বিশ্বের শীতলতম রাজধানী: পর্ব ২

এপিজি আর ইএজি আয়োজিত টাইপোলজি সম্মেলনে বাংলাদেশ থেকে মঙ্গোলিয়ায় এসেছি আমরা পাঁচজন। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আমি, জাফর, মামুন আর রব। সঙ্গে পুলিশের সিআইডি বিভাগের এসপি এ আর খান। আমাদের টিমে সিআইডি থেকে একজন অফিসার যোগ দিচ্ছেন শুনে প্রথমে একটু মন খারাপ করেছিলাম; ভেবেছিলাম তিনি পথে পথে গোয়েন্দাগিরি করে বেড়াবেন। আমরা হয়তো স্বাধীনভাবে কোন কাজই করতে পারব না। কিন্তু বিমানবন্দরেই বুঝে গেলাম, খান সাহেব ক্যাপ আর কালো গগল্স পরা সিনেমায় দেখা গোয়েন্দা নন। তিনি একান্তই বন্ধুবৎসল আর হৈ চৈ করার মানুষ।

>> মাহফুজুর রহমানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 Dec 2013, 10:38 AM
Updated : 5 Oct 2016, 11:53 PM

বাস থেকে নেমে সবাই ভাস্কর্যের দিকে দল বেঁধে এগিয়ে গেলাম। আমরা কয়েকজন মূল ভবনের বেশ কিছুটা দূর দিয়ে চক্কর দিতে শুরু করলাম। ভাস্কর্যের চারদিকে বিস্তীর্ণ পতিত জমি, লম্বা লম্বা ঘাসে ভর্তি। আমরা সে সব ঘাসের ভেতর লুকোচুরি খেলার মতো করে বসে ছবি উঠালাম। কমপ্লেক্স থেকে খানিকটা দূর দিয়ে চারদিকেই রয়েছে ঘের। ঘেরগুলো দূর থেকে দেখতেও বেশ চমৎকার। আমরা চটপট কিছু ছবি তুলে নিলাম।

এরপর আমরা মূল ভবনে ঢুকলাম। এখানে লিফটে চড়ে এবং বেশ কিছুটা পথ সিঁড়ি ডিঙিয়ে ঘোড়ার পিঠে চড়া যায়। পর্যটকরা অনায়াসে সেখানে চলে আসেন, চারদিকের দৃশ্য উপভোগ করেন। আছে একটা জাদুঘরও। তাতে আছে ব্রোঞ্জ যুগের নানা জিনিসপত্র। ভেতরে ঢুকতেই একটা কামান আর চামড়ার তৈরি বিশাল একটা জুতা।

আমরা অনেকের মতোই কামান আর জুতার পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুললাম। এরপর লিফটে চড়ে আর সিঁড়ি বেয়ে চলে এলাম ঘোড়ার পিঠে। সেখানে সম্মেলনের সবার সঙ্গেই দেখা হল। ছবিও তুললাম অনেক।

নিচে এসে ঘুরতে ঘুরতে এক পাশে দেখি, সেখানে যুদ্ধের পোশাক ভাড়া দেওয়া হয়। এক সেট পোশাকের ভাড়া আড়াই হাজার টুগ্রিক। (মঙ্গোলিয়ার মুদ্রার নাম এমএনটি বা মঙ্গোলিয়ান টুগ্রিক।) এখানকার ডাকঘরে ডলার বিনিময় করা যায়। ১ আমেরিকান ডলারের বিনিময়ে পাওয়া যায় ১,৬০০ এমএনটি। অর্থাৎ এসব পোশাকের ভাড়া দাঁড়ায় ১২৫ টাকার মতো। খুব একটা বেশি নয়।

এখানে বিভিন্ন রকমের পোশাক আছে-- পুরুষ সৈনিকের পোশাক, মহিলা সৈনিকের পোশাক, রাজার পোশাক, রাণীর পোশাক, রাজকর্মচারীর পোশাক।

আমি এক সেট যোদ্ধাদের পোশাক ভাড়া নিলাম। সঙ্গে সঙ্গে একজন ভদ্রলোক এসে যত্নের সঙ্গে আমার গায়ে পোশাক পরিয়ে দিলেন। তারপর মাথায় হেলমেট পরিয়ে হাতে ধরিয়ে দিলেন বর্শা। আমি পুরোপুরি মধ্যযুগের যোদ্ধা সেজে গেলাম।

