প্রাণের মেলায় প্রাণের টানে

শুক্রবার শনিবার এই দুইদিন টুনুদের স্কুল ছুটি। নীলা, কাজল, সুদীপ্ত, বিলু, স্বাতী, বেলি, আরাফ সবাই

মাকসুদা আজীজবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 Feb 2017, 08:17 AM
Updated : 7 March 2017, 06:16 AM

এসেছে দাদাইর বাড়ি খেলতে। কিন্তু এসে দেখে এ কী কাণ্ড! দাদাই তার সব বই মাটিতে নামিয়ে রেখেছে! ওদের খেলার জায়গার সঙ্গেই দাদাইর পড়ার ঘর। ঘরের পুরো দেওয়াল জুড়ে দুই কপাটের আটটা দরজা। দরজাগুলো খুলে দিলে ঘরের দেওয়াল বলে আর কিছু থাকে না, শুধু দরজাগুলোর মধ্যের পিলার দেখা যায়। 

আজ সবগুলো দরজা খোলা। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে সব বই নিচে। একটা তাক এখনও খালি করা হয়নি সেটা দাদাই খালি করছেন। সবার মধ্যে টুনু দাদাইর বেশি ন্যাওটা, তার দাদাই প্রতি অধিকারও বেশি আবার রোয়াবও খাটে তারই বেশি। মাঠের মধ্যে বলটা ছুঁড়ে ফেলে তেড়েফুঁড়ে সে দাদাইর দুই কপাটের দরজায় অযথাই আঘাত করে বলল, হচ্ছে কী দাদাই? ধুলোর মধ্যে হুটোপুটি দিচ্ছো যে! ঠাণ্ডা লেগে কাশি হলে অবস্থাটা কী হবে জানা আছে তো? আবার তোমাকে গতবারের মতো হাসপাতালে নিয়ে রাখবে কিন্তু!

দাদাই চশমার উপর দিয়ে টুনুকে দেখে বললেন খুব খেপেছো টুনুবাবু? চলো কিছু নাস্তা-পানি খাই। এরপর ভিতরবাড়িতে পিঠার নির্দেশ দিয়ে বাচ্চাদের নিয়ে নরম রোদে হাত পা ছড়িয়ে বসে পরলেন।

দাদাইর এত কিছুই হয়নি ভাব দেখে টুনুর গা জ্বলে যাচ্ছিলো। নীলা টুনুকে শান্ত করতে বলল আচ্ছা দেখই না দাদাই কী করেন! ঠিকই গরমগরম খেজুরের রসে ভেজানো পিঠায় মুখ দিয়ে দাদাই বললেন সবাই আমাকে ঘিরে বসে পর আজ আমরা বই মেলার গল্প বলব।

সুদীপ্ত বলল, বইমেলা? মানে অমর একুশে বইমেলা? বাংলা একাডেমিতে হচ্ছে যে?

দাদাই হেসে বললেন, হ্যাঁরে দাদুভাই সেই মেলাই তবে এই মেলা হচ্ছে নয়। এই মেলাকে হওয়াতে হয়েছে। কত চেষ্টা কত সংগ্রাম তা কি আর বলতে!

টুনু গাল ফুলিয়ে বলল, খবরদার দাদাই বাজে বকো না। সুন্দরমতো বইমেলা শুধু হয়েছে কোনো ঝামেলা হয়নি এবছর আমি জানি।

বেলি ওর মাথায় একটা চাটি মেরে বলল, ধুর বোকা দাদাই মোটেই এই বছরের কথা বলেননি, দাদাই আজ আমাদের বইমেলার ইতিহাস বলবেন। তাই না দাদাই?

দাদাই বলে উঠলেন, ঠিক তাই। আয় রে বেলি তোর মাথায়ও একটা চাটি দেই তুই ছোট ভাইটাকে কথায় কথায় মারিস কেন রে?

বেলি বেণি দুলিয়ে হেসে টুনুকে জড়িয়ে ধরে বলল, কারণ ও তো একটা পুতুল।

টুনুর রাগ তখনও কমেনি সে বেশ রাগ গলাই বলল, কী বলবে জলদি বলো।

দাদাই আয়েস করে বসে শুরু করলেন, বই মেলার ইতিহাস ঠিক আমাদের বাংলাদেশের মতোই প্রাচীন।

দিপু বলে উঠে, বইমেলা কি তাহলে ১৯৫২ সাল থেকে হয়ে আসছে দাদাই?

দাদাই হেসে জবাব দেন, কথাটা তুই ভুল বলিসনি। বইমেলা যদিও শুরু হয়েছিল ১৯৭২ সাল থেকে তবে নিজেদের ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে, উন্নত করতে হলে সেটার চর্চা করতে হবে আর এই চর্চার জন্য বই লেখা, বই পড়া, সেটা নিয়ে আলোচনা করা, চর্চা করা এগুলো করা আবশ্যক। আর এর জন্য বইমেলার মতো বিরাট মিলন মেলার প্রয়োজন; এ ধারণা বাংলাদেশিদের সেই ১৯৫২ সালেই হয়ে গিয়েছিল যখন ভাষার দাবীতে তাদের গুলি খেয়ে মরতে হয়েছিল। তবে কি জানিস, দেশ স্বাধীনের আগে এরকম একটা মেলা করার উপায় ছিল না বলতে গেলে। বৈশাখী মেলা করতেও বেশ বেগ পেতে হতো। এদিকে দেশ স্বাধীনের ডামাডোলে সবাই এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলো।

