ঘড়ি চার্চের আঙ্গিনায়

ষড়ঋতুর বাংলাদেশের ঋতুচক্রের খেলায় এখন চলছে হেমন্তকাল। প্রকৃতির পালাবদলে এটি একটি সংযোগকারী ঋতু। না গরম, না ঠাণ্ডা।

শারমিন রেজওয়ানাবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Nov 2015, 01:13 PM
Updated : 12 Nov 2015, 02:42 PM

ভীষণ মিঠে একটা আবহাওয়া। হেমন্তের এই দিনগুলোতে প্রকৃতি কী সুন্দর ভাবে আস্তে আস্তে বদলাতে থাকে, তাই না? অবশ্য শহরে বসে সেটা তেমন টের পাওয়া না! যদি গ্রামে যেতে পারো, তবে বুঝবে কীভাবে হালকা কুয়াশা মাখা সকাল আর ঝুপ করে নেমে আসা সন্ধ্যেগুলো শীতের আগমন ঘণ্টা বাজায়! নিচু জমিগুলো থেকে বর্ষায় পানি ধীরে ধীরে নেমে গিয়ে সেখানটা ভরে যাচ্ছে সবুজ ঘাস আর বুনো গাছ। সকালে ঘাসের ডগায়, গাছের পাতায়, মাকড়সার জালে জমে থাকে বিন্দু বিন্দু শিশির-ঠিক যেন মুক্তোর দানা!

এই হেমন্তেই সভ্যতা আর ঐতিহ্য গ্রামে ওদের দাদু বাড়ি থেকে বেড়িয়ে এলো। সারাদিন এদিক সেদিক ঘুরে,বড়শিতে মাছ ধরে, মাঠে ঘুড়ি উড়িয়ে খুব জমজমাট মজা হলো কিছুদিন। ঢাকায় ফিরে তাই ওদের মন বেশি ভালো নেই। মনটা আটকা পরে আছে গ্রামের সেই অফুরন্ত আনন্দের মধ্যে। বিশেষ করে স্কুলের সাপ্তাহিক ছুটির দিনটা কিছুতেই কাটতে চাচ্ছে না আর। ওদের এমন মনমরা ভাব দেখে সেদিন ওদের বাবা আবীর সাহেব বললেন, কাল তো তোমাদের স্কুল নেই। ভোরে আমার সঙ্গে মর্নিং ওয়াকে যাবে, ঠিক আছে?

ওরা তো সঙ্গে সঙ্গে রাজি, কারণ মর্নিং ওয়াক নিয়ে আবীর সাহেবের একটা বিশেষ শখ আছে!  সময় এবং সুযোগ থাকলে তিনি নতুন নতুন জায়গায় প্রাতঃভ্রমণে যেতে ভালবাসেন। সেদিন ভোরে ওরা হাঁটতে গেলো বাহাদুর শাহ পার্কে।  যদিও কিছুদিন আগে নানা ভাইয়ের সঙ্গে সভ্যতা আর ঐতিহ্য এখানে এসেছিলো। তবে বাবার সঙ্গে আসার আকর্ষণটাও কম নয়। পার্কটায় বেশ কয়েকবার চক্কর দেওয়ার পরে ভিতরের নিচু রেলিং এর কাছে বসে ওরা বাসা থেকে নিয়ে আসা আদা কুঁচি দেওয়া ছোলা সেদ্ধ খাচ্ছিলো- বাবা বলেন, এটা নাকি খুব পুষ্টিকর খাবার! ততক্ষণে সূর্য গাছের ডালপালার ফাঁক ফোকর দিয়ে বেশ নরম একটা আলো ছড়িয়েছে চারিদিকে। পার্কে মানুষজনের সংখ্যাও বেড়েছে। উত্তর দিকে গাছের সবুজ ভেদ করে ধবধবে সাদা একটা গির্জার চূড়া দেখা যাচ্ছিলো- সেদিকে তাকিয়ে বাবা জিজ্ঞেস করলেন, এর আগে কি তোমরা ঐ গির্জাটা দেখতে গিয়েছিলে?

না বাবা, সেদিন নানা ভাইয়ের অন্য কাজ ছিলো বলে সময় হয়নি, চলো না আজ যাই- সভ্যতা  খুব আগ্রহ নিয়ে বাবার দিকে তাকালো।

ঐতিহ্যরও খুব যাবার ইচ্ছে, তবে একটু কিন্তু কিন্তু স্বরে সে বলল- এত সক্কাল বেলা কি আমাদের ঢুকতে দেবে গির্জায়?

-চলো গিয়েই দেখি না; বলে বাবা উঠে দাঁড়ালেন।

এরপর রাস্তা পার হয়ে কিছুদূর হেঁটে ওরা হাজির হলো গির্জায় প্রবেশদ্বারে। সেখানে একজন দারোয়ানকে বলতেই দিব্যি দরজা খুলে ভিতরে ঢুকতে দিল। গির্জার প্রাচীরের ধার ঘেঁষে বেশ কয়েকটা প্রাচীন কাঠ গোলাপের গাছ, নারকেল গাছ আর নাম না জানা বেশ কিছু বড় বড় গাছের বেষ্টনী, এরপর চৌকোনা একটা বাঁধানো চত্বরের এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে শ্বেত শুভ্র সেইন্ট থমাস চার্চ। অবশ্য ভিতরের দেয়ালে পাথরের ফলকে নাম লেখা আছে, ‘সাধু থোমার ক্যাথেড্রাল”!

ঐতিহ্য জিজ্ঞেস করলো- বাবা এই গির্জাটা কি অনেক পুরানো?