তারপর আমি দৃপ্ত পদক্ষেপে হাঁটতে লাগলাম। ভাবখানা এমন, যেন সত্যিই কোন যুদ্ধের ময়দানে যাচ্ছি। কিছুটা সামনে গিয়ে দেখি, ভিয়েতনামের হাং সেজেগুজে যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে তরবারি হাতে অপেক্ষা করছে। তার সঙ্গে আরেক ভদ্রলোক, রাজকর্মচারীর পোশাক গায়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি অন্যদিকে যাচ্ছিলাম, কিন্তু হাং আমাকে ডাক দিল, তাদের সঙ্গে যোগ দিতে। আমি হাং-য়ের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। বেশ কিছু ছবি তোলার পর হাং-য়ের পাশের রাজকর্মচারী ভদ্রলোক অন্যদিকে চলে গেলেন। হাং এবার আমার দিকে তরবারি উঁচু করে দাঁড়াল। মধ্যযুগে এরকম তরবারি উঁচু করে দাঁড়ানো নারী দেখলে যে কেউ ভয়ে আঁৎকে উঠত। আমি অবশ্য ভয় পাইনি; হাং তরবারি উঁচু করে ধরেছে বটে, কিন্তু হাসি চাপতে পারেনি। খিলখিল করে হাসছিল ও। মিনিটখানেক যুদ্ধ হল আমাদের। আমি বর্শা দিয়ে হাং-য়ের আঘাতগুলো ফিরিয়ে দিচ্ছিলাম। এক পর্যায়ে হাং তরবারি চালনা থামিয়ে বলল, “তুমি আমাকে জিতেছ। এবার আমাকে নিয়ে চল তোমার দেশে।”

হাং এগিয়ে এসে আমার পাশে এসে দাঁড়াল। তারপর আমরা ছোটবেলার বন্ধুদের মতো পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করলাম। আমাদের দুজনের মুখেই হাসি। কিছুক্ষণ পর মূল ভবনের দিকে গিয়ে দেখি, আরও কিছু ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলা নানা ধরণের পোশাক পরে সারিবদ্ধ হয়ে ছবি তুলছেন। আমি ওদিকে যেতেই তাঁরা আমাকে ডেকে নিলেন। আমি ওদের সঙ্গে দাঁড়িয়েও অনেকগুলো ছবি তুললাম। তারপর পোশাক ফিরিয়ে দিয়ে এসে স্যুভেনির শপে ঢুকলাম।

পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতোই এ দেশেও পর্যটন কেন্দ্রের স্যুভেনির শপে জিনিসপত্রের দাম খুব বেশি। কিন্তু মঙ্গোলিয়া আসার স্মৃতি তো অম্লান করে রাখতে হবে। কাজেই চামড়ার তৈরি তীরন্দাজের ব্যাগ, একটি ছোট্ট ঘের, আদ্যিকালে ব্যবহৃত টুপি ইত্যাদি কিনে নিলাম। পরে বাইরে বেরিয়ে এলাম। পশ্চিম-আকাশে সূর্য ততক্ষণে হেলে পড়েছে।

কমপ্লেক্সের সামনে অনেকটা খোলা জায়গা, পাকা করা। সেখানে গিয়ে আবারও বিভিন্ন দেশের মানুষের সঙ্গে ছবি তুলতে লেগে গেলাম। রব, জাফর, মামুন, এ আর খান, মেহমুদ হোসেন, ফারুক মঈনউদ্দীন-- সবাই খুশিতে হৈচৈ করছেন।

এক সময় আমাদের বাসে ওঠার সময় হয়ে গেল। আমরা সবাই বাসে চড়ে বসলাম। সারিবদ্ধভাবে বাসগুলো এবার উল্টো দিকে যাত্রা শুরু করল, উলান বাটরের পথে। আসার পথেও আমরা অনেক হৈচৈ করলাম।

সন্ধ্যার বেশ কিছুক্ষণ পর আমরা উলান বাটর এসে পৌঁছলাম। শহরে তখন শীত বেশ জাঁকিয়ে বসেছে। আমরা মাফলার আর ওভারকোট ভাল করে জড়িয়ে পা চালালাম আমাদের হোটেলের দিকে।