তাহলে শুরু কীভাবে হলো দাদাই? অস্থির ভঙ্গিতে বলে উঠে কাজল।

’৪৭ থেকে ’৭১ এই সময়গুলো বড় সুন্দর ছিল রে। তখন সবাই জানত দেশের জন্য তাদের কিছু করার আছে। তাই কেউ কারও আশায় বসে থাকতো না। যে যার মতো কাজ করে যেত। মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রচুর মানুষ ভারতে শরণার্থী হয়। দেই দলে প্রচুর লেখক কবিও সাংবাদিক ছিলেন। এদিকে যুদ্ধের সময়ও দেশের মধ্যে মানুষ এদিক থেকে সেদিকে প্রাণ বাঁচিয়ে ফিরছিলেন। কেউ কেউ সম্মুখ যুদ্ধ করেছেন। সবারই বলার মতো অনেক কথা আছে।

চিত্তরঞ্জন সাহা একজন প্রকাশক। তিনি তখন স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ নামে একটি প্রকাশনী প্রতিষ্ঠা করেন। সেখান থেকে ভারতে বাংলাদেশী শরণার্থীদের লেখা কিছু বই ছাপান। ১৯৭২ সালে ৮ ফেব্রুয়ারি এরকম ৩২টি বই নিয়ে তিনি বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণে বর্ধমান হাউজের সামনে চট বিছিয়ে বসে পরেন। এটাই প্রথম বইমেলা।

বর্ধমান হাউজ মানে কি নজরুল মঞ্চের সঙ্গে সাদা বড় বাড়িটা? প্রশ্ন করে আরাফ।

মনে রাখিস এই বাড়ির ইতিহাস আরেকদিন বলব। হ্যাঁ সে বাড়িটাই। জবাব দেন দাদাই। এরপর কী হলো শোন। এটা ভাবার কোনোই কারণ নাই চিত্তরঞ্জন সাহা বসার সঙ্গে সঙ্গেই বইমেলা জমে গেলো। তখন মাত্র যুদ্ধ শেষ হয়েছে। মানুষের হাতে ভাত খাওয়ার টাকা নেই বই কেনার প্রশ্নই উঠে না। তার উপর শিক্ষার হারও কম, বই পড়বে কে? তবে চিত্তরঞ্জনও নাছোড় বান্দা। তোরা বিশ্বাস করবি না ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর সে এভাবেই একা সম্পূর্ণ একা বইমেলা চালিয়ে গেলেন। এরপর আস্তে আস্তে অন্যরা চিত্তরঞ্জনের সঙ্গে যুক্ত হলেন। ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক ছিলেন আশরাফ সিদ্দিকী। তার চেষ্টায় মেলাটি বাংলা একাডেমির সঙ্গে যুক্ত করা হলো। মেলাটি যেন বহুবছর পরেও সুন্দরভাবে পরিচালিত হতে পারে তাই ১৯৭৯ সালে চিত্তরঞ্জন সাহা বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশ সমিতি নামে একটি সংস্থাও প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু তখনও সেটা শুধুই বইমেলা ছিল। অমর একুশে গ্রন্থ মেলার ইতিহাস আরও পরের।

১৯৮৩তে এসে বইমেলাটা একটা আনুষ্ঠানিক রূপ পায়। তখন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কাজী মনজুরে মাওলা। তারা ঐকান্তিক চেষ্টায় বই মেলার আয়োজন করা হয়। প্রথমবারের মতো মেলাটি একটা নামও পায়, ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারিতে মাতৃভাষার দাবীর আন্দোলনের প্রতি সম্মান রেখে “অমর একুশে গ্রন্থমেলা” তবে এটা তো জানিসই শাসকগোষ্ঠীরা মধ্যে মধ্যেই স্বৈরাচারী হয়ে উঠে। দেশ স্বাধীন হলে কী হবে এদের থেকে মুক্তি পেতে আমাদের বেশ সময়ই লাগে। তো তখন ছিল এরশাদের আমল। সে সরকারের বিরুদ্ধে শিক্ষা ভবনের সামনে আন্দোলন করছিলো। সেই আন্দোলনে দুজন ছাত্র নিহত হন। এত গোলমালে সে বছর আর বইমেলা করা সম্ভব হয় না।

১৯৮৪ সালে আবার বইমেলা শুরু করা হয় প্রচুর উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে। এভাবে চলছে। এ বছরও শুরু হয়ে গিয়েছে। এখন তো এত প্রকাশক আর এত প্রকাশনী যে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে আর জায়গা হয় না। পাশে সোহরাওয়ার্দি উদ্যানেও স্টল বসাতে হচ্ছে।

দাদাই আমরা কবে বইমেলায় যাবো? জ্বলজ্বলে চোখে বলে উঠে টুনু।

তোরা চাইলে আজই। তবে তার আগে চলো দেখি দাদিরা বইগুলো গুছিয়ে ফেলি। নতুন বইয়ের জন্য জায়গা বানাতে হবে যে।

সবাই মিলে হই হই করতে করতে দাদাইর পড়ার ঘরে ঢুকলো। আজ দিন ভরে অনেক কাজ করতে হবে ওদের।