সার্ডিনরা খুবই ছোট মাছ। তারা আর এর বিরুদ্ধে কী-ই বা করতে পারে! তারা তখন বড় মাছদের সাহায্য চাইল। তাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে সমুদ্রের সব মাছ বসে পড়ল সভায়। বড় মাছেরা ঠিক করল, ছোট মাছদের সহযোগিতা করতে হবে। যে কোনো মানুষ তাদের ধরতে এলেই তারা সার্ডিনদের সহযোগিতা করবে। ওই মানুষদের তাড়িয়ে দেবে।
একদিন এক বিরাট জাহাজ প্রচুর মাছ নিয়ে যাচ্ছিল। পথে ধাক্কা খেল এক ডুবো পাহাড়ের সঙ্গে। তখন আর কি, গেল জাহাজ ভেঙে। তারপর ডুবে গেল।
কাছে যে দ্বীপটি ছিল, তার নাম ম্যাগডালেন। কানাডার উত্তর-পূর্ব উপক‚লে অবস্থিত। দ্বীপে বিশাল একটা পাহাড়ও আছে। কিন্তু সাগরে ফেনা এত বেশি ছিল, জাহাজের লোকজন পাহাড়টি দেখতেই পায়নি। জাহাজ তো ডুবল। জাহাজের মালপত্র সব দ্বীপে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল। সন্ধ্যায় সমুদ্র শান্ত হয়ে এলে একটি ছোট্ট মেয়ে এল জাহাজটি দেখতে। সৈকতে সে দেখতে পেল, সার্ডিন মাছ ভর্তি একটি বাক্স পড়ে আছে। স্বাভাবিকভাবেই সে ভাবল, মাছগুলো খাওয়া-ই যাক।
সে বাক্সটি ভাঙার জন্য পাথরে আছাড় মারতে শুরু করল। কিন্তু বাক্সটি ভাঙল না। তখন সে গান গাইতে শুরু করল। ঠিক যেন করুণ সুরে বিলাপ করছে। ওই পাথরের নিচেই ছিল এক বিরাটাকার কালো চিংড়ি। এক দীর্ঘ সামুদ্রিক যুদ্ধ শেষ করে সে তখন গভীর ঘুমে মগ্ন। পাথরে বাক্স আছড়ানোর শব্দে ওর ঘুম গেল ভেঙে। আর ঘুম ভাঙার পরই সে শুনতে পেল মেয়েটির গান। গানে গানে সে সার্ডিন মাছগুলোর কথাই বলছিল।
শুনেই চিংড়িটির মনে পড়ল সেই মৎস্য-মহাসভার কথা। তাদের শপথের কথা। তখনই চিংড়ি স্থির করল, মেয়েটিকে শাস্তি দেবে সে। ও তখন আড়াল থেকে বের হয়ে এল। শান্ত ভাবে থাবা নেড়ে বাক্সটি খোলার অনুমতি চাইল। মেয়েটি যখনই বাক্সটি চিংড়ির সামনে ধরল, তখনই সে মেয়েটির হাত ধরে বসল। তারপর সাঁতরে চলে গেল গভীর সমুদ্রে।
তারপর কী হল? সবাই বলে, চিংড়িটি ওই মেয়েটিকে একজন মৎস্যমানবের কাছে বিক্রি করে দিয়েছিল। আর ধীরে ধীরে মেয়েটিও পরিণত হতে থাকে মৎস্যমানবে। আর কোনো দিনই সে ডাঙায় ফিরে আসেনি।
প্রত্যেক মে মাসের প্রথম দিন সে পানি থেকে উঠে এসে। আয়না দেখে। প্রতিবারই বোঝার চেষ্টা করে, সে মানুষ থেকে আরও কতটুকু মৎস্যমানবীতে পরিণত হয়েছে। তারপর সে তার লম্বা চুল আঁচড়ায়। ওই চুল এখন মুক্তোয় ভরা। তার বাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকে তৃষ্ণার্ত দৃষ্টিতে।
কোনো কোনো জ্যোৎস্না-ভরা রাতে জেলেরা তার অদ্ভুত বিলাপের সুরে গানও শুনতে পায়। পানির তরঙ্গে ভেসে ভেসে আসে। জেলেরা যখন ওই গান শোনে, তখন তারা আর পানিতে নামে না। কারণ তারা জানে, সে খুব একা। মেয়েটি বড় একা। তাই সে তাদের ধরে নিয়ে যেতে পারে সমুদ্রের নিচে। সমুদ্রের নিচে তার ঘরে তাদের নিয়ে গিয়ে হয়তো তার খেলার সঙ্গী বানাবে।
বিশ্ববিখ্যাত রূপকথার লেখক হান্স ক্রিশ্চিয়ান আন্দেরসেনের কল্পনায় মৎস্যকুমারী এসেছে এক বিচিত্র রূপে। তাঁর মতে, মৎস্যকুমারী চমৎকার সুন্দর একটি বালিকা। সমুদ্রের ওই মেয়ে চায় পার্থির মায়া মমতা এবং এক অমর আত্মা।
মৎস্যকুমারী নিয়ে এমন গল্প প্রচলিত আছে কানাডায়। শুধু কানাডা-ই না, ওদের নিয়ে গল্প প্রচলিত আছে সব দেশেই। থাকবেই-বা না কেন! এই মৎস্যকুমারী যে এক রহস্যময় চরিত্র। ওদের নিয়ে যেমন রহস্যের অন্ত নেই, অন্ত নেই ওদের ঘিরে মানুষের আগ্রহেরও।
হান্স ক্রিশ্চিয়ান আন্দেরসেনকে তো বলা যায় রূপকথার রাজ্যের রাজা। ডেনিশ এই শিশুসাহিত্যিক মৎস্যকুমারীদের নিয়ে কোনো গল্প লিখবেন না, তাও কি সম্ভব?