পরদিন কিছুটা বেলা করেই আমরা ঘুম থেকে উঠলাম। আজ শনিবার। মঙ্গোলিয়ায় আজই আমাদের শেষদিন।

রাত এগারটায় মঙ্গোলিয়ান এয়ারলাইনসের একটি বিমানে করে আমরা চীনের বেইজিংয়ের উদ্দেশে রওনা হব। তাই আজ সবাই মিলে উলান বাটর শহরটা ভাল করে ঘুরে দেখতে বেরুব।

আমরা নাস্তা খেয়ে, সকাল এগারটার দিকে রাস্তায় নামলাম। প্রথমে গেলাম প্রধান ডাকঘরে।

বাংলাদেশের জিপিও বা সাধারণ ডাকঘরের সাথে এখানকার ডাকঘরের অনেক পার্থক্য দেখতে পেলাম। এটাকে ডাকঘর না বলে মিনি ফাইন্যান্সিয়াল সেন্টারও বলা যেতে পারে। এখানে বৈদেশিক মুদ্রা ভাঙানো যায়, ফ্যাক্স ও ই-মেইল করা যায়, কফি খাওয়া যায়, খাতা-কলম কেনা যায়, রং-বেরংয়ের পোস্টকার্ড কেনা যায়, ডাকটিকিট কেনা আর পোস্ট করা যায়।

আমি এদিক ওদিক একটু ঘুরে ঘুরে দেখলাম। তারপর সাড়ে দশ হাজার এমএনটি দিয়ে একটা সুন্দর পোস্টকার্ড কিনলাম। তাতে লিখলাম:

“বিশ্বের শীতলতম রাজধানী শহরে এসেও আমি মুহূর্তের জন্যে তোমাকে ভুলিনি। আমাদের অকৃত্রিম এই ভালবাসার বন্ধন চিরস্থায়ী হোক-- এই প্রত্যাশাসহ

মাহফুজ

উলানবাটার

মঙ্গোলিয়া

২৯.০৯.২০১৩”

আমি যখন চিঠিটি লিখছিলাম, মেহমুদ হোসেন এবং এ আর খানসহ অন্যান্য সবাই খুব হৈচৈ করছিল। আমি পোস্টকার্ডে কথা কটি লিখে সেখানেই ডাকবাক্সে ফেলে দিলাম। চিঠিটি যার উদ্দেশ্যে লেখা, বাংলাদেশে বসে তিনি যখন চিঠিটি পাবেন, তখন তার কেমন লাগবে, ভাবতেই অনেক ভাল লাগছিল।

ডাকঘর থেকে একটা পর্যটন ম্যাপ নিয়ে আমরা বেরিয়ে এলাম। এবার ম্যাপটি হাতে নিয়ে আমরা এগোচ্ছি। হোটেল কর্তৃপক্ষ আমাদের বলে দিয়েছে যে, এখানকার সবগুলো দর্শনীয় স্থাপনাগুলোই কাছাকাছি। একটা থেকে আরেকটার হাঁটা পথের দূরত্ব। সময় লাগে বড়জোর ১০ থেকে ১৫ মিনিট।

ম্যাপ দেখে দেখে প্রথমেই আমরা গেলাম মঙ্গোলিয়ার ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে। এই জাদুঘরটি অনেক সুন্দর। বাইরে একটি বড় ঘের, কামান এবং আরও অনেক ঐতিহ্যবাহী জিনিসপত্র দিয়ে সাজানো। আমরা জাদুঘরে ঢুকে প্রথমে ওভারকোট জমা দিলাম। তারপর কাউন্টার থেকে টিকিট কিনলাম।

জাদুঘরের প্রতিটি তলাই বেশ উঁচু, সুন্দর করে সাজানো। প্রাচীন সকল ঐতিহ্য ধারণ করে আছে এই জাদুঘর। চেঙ্গিস খান, কুবলাই খানসহ অনেক খান-এর ছবি আছে এখানে। তাদের ব্যবহৃত যুদ্ধ সরঞ্জামাদিও আছে। বড়সড় একটা ঘের-ও বানিয়ে রাখা হয়েছে, দর্শনার্থীদের জন্য। আরও আছে পুরনো আমলের ব্যবহার্য বহু সামগ্রী।

