আমাদের স্বাধীনতা দিবস

বলো তো, আমাদের স্বাধীনতা দিবস কবে? নাহ্, প্রশ্নটা বড্ডো বেশি সোজা হয়ে গেলো! তোমরা সব্বাই জানো- ২৬ মার্চ। এই দিনেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছিলো। কিন্তু কীভাবে সেই ঘোষণা দেয়া হয়েছিল, তা জানো কি? আজ তাহলে সে গল্পই শোনা যাক।

>>বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 March 2013, 05:14 AM
Updated : 25 March 2013, 05:14 AM
স্বাধীনতার আগের ঘটনাগুলো তো তোমরা জানোই; যা ছিল সব পাকিস্তানিদের অত্যাচার নিপীড়ন আর প্রবঞ্চনার গল্প। আর তারপর, বাঙালিদের ‘শায়েস্তা’ করার জন্য ওরা এক জঘন্য পরিকল্পনা করলো। ওদের পরিকল্পনা ছিল ভয়ঙ্কর, রাতের আঁধারে হামলে পড়ে আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতা আর প্রতিবাদী মানুষগুলোকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছিলো। সে কাপুরুষোচিত পরিকল্পনা তারা বাস্তবায়নও করেছিল। ইতিহাসের জঘন্যতম এই হামলার আবার একটা গালভরা নামও দিয়েছিলো ওরা- ‘অপারেশন সার্চলাইট’! এই অপারেশন সার্চলাইটের গল্প কিন্তু তোমাদের একবার শুনিয়েছি। পড়োনি বুঝি? আচ্ছা, লিঙ্ক দিয়ে দিচ্ছি, পড়ে নাও-

অপারেশন সার্চলাইট (http://kidz.bdnews24.com/mainStory.php?mainstoryid=147)

ওরা শুধু জঘন্য এই হত্যাকাণ্ড চালিয়েই সন্তুষ্ট হয়নি, এই হত্যাকাণ্ডের খবর যাতে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে না পৌঁছায়, সে ব্যবস্থাও করে। অপারেশন সার্চলাইটের মূল টার্গেট ছিল ঢাকা। আর তাই, ২৫ মার্চের আগেই ঢাকায় অবস্থানরত সব বিদেশী সাংবাদিককে ঢাকার বাইরে পাঠানোর ব্যবস্থা করে। ঢাকার সঙ্গে সারা দেশের যোগাযোগও দেয় বন্ধ করে। যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ করে দেয়া হয় বিদেশের সঙ্গেও। যদিও হত্যাযজ্ঞের মূল কেন্দ্র ছিল ঢাকা, তবু এ হত্যাযজ্ঞ চলে সারা দেশজুড়েই। বিশেষ করে ঢাকার ধানমন্ডি, পুরানো ঢাকা আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো ছিল পাকবাহিনীর বিশেষ টার্গেট। সেখানে হিন্দু ছাত্রদের জন্য যে আবাসিক হলটি ছিল, মানে জগন্নাথ হল, সেটি প্রায় ধ্বংসই করে দেয় ওরা।

অপারেশন সার্চলাইট ছিল একটি সামরিক পরিকল্পনা। তাতে শুধু হত্যাযজ্ঞই চালানো হয়নি, বরং পরিকল্পনা ছিল, বাঙালিদের সম্পূর্ণভাবে দমন করা। আর সে পরিকল্পনার কতোগুলো নির্দিষ্ট লক্ষ্যও ঠিক করা ছিল। সেগুলো তারা বাস্তবায়নও করেছিল। ওরা ভেবেছিল, এভাবে বাঙালিদের ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে দিতে পারবে। কিন্তু ফল হলো ঠিক উল্টো; বীর বাঙালি জেগে উঠলো। শ্লোগান ধরলো- ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো/ বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘তোমার আমার ঠিকানা/ পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘তুমি কে আমি কে/ বাঙালি-বাঙালি’, ‘জয় বাংলা’। শুরু করলো মরণপণ লড়াই, শুরু হলো আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ। আর নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষ হয়, পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণ আর বাংলাদেশের অভ্যূদয়ের মধ্য দিয়ে।

সে যা হোক, আমাদের আজকের গল্প তো স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে, তাই তো? অপারেশন সার্চলাইটের অংশ ছিল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ আওয়ামী লীগে সেসময়ের শীর্ষ ১৫ নেতাকে গ্রেপ্তার করা। শেখ মুজিবুর রহমানকে তারা গ্রেপ্তার করলোও বটে (রাত দেড়টার দিকে), তার আগে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাও দিয়ে দিলেন। ঘোষণাটি অবশ্য প্রকাশ্যে দিতে পারেননি, এক টেলিগ্রাম বার্তায় পাঠিয়ে দেন চট্টগ্রামের ইস্ট পাকিস্তান রেজিমেন্টে (বর্তমানে বিজিবি)। ঘোষণার শেষে তার স্বাক্ষরও ছিল। ঘোষণাটি পড়ে নাও এবার-

Today Bangladesh is a sovereign and independent country. On Thursday night, West Pakistani armed forces suddenly attacked the police barracks at Razarbagh and the EPR headquarters at Pilkhana in Dhaka. Many innocent and unarmed have been killed in Dhaka city and other places of Bangladesh. Violent clashes between E.P.R. and Police on the one hand and the armed forces of Pakistan on the other, are going on. The Bengalis are fighting the enemy with great courage for an independent Bangladesh. May Allah aid us in our fight for freedom. Joy Bangla.