-হ্যাঁ, এটা ঢাকার প্রাচীনতম গির্জাগুলোর মধ্যে অন্যতম। তোমরা তো জানোই যে ‘গির্জা’ হচ্ছে খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের উপাসনার করার স্থান। বাংলায় খ্রিষ্ট ধর্মের প্রচার শুরু হয় কিন্তু পর্তুগিজদের মাধ্যমে, সেটা খ্রিষ্টাব্দ ষোল শতকের কথা। এরও প্রায় দু’শ বছর পরে ১৮১৯ সালে নির্মাণ করা হয়েছিলো এই গির্জাটা। সেই সময়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বেশ কিছু ইংরেজ কর্মচারী-কর্মকর্তারা এই অঞ্চলে বসবাস করতে শুরু করেন। মূলত: তাদের প্রার্থনার প্রয়োজনই গির্জাটি গড়ে তোলা হয়। আর সেইন্ট থমাস, যাকে বাংলায় সাধু থমাস বলা হয়- তিনি ভারতীয় উপমহাদেশে খ্রিস্টধর্ম প্রচার করেছিলেন, তাঁর নামানুসারে এর নামকরণ করা হয় ‘সেইন্ট থমাস গির্জা’। গির্জাটি প্রতিষ্ঠার দুই বছর পর কলকাতার বিশপ রোন্যাল্ড হারবার আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন। আর অদ্ভুত কথা কী জানো, নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজে লাগানো হয়েছিলো ঢাকা জেলের কয়েদীদের! যাই হোক, সেইন্ট থমাস চার্চ বা সাধু থোমার ক্যাথিড্রালকে অনেকে অংলিকান গির্জা, চার্চ অব বাংলাদেশ নামেও ডেকে থাকে।

এই গির্জার ধরণ আকার ইংল্যান্ডের সামসময়িক পল্লী এলাকার গির্জার মতোই, মানে একই রীতিতে বানানো। এক তলা গির্জার চারিদিকে উঁচু উঁচু সুচালো পাতা আকারের খিলানের মধ্যে বানানো হয়েছে কাঠের দরজা জানালা, এই নির্মাণ রীতিকে বলে ‘গথিক ডিজাইন’! ছাদের কার্নিশে খুব সুন্দর খাঁজকাটা নকশা- এটাকে বলে প্যারাপেট। তবে সবচেয়ে বেশি সুন্দর হলো চৌকোনা উঁচু টাওয়ারের উপর বসানো ঘড়িটি। এটা অবশ্য গির্জা নির্মাণের বেশ কয়েক বছর পরে, ১৮৬৩ সালে স্থাপন করা হয়। সেইন্ট থমাস চার্চের এই ঘড়িটি আর লন্ডনের হাউস অব পার্লামেন্টের চূড়ায় অবস্থিত ঘড়ি- দুটোই বিশ্ব বিখ্যাত ঘড়ি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ‘বিগ বেন’র নির্মিত। 

সেই সময়ের ঢাকাবাসীরা বিশাল ঘড়িতেই সময় দেখত। তবে ঘড়িটা এখন আর কাজ করছে না, বন্ধ হয়ে আছে।

বাবা জানালেন, সেইন্ট থমাস চার্চের ভেতরের হলঘরটাও নাকি খুব সুন্দর। প্রধান হলঘরের ছাদটা কাঠের স্তম্ভের উপর বানানো হয়েছে, স্তম্ভ গুলো আবার খাঁজকাটা। এছাড়া এখানে এখনও সেই উনিশ শতকের ভারী ভারী কাঠের আসবাব ব্যবহার করা হয়। আর রয়েছে বিশ শতকের শুরুর দিকের দু’ ব্লেডের লম্বা ডাটার ফ্যান এবং একটি পিয়ানো। ফ্যানগুলো নাকি এখনও সচল আছে তবে পিয়ানোটি নষ্ট হয়ে গেছে।

ওরা হেটে হেটে চলে গেলো গির্জার পেছনের দিকে। গির্জার সামনের অংশের মতোই এদিকটাতেও টবে আর মাটিতে অনেক ফুলের গাছ। পিছনের দিকটায় আরেকটা ছোট বিল্ডিং-সেখানে একটা রুমে ছোট ছোট চেয়ার-টেবিল, বই, খাতা, খেলনা ইত্যাদি সাজানো আছে। ওরা জানলো, অনেকদিন থেকেই সেইন্ট থমাস চার্চ স্থানীয় গরিব শিশুদের জন্য বিনামূল্যে শিক্ষার ব্যবস্থা করে আসছে আর এগুলো তারই সরঞ্জাম।

এভাবে ঘুরে ঘুরে সমস্ত গির্জা দেখা শেষ হলো যখন ততক্ষণে বেলা বেশ চড়ে গেছে। কিন্তু ছায়া সুনিবিড় শান্ত গির্জাটা এখনও ভোরের মতোই সৌম্য! আর সভ্যতা এবং ঐতিহ্যের প্রাণে ভরে গেছে মন ভাল করা একটা আমেজে! প্রশান্তি নিয়ে ওরা রওনা হলো বাড়ির দিকে!

সভ্যতা আর ঐতিহ্যের মতো তোমরাও যদি যেতে চাও সেইন্ট থমাস চার্চে তবে জেনে রাখ ঠিকানাটা- ৫৪ জনসন রোড, বাহাদুর শাহ পার্কের উত্তর দিকে গেলেই পাবে। গির্জা দেখায় কোন বাধা নিষেধ নেই-যখন খুশি ঢুকতে পারবে গির্জার চৌহদ্দিতে আর যদি প্রার্থনার সময়ে যাও তবে হলে ঢুকে প্রার্থনাটাও শুনতে পাবে!