প্রতিটি ফ্লোরই আমরা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। এক জায়গায় মানচিত্রে দেখানো আছে, মঙ্গোলিয়রা বিশ্বের কোন কোন দেশ জয় করেছিল।

প্রায় ঘণ্টা দুয়েক পরে আমরা যখন জাদুঘর থেকে বেরিয়ে এলাম, তখন বাইরে ভীষণ হৈচৈ চলছে। স্থানীয় একটি প্রাইমারি স্কুলের অনেকগুলো ছেলেমেয়ে এসেছে। ওরাই চিৎকার চেঁচামেচি করে জাদুঘর মাথায় তুলেছে আরকি! প্রথমেই ওদের সঙ্গে মিশে গেলেন এ আর খান। তিনি মুখে মিষ্টি হাসি ঝুলিয়ে ওদের সাথে ছবি তুলতে লাগলেন। তারপর এগিয়ে গেলেন ফারুক মঈনউদ্দীন। এভাবে একে একে প্রায় সবাই বিগলিত হাস্যোজ্জ্বল মুখে ছবি তোলার লাইনে দাঁড়িয়ে গেলেন। আমিও তাদের সাথে যোগ দিলাম।

আমি পকেট থেকে অনেকগুলো বাংলাদেশি দুই টাকার নোট বের করে সবাইকে একটা করে দিতে শুরু করলাম; আমার দেশের স্মারক উপহার। এবার সবার হাত চলে এল আমার দিকে। শিশুরা খুবই আনন্দের সঙ্গে আমার কাছ থেকে নোট নিল। এ সময় তিনজন ছেলেমেয়ে রাস্তার ওপাড়ে ছিল। বন্ধুদের কিছু একটা দেয়া হচ্ছে-- দেখেই ওরা উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে রাস্তা পার হল। আমি তাদেরকেও নোট দিলাম।

একটি ছেলে নোটটি হাতে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ছবি দেখছিল। শেষ পর্যন্ত কৌত‚হল সামলাতে না পেরে জিজ্ঞেস করেই বসল, “এটা কার ছবি?”

ভিয়েতনামেও একই কাণ্ড হয়েছিল। সেখানেও আমি একটি রেষ্টুরেন্টে শিশুদের হাতে নতুন নোট তুলে দিয়েছিলাম। তখন একটি ছেলে বলেছিল, “বুঝেছি; এ ছবিটি হলো তোমাদের দেশের হো চি মিন-এর।”

আমি এখানেও তেমনই জবাব দিলাম, “এটা আমাদের দেশের চেঙ্গিস খানের ছবি।”

আমরা এবার অন্য একটি জাদুঘরের দিকে এগোলাম। ম্যাপ দেখে দেখে মিনিট দশেকের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম সেখানে। কিন্তু বিধি বাম, জাদুঘরটি বন্ধ।

বাইরে মঙ্গোলীয় ভাষায় কিছু একটা লেখা আছে। ভাবসাব দেখে মনে হল, সংস্কার কাজ চলছে।

আমরা এবার পুবদিকে হাঁটা শুরু করলাম। এদিকে একটা বৌদ্ধবিহার আছে। ম্যাপে দূরত্ব দেখে মনে হল, কুড়ি মিনিটের মতো হাঁটতে হবে। দু-একজনকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল, সোজা রাস্তা ধরে গেলেই পাওয়া যাবে।

আমরা হাঁটতে শুরু করলাম। কিন্তু হাঁটার কাজটা কোনো ভাবেই এগুচ্ছে না। কারণ রাস্তার পাশে নানা ধরনের দোকান। একেক জন একেকটার ভেতর টুক করে ঢুকে পড়ছে, আর তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ পর হয়তো এই ভদ্রলোক বেশ কটি প্যাকেট হাতে নিয়ে বেরুলেন। কিন্তু এবার অন্য দুজনকে পাওয়া যাচ্ছে না।

এভাবে প্রায় ঘণ্টাখানেক পর, প্রায় সবারই পকেট কিছুটা খালি হয়ে গেলে, তাদেরকে একত্রে পাওয়া গেল। তখন আমরা আবার হাঁটতে শুরু করলাম। মিনিট কুড়ি হাঁটার পর বিশাল একটা চৌরাস্তার দেখা মিলল। আবারও একই কথা, আর মাত্র কয়েক মিনিট হাঁটলেই বৌদ্ধমন্দিরে পৌঁছান যাবে।

