুটি আসে গম থেকে। এ দুটিই উদ্ভিদ। এরা কৃষিজ-উদ্ভিদ। কারণ, খাদ্যের জন্য এদের চাষ করা হয়। এছাড়াও অন্যান্য খাদ্যশস্যের মধ্যে রয়েছে ভুট্টা, যব, কাউন, চিনা প্রভৃতি।

আবার ভাত বা রুটির সঙ্গে আমরা তরকারি খাই। তরকারিও উদ্ভিদ থেকেই আসে। তরি-তরকারির মধ্যে আলু, কচু, ডাটা, ওলকপি প্রভৃতিকে কাণ্ড-সবজি বলা হয়। কারণ, তারা উদ্ভিদের কাণ্ড। মূলা, মিষ্টি আলু, শাক আলু, গাজর, শালগম, বীট, প্রভৃতি হলো মূল-সবজি। কারণ, এসব গাছের ম‚লই সাধারণত সবজি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বাঁধাকপি, পালংশাক, পুঁইশাক, লেটুস প্রভৃতি হল পাতা-সবজি। ফুলকপি, বকফুল প্রভৃতি ফুল-সবজি আর লাউ, কুমড়া, শশা, খিরা, চিচিঙ্গা, কাকরোল, ঝিঙ্গা, পটল, শিম, বেগুন, ঢেঁড়শ, পেঁপে, বরবটি প্রভৃতি হল ফল-সবজি। কাজেই সকল সবজিই উদ্ভিদ জগৎ থেকে আমরা পেয়ে থাকি।

মসুর, মুগ, মটর, ছোলা, অড়হর প্রভৃতি ডাল খেয়ে থাকি। এরা বিভিন্ন উদ্ভিদের ফল। ডালে প্রচুর আমিষ আছে। সঠিকভাবে শরীর গঠনের জন্য ডাল ও শাক-সবজি বেশি করে খাওয়া দরকার।

ডাল, সবজি প্রভৃতি কাঁচা খাওয়া যায় না। তাই এদের রান্না করতে হয়। রান্না করতে এদের সঙ্গে লাগে বিভিন্ন প্রকার মসলা এবং তেল। তেল এবং মসলাও কিন্তু উদ্ভিদেরই অংশ। মসলার মধ্যে জিরা, ধনিয়া, মরিচ, এলাচ, গোলমরিচ প্রভৃতি ফল। লবঙ্গ ফুলের কুঁড়ি। জাফরান ফুলের গর্ভমুণ্ড। দারুচিনি গাছের বাকল। তেজপাতা, পুদিনা প্রভৃতি গাছের পাতা। রসুন, পিঁয়াজ প্রভৃতি রসালো শল্কপত্র। আদা, হলুদ প্রভৃতি মাটির নিচের কাণ্ড। তেলের মধ্যে সরিষা, তিল, বাদাম, সয়াবিন, নারিকেল প্রভৃতি প্রধান। বীজ থেকে পেষণের মাধ্যমে তেল আহরণ করা হয়।

রসগোল্লা, চমচম, সন্দেশ, মিষ্টি, সেমাই, পায়েস প্রভৃতি কে না পছন্দ করে। মিষ্টি তৈরির জন্য চাই চিনি বা গুড়। আর চিনি বা গুড় আসে ইক্ষু, তাল, খেঁজুর প্রভৃতি গাছপালা থেকে। ডাক্তার বলেন, আহারের পর ফল খাওয়া ভালো। তাছাড়া শরীর গঠনের জন্য ফল অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। ফলে বিভিন্ন প্রকার ভিটামিন আছে। সব রকম ফলই গাছপালার দান।

শীত নিবারণ ও শরীর ঢাকার জন্য চাই বস্ত্র। বস্ত্র সভ্যসমাজের বিশেষ অবদান। বস্ত্র আসে সুতা থেকে। আর সুতা আসে তুলা থেকে। তুলা হলো কার্পাস গাছের বীজের বর্ধিত কিছু ত্বকরোম। পাট এবং পাটজাতীয় আঁশ হতেও কিছু বস্ত্র তৈরি করা হয়। অর্থাৎ বস্ত্রের জন্যও আমরা উদ্ভিদের উপর নির্ভরশীল।