আন্দেরসেনের গল্পের ছোট্ট মৎস্যকুমারীর বয়স ছয় বছর। সমুদ্রের নিচের কোরাল দুর্গে সে বাস করে। ওই দুর্গের উপর বিশাল বিশাল ঝিনুকের স্তর। মুক্তোয় পরিপূর্ণ সেই ঝিনুকগুলো।
ওই মৎস্যকুমারী ওখানকার মাছেদের খুব ভালো বন্ধু। সে মাছেদের জন্য হাতে খাবার রেখে ঘুরে বেড়ায়। মাছেরা তার হাত থেকে খাবার খেয়ে যায়। মাছেরা তার এমনি পোষ মানা।
প্রায়ই সন্ধ্যায় ছোট্ট মৎস্যকুমারীর বড় পাঁচ বোন হাতে হাত ধরে সমুদ্রের উপর ভেসে ওঠে। গান গায়। মানুষের চেয়ে তাদের গানের গলা অনেক বেশি সুন্দর।
একদিন এক ভীষণ ঝড় উঠল। হঠাৎ দুর থেকে ভীষণ কোলাহল ভেসে আসল। তারা ভাবল, কোনো জাহাজ ডুবছে বুঝি। তক্ষুণি তারা ওইদিকে সাঁতরে গেল। গান গেয়ে গেয়ে নাবিকদের উদ্দেশে বলল, “কী সুন্দর সমুদ্রের নিচের জগৎ।” এমনি দুষ্টু ছিল তারা।
ছোট্ট মৎস্যকুমারী কিন্তু ওদের মতো না। সে মন খারাপ করে ঘরে একা একা বসে থাকত। মাঝেমধ্যে তার কেঁদে দিতে ইচ্ছে করত। কিন্তু সে কাঁদত না। কারণ মৎস্যকুমারীদের চোখে যে জল থাকে না।
সেই ছোট্ট মৎস্যকুমারী একদিন বড় হল। সেও এখন সমুদ্রের উপর ভেসে উঠতে পারে। একদিন এক জাহাজডুবি হলে সে গেল সেখানে। এক রাজকুমার ছিল সে জাহাজে। মৎস্যকুমারী তার জীবন বাঁচাল।
তারপর আর কি! রাজকুমারের সঙ্গে তার প্রীতির সম্পর্ক গড়ে উঠল। ঘরে ফিরে এসে তার আর কিছুই ভালো লাগে না। মন খুবই খারাপ হয়ে রইল। একদিন সে যাত্রা শুরু করল সমুদ্র ডাইনির ভয়ঙ্কর ঘরের দিকে। সেখানে গিয়ে সে তার আকাক্সক্ষার কথা বলল। রাজকুমারকে পাওয়ার জন্য সে সমুদ্রের জীবন ছেড়ে দিতেও রাজি হল।
কিন্তু কী আফশোষ! রাজপুত্র তাকে বিয়ে করল না। সে অন্যত্র বিয়ে করে ফেলল। হতভাগা মৎস্যকুমারী রাগে-দুঃখে-ক্ষোভে আর কী করে! সে ঠিক করল, ফেনায় পরিণত করবে নিজেকে।
সে ঠিকই নিজেকে ফেনায় পরিণত করছিল। ঠিক তখনই দৃশ্যপটে হাজির কয়েক জন দেবতা। তারাই বলে-কয়ে তাকে সে যাত্রা উদ্ধার করল।