সোজা রাস্তা ধরে আমরা আরও কিছুক্ষণ হাঁটলাম। এর মধ্যেই কয়েক জন পরিব্রাজক ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। তারা খুব ধীরগতিতে হাঁটছেন, আর বারবার বোঝাতে চাচ্ছেন যে, এ সব বৌদ্ধবিহারে কোনো কিছু দেখার নেই। সুতরাং আমাদের এখুনি ফিরে যাওয়া উচিত।

আমাদের কয়েকজনের বিপুল আগ্রহে আমরা সবাইকে নিয়ে রাস্তার শেষপ্রান্তে পৌঁছে গেলাম। এবার ম্যাপ দেখে আমরাও একটু ঘাবড়ে গেলাম। রাস্তাটা ক্রমশ উঁচু হয়ে ডানদিকে চলে গেছে। আমরা সবাই ক্লান্ত, এ অবস্থায় হেঁটে চড়াই ওঠা সবার জন্যই কষ্টকর হয়ে যাবে।

মোড়ে এসে কয়েকজন পথের পাশের রেলিংয়ে বসে পড়লেন। তখন ফারুক মঈনউদ্দীন একটা ভাল বুদ্ধি বাতলালেন, “যারা বেশি ক্লান্ত, তারা এখান থেকে ফিরে যান। কাছাকাছি পথের পাশে যে ফ্যাশন পণ্যের বাজারটা দেখে এসেছি, তাতে গিয়ে অপেক্ষা করুন। আর আমরা যারা যেতে চাই তারা একটু ঘুরে আসি। এসে আপনাদেরকে সব বর্ণনা দিয়ে দেব।”

ফারুকের কথা শুনে তারা যেন হালে পানি পেলেন। ফজলে রশিদ, মেহমুদ হোসেন এবং এ আর খান ফিরে চললেন ফ্যাশান বাজারে। আর আমরা, অর্থাৎ আমি, জাফর, রব, মামুন আর ফারুক মঈনউদ্দীন ডানদিকে মোড় নিয়ে গাইতে শুরু করলাম-- ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চল রে।’

এবার একটি সরু রাস্তা। আমরা এ রাস্তাটি ধরে এগোতে এগোতে বৌদ্ধবিহারের গেটে চলে এলাম। বিহারে ঢুকে দেখলাম, চমৎকার একটা ধর্মকেন্দ্র। দূরে একটি বিরাট মন্দির। সীমানা প্রাচীরের কাছ দিয়ে অনেকগুলো পূজারিদের আবাস। আর মাঠের ভেতরে ভেতরে পর্যটকদের জন্য নানা সামগ্রী। সামনেই পেতলের তৈরি বিশাল আকারের একটি জুতো। এ জুতোর উপর অনেকেই বসে বিশ্রাম নেন, অনেকে বসে ছবি তোলেন। আমরা বিভিন্ন জায়গায় দাঁড়িয়ে-বসে ছবি তুললাম। তারপর মন্দিরের ভেতরটা দেখতে গেলাম।

সেখানে খুব রাগী-রাগী চেহারার কয়েকজন দারোয়ান, কড়া নজরে তাকিয়ে আছে দর্শনার্থীদের দিকে। আমরা কিছুটা দ্বিধা নিয়ে আস্তে আস্তে ঢুকছি। আমাদের দিকে তাকিয়ে ওরা সন্দেহজনক কিছু আছে কিনা, খোঁজার চেষ্টা করছে। আমরাও কিছুটা বিব্রত। এখান থেকে যদি বের করে দেয়, তাহলে অপমানের আর শেষ থাকবে না। হঠাৎ দেখি আমাদের ফারুক মঈনউদ্দীন বৌদ্ধ মূর্তিটির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে দুহাত একত্রে মিলিয়ে কুর্ণিশ করতে করতে বলছেন, “বুদ্ধনং শরনং গোস্বামী।”

তাকিয়ে দেখলাম, দারোয়ানরা অত্যন্ত আনন্দচিত্তে ফারুকের দিকে তাকাচ্ছে। আমরাও যা দেখার দেখে নিয়ে, দ্রুত বেরিয়ে এলাম। কিছুক্ষণ পর ফারুকও বেরিয়ে এলেন।