আমরা যে ঘরে থাকি তা যদি বাঁশ বা কাঠ নির্মিত হয় তবে তো আর কথাই নেই, সম্পূর্ণই উদ্ভিদনির্ভর। আর যদি ইটের তৈরি দালান হয়? দালানেরও চাই কাঠের সুন্দর দরজা-জানালা। কাঠের কথা না হয় আপাতত বাদই রাখলাম। ইট পোড়াতেও কিন্তু লাকড়ি বা কয়লার দরকার হয়। লাকড়ি সরাসরি গাছপালা থেকেই আসে। আর কয়লা, তাও আসে গাছপালা থেকে। তবে বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে।

অতীত কালের বিরাট বিরাট গাছপালা মাটি চাপা পড়েছিল। সেই চাপাপড়া গাছপালার কাঠগুলো বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরিবর্তিত হয়ে কয়লায় রূপান্তরিত হয়েছে। তাই কয়লাও পরোক্ষভাবে গাছপালা থেকেই এসেছে। অর্থাৎ দালান-কোঠা নির্মাণের জন্যও প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে আমাদের গাছপালার উপর নির্ভর করতে হয়। তারপর রয়েছে ঘরের আসবাবপত্র। চেয়ার, টেবিল, আলমারি, খাট, চৌকি, ড্রেসিং টেবিল প্রভৃতি অধিকাংশ আসবাবপত্রই কাঠ থেকে তৈরি।

কাগজ হল সভ্যজগতের অতি প্রয়োজনীয় বস্তু। যে বই পড়ে জ্ঞান আহরণ করা হয়, তার জন্য চাই কাগজ। অর্থাৎ কাগজ হল জ্ঞানের বাহন। কাগজের প্রধান উপকরণও কিন্তু উদ্ভিদ। যে কাগজে খবর ছাপা হয় তা হল নিউজপ্রিন্ট। আমাদের দেশে নিউজ প্রিন্ট উৎপন্ন হয়। এর কাঁচামাল সুন্দরবনের গেওয়া গাছ। সাদা কাগজে বই ছাপা হয় এবং লেখার কাজ করা হয়। সাদা কাগজের প্রধান কাঁচামাল হল বাঁশ আর আখের ছিবড়া। অর্থাৎ বর্তমান সভ্যতার যে প্রধান উপকরণ কাগজ, তার জন্য আমরা উদ্ভিদের উপরই নির্ভরশীল।

আমাদের চারদিকে রোগ-জীবাণুর ছড়াছড়ি। তাই আমরা সময়-সময় অসুস্থ হয়ে পড়ি। কখনও সামান্য অসুস্থ হই, আবার কখনও গুরুতর অসুখে পড়ি। কিন্তু তার জন্য চাই উপযুক্ত ওষুধ। অ্যালোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি, কবিরাজি, ইউনানি, আয়ুর্বেদি-- সকল প্রকার চিকিৎসা পদ্ধতির শতকরা প্রায় আশিভাগ ওষুধই বিভিন্ন গাছপালা থেকে সংগ্রহ করা হয়। আর পথ্যের অধিকাংশই আসে উদ্ভিদ থেকে।

পেনিসিলিন, টেরামাইসিন, স্ট্রেপ্টোমাইসিন, অরিওমাইসিন প্রভৃতি মহামূল্যবান অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ অতি ক্ষুদ্র উদ্ভিদ থেকে সংগ্রহ করা হয়।

কাজ করতে-করতে অথবা পড়তে-পড়তে মানুষ যখন একটু ক্লান্ত ও অবসাদ অনুভব করে, তখন এক কাপ চা বা কফি খেতে চায়। চা এবং কফি কোথা থেকে আসে? চা আসে চা গাছের কচি পাতা থেকে আর কফি আসে কফি গাছের বীজ থেকে। আমাদের দেশে সিলেট এবং চট্টগ্রামে এই চা বাগান আছে। তা ছাড়া সিলেটে কফি বাগানও আছে।

বর্তমান সভ্যতার আর একটি বড় অবদান-- টেলিফোন। টেলিফোনের সাহায্যে আমরা বহুদূর থেকে পরস্পর আলাপ-আলোচনা করা যায়। অতি সহজে এবং অল্প সময়ে মূল্যবান খবরাখবর আদান-প্রদান করা যায়। টেলিফোনের তার-বৈদ্যুতিক তারের কভার, বাস, ট্যাক্সি, সাইকেল প্রভৃতি বিভিন্ন যানবাহনের টিউব-টায়ারের মতোন অতি মূল্যবান ও অতি প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো রাবার দিয়ে তৈরি করা হয়। রাবার গাছের রস থেকে রাবার প্রস্তুত করা হয়। প্রায় পঞ্চাশ হাজার জিনিস রাবার দিয়ে তৈরি করা হয়। চট্টগ্রাম, সিলেট, এবং ৩ পার্বত্য জেলার বিভিন্ন জায়গায় রাবার গাছের বাগান আছে। আর বাংলাদেশে রাবার চাষের ভবিষ্যৎও কিন্তু খুবই উজ্জ্বল।

