ভীষণ মিঠে একটা আবহাওয়া। হেমন্তের এই দিনগুলোতে প্রকৃতি কী সুন্দর ভাবে আস্তে আস্তে বদলাতে থাকে, তাই না? অবশ্য শহরে বসে সেটা তেমন টের পাওয়া না! যদি গ্রামে যেতে পারো, তবে বুঝবে কীভাবে হালকা কুয়াশা মাখা সকাল আর ঝুপ করে নেমে আসা সন্ধ্যেগুলো শীতের আগমন ঘণ্টা বাজায়! নিচু জমিগুলো থেকে বর্ষায় পানি ধীরে ধীরে নেমে গিয়ে সেখানটা ভরে যাচ্ছে সবুজ ঘাস আর বুনো গাছ। সকালে ঘাসের ডগায়, গাছের পাতায়, মাকড়সার জালে জমে থাকে বিন্দু বিন্দু শিশির-ঠিক যেন মুক্তোর দানা!
এই হেমন্তেই সভ্যতা আর ঐতিহ্য গ্রামে ওদের দাদু বাড়ি থেকে বেড়িয়ে এলো। সারাদিন এদিক সেদিক ঘুরে,বড়শিতে মাছ ধরে, মাঠে ঘুড়ি উড়িয়ে খুব জমজমাট মজা হলো কিছুদিন। ঢাকায় ফিরে তাই ওদের মন বেশি ভালো নেই। মনটা আটকা পরে আছে গ্রামের সেই অফুরন্ত আনন্দের মধ্যে। বিশেষ করে স্কুলের সাপ্তাহিক ছুটির দিনটা কিছুতেই কাটতে চাচ্ছে না আর। ওদের এমন মনমরা ভাব দেখে সেদিন ওদের বাবা আবীর সাহেব বললেন, কাল তো তোমাদের স্কুল নেই। ভোরে আমার সঙ্গে মর্নিং ওয়াকে যাবে, ঠিক আছে?
না বাবা, সেদিন নানা ভাইয়ের অন্য কাজ ছিলো বলে সময় হয়নি, চলো না আজ যাই- সভ্যতা খুব আগ্রহ নিয়ে বাবার দিকে তাকালো।
ঐতিহ্যরও খুব যাবার ইচ্ছে, তবে একটু কিন্তু কিন্তু স্বরে সে বলল- এত সক্কাল বেলা কি আমাদের ঢুকতে দেবে গির্জায়?
-চলো গিয়েই দেখি না; বলে বাবা উঠে দাঁড়ালেন।
ঐতিহ্য জিজ্ঞেস করলো- বাবা এই গির্জাটা কি অনেক পুরানো?
এই গির্জার ধরণ আকার ইংল্যান্ডের সামসময়িক পল্লী এলাকার গির্জার মতোই, মানে একই রীতিতে বানানো। এক তলা গির্জার চারিদিকে উঁচু উঁচু সুচালো পাতা আকারের খিলানের মধ্যে বানানো হয়েছে কাঠের দরজা জানালা, এই নির্মাণ রীতিকে বলে ‘গথিক ডিজাইন’! ছাদের কার্নিশে খুব সুন্দর খাঁজকাটা নকশা- এটাকে বলে প্যারাপেট। তবে সবচেয়ে বেশি সুন্দর হলো চৌকোনা উঁচু টাওয়ারের উপর বসানো ঘড়িটি। এটা অবশ্য গির্জা নির্মাণের বেশ কয়েক বছর পরে, ১৮৬৩ সালে স্থাপন করা হয়। সেইন্ট থমাস চার্চের এই ঘড়িটি আর লন্ডনের হাউস অব পার্লামেন্টের চূড়ায় অবস্থিত ঘড়ি- দুটোই বিশ্ব বিখ্যাত ঘড়ি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ‘বিগ বেন’র নির্মিত।
সেই সময়ের ঢাকাবাসীরা বিশাল ঘড়িতেই সময় দেখত। তবে ঘড়িটা এখন আর কাজ করছে না, বন্ধ হয়ে আছে।
বাবা জানালেন, সেইন্ট থমাস চার্চের ভেতরের হলঘরটাও নাকি খুব সুন্দর। প্রধান হলঘরের ছাদটা কাঠের স্তম্ভের উপর বানানো হয়েছে, স্তম্ভ গুলো আবার খাঁজকাটা। এছাড়া এখানে এখনও সেই উনিশ শতকের ভারী ভারী কাঠের আসবাব ব্যবহার করা হয়। আর রয়েছে বিশ শতকের শুরুর দিকের দু’ ব্লেডের লম্বা ডাটার ফ্যান এবং একটি পিয়ানো। ফ্যানগুলো নাকি এখনও সচল আছে তবে পিয়ানোটি নষ্ট হয়ে গেছে।
ওরা হেটে হেটে চলে গেলো গির্জার পেছনের দিকে। গির্জার সামনের অংশের মতোই এদিকটাতেও টবে আর মাটিতে অনেক ফুলের গাছ। পিছনের দিকটায় আরেকটা ছোট বিল্ডিং-সেখানে একটা রুমে ছোট ছোট চেয়ার-টেবিল, বই, খাতা, খেলনা ইত্যাদি সাজানো আছে। ওরা জানলো, অনেকদিন থেকেই সেইন্ট থমাস চার্চ স্থানীয় গরিব শিশুদের জন্য বিনামূল্যে শিক্ষার ব্যবস্থা করে আসছে আর এগুলো তারই সরঞ্জাম।
এভাবে ঘুরে ঘুরে সমস্ত গির্জা দেখা শেষ হলো যখন ততক্ষণে বেলা বেশ চড়ে গেছে। কিন্তু ছায়া সুনিবিড় শান্ত গির্জাটা এখনও ভোরের মতোই সৌম্য! আর সভ্যতা এবং ঐতিহ্যের প্রাণে ভরে গেছে মন ভাল করা একটা আমেজে! প্রশান্তি নিয়ে ওরা রওনা হলো বাড়ির দিকে!
সভ্যতা আর ঐতিহ্যের মতো তোমরাও যদি যেতে চাও সেইন্ট থমাস চার্চে তবে জেনে রাখ ঠিকানাটা- ৫৪ জনসন রোড, বাহাদুর শাহ পার্কের উত্তর দিকে গেলেই পাবে। গির্জা দেখায় কোন বাধা নিষেধ নেই-যখন খুশি ঢুকতে পারবে গির্জার চৌহদ্দিতে আর যদি প্রার্থনার সময়ে যাও তবে হলে ঢুকে প্রার্থনাটাও শুনতে পাবে!