বাইরে এসে দেখি, দুটো সদ্য বিবাহিত দম্পতি সপরিবারে ছবি তোলার জন্যে এখানে এসেছে। এ বিষয়টি আমি শ্রীলংকায়ও দেখেছি। নববধু পাতলা ফিনফিনে সাদা কাপড়ের তৈরি সুন্দর পোশাক পরে হাতে এক তোড়া ফুল নিয়ে ফুরফুরে হৃদয়ে ঘুরে বেড়ায়। তার পাশে থাকে স্যুট পরিহিত বর। এ ছাড়াও বন্ধু-আত্মীয়দের অনেকেই থাকেন। ওরা এখানে ওখানে প্রজাপতির মতো ঘুরে ঘুরে বেড়ায় আর ছবি তোলে। এখানেও এমনটিই হচ্ছে। পরিবার পরিজন নিয়ে এরা এসেছে ধর্মকেন্দ্রে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য। আর সে উপলক্ষ্যে ছবিও তোলা হচ্ছে।

ওদেরকে দেখতে দেখতে কখন যে ওদের মিছিলে আমরাও ঢুকে গেলাম, টেরও পেলাম না। এক সময় আমরা লক্ষ্য করলাম, আমরা ওদের পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছি। এখানে আমরা অনেকগুলো ছবি তুলে নবদম্পতিদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এগোলাম। এমন সময় আমাদের সামনে একজন হকার পুরনো আমলের কয়েন এগিয়ে দিল।

আমি এবং আমার ছোট দুই মেয়ে অর্থী আর শ্রেয়া বিদেশের মুদ্রা সংগ্রহ করি। এই ভদ্রলোকের হাতে দুষ্প্রাপ্য কিছু মুদ্রা দেখে আমার খুব লোভ হল। আমি আমার নিজের জন্য এক সেট এবং বাংরাদেশ ব্যাংকের ‘টাকা জাদুঘর’-এর জন্য এক সেট মুদ্রা কিনলাম।

মঙ্গোলিয়ায় বর্তমানে কোনো মুদ্রা চালু নেই। এই মুদ্রাগুলো অনেক আগে এ দেশে চালু ছিল। মুদ্রা কেনার পর আমরা বৌদ্ধবিহার থেকে বের হয়ে এলাম। এবার আগের রাস্তা দিয়ে না গিয়ে আমরা সোজা হাঁটতে শুরু করলাম। এখানে কয়েকটি স্যুভেনিরের দোকান আছে। আমি একটা দোকানে ঢুকে দুটো মুখোশ কিনে নিলাম। তারপর আবার মিনিট দুয়েক হেঁটেই সেই রাস্তায় চলে এলাম, যেখান থেকে আমাদের তিনজন অভিযাত্রী ব্যর্থতার তিলক কপালে নিয়ে ফিরে গিয়েছিলেন। আর আমরা অহেতুক রাস্তা চিনি না বলে অনেকদূর উর্ধ্বমুখি ঢালু রাস্তা পেরিয়ে গিয়েছিলাম বৌদ্ধমন্দিরে।

এবার আমরা সবাই মিলে হোটেলে ফিরে এলাম। আসার পথে খেয়ে নিলাম দুপুরের খাবার। হোটেলে ফিরে সবাই এক রুমে জড় হয়ে শুরু করলাম জম্পেশ আড্ডা। কনফারেন্সের আয়োজক সংস্থা আমাদের রাত আটটায় এ হোটেল থেকে তুলে নিয়ে যাবে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে। হাতে এখনও অনেকটা সময় আছে। আড্ডার বিষয় মঙ্গোলিয়া থেকে মরিশাস হয়ে বাংলাদেশের মাছরাঙ্গার চরিত্র-- কোনটা বাদ পড়েছে তা থেকে!

আমাদের সেই সুখের আড্ডারও এক সময় সমাপ্তি ঘটল। আমাদের ব্যাগ নিয়ে উঠতে হল বাসে। অনেক সুখস্মৃতি মাথায় নিয়ে আমরা যখন মঙ্গোলিয়ান এয়ারলাইন্সের ডানায় ভর দিয়ে আকাশে উঠে এলাম, তখন রাত ১১টা।

বিদায় উলানবাটর, বিদায় মঙ্গোলিয়া।