আমরা শ্বাস-প্রশ্বাসের সময় অক্সিজেন গ্রহণ করি আর কার্বন-ডাইঅক্সাইড ত্যাগ করি। অক্সিজেন ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। প্রাণিজগৎ সবসময়ই নিঃশ্বাসের মাধ্যমে বায়ুমণ্ডল থেকে বিপুল পরিমাণ অক্সিজেন গ্রহণ করছে। এমনিভাবে বায়ুর অক্সিজেন গ্রহণ করতে থাকলে অল্পদিনের মধ্যেই বায়ুমণ্ডলের অক্সিজেন শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, হাজার হাজার বছরেও বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেয়নি। এর প্রধান কারণ হল সবুজ গাছপালা।

সবুজ গাছপালা সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শর্করাজাতীয় খাদ্য প্রস্তুত করে থাকে। এ প্রক্রিয়ায় সবুজ উদ্ভিদ বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন-ডাইঅক্সাইড গ্রহণ করে এবং বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেন গ্যাস ত্যাগ করে। প্রাণিজগৎ শ্বাসপ্রশ্বাসের সময় বায়ুমণ্ডল থেকে যে পরিমাণ অক্সিজেন গ্রহণ করে, সবুজ উদ্ভিদ সালোকসংশ্লেষণের সময় অনেকটা সে পরিমাণেই অক্সিজেন বায়ুমণ্ডলে ত্যাগ করে। তাই বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেনের পরিমাণের তেমন কোনো তারতম্য ঘটে না।

তাছাড়া বায়ুমণ্ডলে কার্বন-ডাইঅক্সাইড গ্যাসও একটি সুনির্দিষ্ট মাত্রায় বিদ্যমান। কার্বন-ডাইঅক্সাইডের মাত্রা নির্দিষ্ট পরিমাণের চেয়ে বেশি হলে বায়ুমণ্ডল বিষাক্ত হয়ে যাবে। তখন বাতাসে আর নিঃশ্বাস নেওয়া যাবে না। প্রশ্বাসকালে আমরা বিপুল পরিমাণ কার্বন-ডাইঅক্সাইড ত্যাগ করি। কাজেই বায়ুমণ্ডলে কার্বন-ডাইঅক্সাইড বহু আগেই অনেক গুণ বেড়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। এর কারণও সবুজ উদ্ভিদ। সালোকসংশ্লেষণের সময় সবুজ উদ্ভিদ বিপুল পরিমাণ কার্বন-ডাইঅক্সাইড গ্যাস গ্রহণ করে। এ জন্যই বায়ুতে এই গ্যাসের পরিমাণ অপরিবর্তিত থাকে।

বৃষ্টিপাত না হলে ফসল ফলে না। বৃষ্টিপাতের উপরও সবুজ গাছপালার প্রভাব রয়েছে। গাছপালা যে পরিমাণ পানি মূল বা শিকড় দিয়ে মাটি থেকে শোষণ করে নেয়, তার বহুল পরিমাণ জলীয় বাষ্প আকারে পাতার রন্ধ্রপথে বের হয়ে যায়। পানি বের হয়ে যাওয়ার এ প্রক্রিয়াকে প্রস্বেদন বলে। প্রস্বেদন প্রক্রিয়ায় নির্গত জলীয় বাষ্পও উপরে গিয়ে ঘনীভূত হয় এবং মেঘ সৃষ্টিতে অবদান রাখে।

আমরা যে ময়লা-আবর্জনা এখানে-সেখানে স্তূপ করে রাখি, তা যদি পঁচে মাটির সঙ্গে মিশে না যেত, তবে কী হত? তখন পুরো পৃথিবীটাই আবর্জনায় ভরে যেত। কিন্তু তা হয় না। এর মূলেও রয়েছে উদ্ভিদের ভূমিকা। ব্যাক্টেরিয়াজাতীয় অসবুজ উদ্ভিদ এ সমস্ত আবর্জনার উপর বিশেষভাবে ক্রিয়া করে আবর্জনার স্ত‚পকে মাটি করে ফেলে। আর পৃথিবীকে আবর্জনামুক্ত রাখে।