(ঘোষণাটি জ্যোতি সেন গুপ্ত রচিত History of Freedom Movement in Bangladesh, 1943-1973 : Some Involvement বই থেকে নেয়া হয়েছে।)

টেলিগ্রামটি চট্টগ্রামের কিছু শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছায়। ঘোষণাটি বাংলায় অনুবাদ করেন বিশিষ্ট ভাষাতত্ত্ববিদ ড. মঞ্জুলা আনোয়ার। পরে তারা চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে অবস্থিত রেডিও পাকিস্তানের ট্রান্সমিটার থেকে, ঘোষণাটি প্রচারের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করেন। কিন্তু ভাগ্য খারাপ; সেটা করা গেলোনা। তখন, বেলাল মোহাম্মদ, আবুল কাসেমসহ চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের কয়েকজন কর্মকর্তা ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান ঘোষণাটি মাইকিং করে প্রচার করা শুরু করেন।

মাইকিং তো শুরু হলো। কিন্তু তাতে করে তো আর দেশ-বিদেশের সবাইকে জানানোর কোনো উপায় হলো না। তাহলে কী করা যায়? এবার তারা চলে গেলেন কালুরঘাটে। সেই সময়ে ওই অঞ্চলে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দায়িত্বে ছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান। তার সাহায্য নিয়ে, কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে ঘোষণাটি সম্প্রচারের ব্যবস্থা করা হলো। বাঙালি সৈন্যরা বাইরে থেকে বেতার কেন্দ্রটি পাহারা দিতে লাগলেন, আর ভেতরে ঘোষণা সম্প্রচারের জন্য সবকিছু রেডি করতে লাগলেন ইঞ্জিনিয়াররা।

২৭ মার্চ ১৯৭১। সন্ধ্যায় মেজর জিয়াউর রহমান কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। সেই ঘোষণাটির বর্ণনা দেয়া আছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ওয়েবসাইটে। সেখান থেকেই তোমাদেরকে সেই গল্পটা শোনাচ্ছি- ‘সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র হতে মেজর জিয়াউর রহমান ইংরেজিতে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। মেজর জিয়াউর রহমান বলেন, ‘আমাদের মহান জাতীয় নেতা এবং বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক শেখ মুজিবুর রহমান-এর পক্ষে আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি। আমি আরো ঘোষণা করছি যে শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের সাড়ে সাত কোটি জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের একমাত্র নেতা। আমি তাই আমাদের মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমান-এর পক্ষ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশ বিশেষভাবে পরাশক্তি-সমূহের কাছে এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর কাছে উদাত্ত আহবান জানাচ্ছি পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী পরিচালিত গণহত্যা বন্ধ করার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নিতে। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী দ্বারা আইনসম্মতভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যা দেয়া একটি নির্মম কৌতুক এবং এমন এক স্ববিরোধিতা যা কারো দৃষ্টি এড়াতে পারে না। আমাদের নতুন রাষ্ট্রের অনুসৃত নীতিমালা হচ্ছে- প্রথমত নিরপেক্ষতা, দ্বিতীয়ত শান্তি এবং তৃতীয়ত সবার প্রতি বন্ধুত্ব, কারো প্রতি বিদ্বেষ নয়। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। জয় বাংলা।’
কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের ট্রান্সমিটারের রেঞ্জ অবশ্য খুব একটা বেশি ছিল না। তাই সে ঘোষণাটিও দূর-দূরান্তর থেকে সব্বাই শুনতে পেয়েছে, এমনটা ঘটেওনি। তবে, ঠিক সেই সময়ে, একটা জাপানি জাহাজ বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করছিল। তারা কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের এই সম্প্রচারটি পায়। পরে ঘোষণাটি রেডিও অস্ট্রেলিয়ায় এবং ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন, মানে বিবিসিতেও প্রচার করা হয়।

আর তারপর? ওই যে বললাম, বাঙালিরা ভয় পাওয়ার পরিবর্তে উল্টো শ্লোগান ধরলো; সঙ্গে হাতে তুলে নিল অস্ত্র। বিপুল বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়লো মুক্তিযুদ্ধে। নভেম্বরের শেষে সে যুদ্ধে আমাদের সঙ্গে যোগ দিলো ভারতও। সব মিলিয়ে চরমপত্রের ভাষায়, মানে এম আর আখতার মুকুলের ভাষায়, পাকবাহিনী ‘এক্কেরে ক্যাদোর মইদ্দে হুইত্যা পড়লো’। মুক্তির পোলাদের ‘গাবুর মাইর’ তারা আর সহ্য করতে পারলো না। ফলাফল- আমাদের বিজয় দিবস; মানে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। ৯৩ হাজার সৈন্য সমেত পাকিস্তানি বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক জেনারেল এ এ কে নিয়াজি আত্মসমর্পণ করলেন। আমাদের বিজয়ের সেই ঐতিহাসিক দলিলে দুই পক্ষের স্বাক্ষরের মধ্যে দিয়ে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলো; বাংলাদেশ স্বাধীন হলো।

ভালো কথা, আমাদের বিজয়ের এই দলিলটির গল্পও কিন্তু তোমাদেরকে শুনিয়েছিলাম, মনে আছে তো? মনে না থাকলে, শিগগির পড়ে নাও; লেখাটির লিঙ্ক নিচে দিয়ে দিচ্ছি-

আমাদের বিজয়ের ঐতিহাসিক দলিল (http://kidz.bdnews24.com/mainStory.php?mainstoryid=222)

(তথ্যসমূহ জ্যোতি সেন গুপ্ত রচিত History of Freedom Movement in Bangladesh, 1943-1973 : Some Involvement বই থেকে নেয়া হয়েছে।)