চীনে পটকা

আমাদের রামপদ তাহার জন্মদিনে একহাঁড়ি মিহিদানা লইয়া স্কুলে আসিল। টিফিনের ছুটি হওয়া মাত্র আমরা সকলেই মহা উৎসাহে সেগুলি ভাগ করিয়া খাইলাম। খাইল না কেবল দাশু।

সুকুমার রায়বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 Oct 2015, 08:08 AM
Updated : 6 Oct 2016, 12:41 PM

বাংলা শিশুতোষ সাহিত্যে সুকুমার রায়ের অবস্থান রাজার থেকে কম কিছু নয়। তোমরা যারা এখন স্কুলে যাও, খেলতে যাও দুষ্টুমি করে শাস্তি পাও তাদের মনের ভাবনা সুকুমার রায় খুব ভালো করেই বুঝতে পারতেন। পড়ার টেবিলে বসলে মনের মধ্যে আসা হাজার আবোলতাবোল চিন্তা আর হযবরল বুদ্ধিগুলো তিনি খুব সুন্দর করে তাঁর লেখার মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন। সুকুমার রায়ের তৈরি একটি অনবদ্য চরিত্র হলো দাশু। বয়স তোমাদের মতোই। দুরন্তপনা ও সোজাসাপ্টা কথা বলার জন্য লোকে দাশুকে ডাকে পাগলা দাশু। সেই দাশুকে নিয়েই লেখা এই গল্পটি।

পাগলা দাশু যে মিহিদানা খাইতে ভালোবাসে না, তা নয়। কিন্তু রামপদকে সে একেবারেই পছন্দ করিত না, দুজনের মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া চলিত। আমরা রামপদকে বলিলাম, "দাশুকে কিছু দে।" রামপদ বলিল, "কি রে দাশু, খাবি নাকি? দেখিস্‌, খাবার লোভ থাকে তো বল্‌ আর আমার সঙ্গে কোনোদিন লাগতে আসবিনে- তা হলে মিহিদানা পাবি।" এমন করিয়া বলিলে তো রাগ হইবারই কথা, কিন্তু দাশু কিছু না বলিয়া গম্ভীরভাবে হাত পাতিয়া মিহিদানা লইল, তারপর দারোয়ানের ছাগলটাকে ডাকিয়া সকলের সামনে তাহাকে সেই মিহিদানা খাওয়াইল। তারপর খানিকক্ষণ হাঁড়িটার দিকে তাকাইয়া, কি যেন ভাবিয়া মুচকি মুচকি হাসিতে হাসিতে স্কুলের বাহিরে চলিয়া গেল।

পণ্ডিত মহাশয় মানুষটি মন্দ নহেন। পড়ার জন্য প্রায়ই কোনো তাড়াহুড়ো করেন না। কেবল মাঝে মাঝে একটু বেশি গোল করিলে হঠাৎ সাংঘাতিক চটিয়া যান। সে সময়ে তাহার মেজাজটি আশ্চর্য রকম ধারাল হইয়া ওঠে। পণ্ডিত মহাশয় চেয়ারে বসিয়াই "নদী শব্দের রূপ কর" বলিয়া ঘুমাইয়া পড়িলেন। আমরা বই খুলিয়া হড়বড় করিয়া যা-তা খানিকটা বলিয়া গেলাম এবং তাহার উত্তরে, পণ্ডিত মহাশয়ের নাকের ভিতর হইতে অতি সুন্দর ঘড়্‌ঘড়্‌ শব্দ শুনিয়া বুঝিলাম, নিদ্রা বেশ গভীর হইয়াছে। কাজেই আমরাও শ্লেট লইয়া 'কাটকুট' আর 'দশপঁচিশ' খেলা শুরু করিলাম। কেবল মাঝে মাঝে যখন ঘড়ঘড়ানি কমিয়া আসিত, তখন সবাই মিলিয়া সুর করিয়া "নদী নদ্যৌ" ইত্যাদি আওরাইতাম। দেখিতাম, তাহাতে ঘুমপাড়ানি গানের মতো আশ্চর্য ফল পাওয়া যায়।

সকলে খেলায় মত্ত, কেবল দাশু এক কোনায় বসিয়া কি যেন করিতেছে, সেদিকে আমাদের খেয়াল নাই। একটু বাদে পণ্ডিত মহাশয়ের চেয়ারের তলায় তক্তার নিচ হইতে ফট্‌ করিয়া কি একটা আওয়াজ হইল। পণ্ডিত মহাশয় ঘুমের ঘোরে ভ্রূকুটি করিয়া সবেমাত্র 'উঃ' বলিয়া কি যেন একটা ধমক দিতে যাইবেন, এময় সময় ফুট্‌ফাট্‌ দুম্‌দাম্‌ ধুপ্‌ধাপ্‌ শব্দে তাণ্ডব কোলাহল উঠিয়া সমস্ত ইস্কুলটিকে একেবারে কাঁপাইয়া তুলিল। মনে হইল যেন, যত রাজ্যের মিস্ত্রী মজুর সবাই এক জোটে বিকট তালে ছাদ পিটাইতে লাগিয়েছে- দুনিয়ার যত কাঁসারি আর লাঠিয়াল সবাই যেন পাল্লা দিয়া হাতুড়ি আর লাঠি ঠুকিতেছে, খানিকক্ষণ পর্যন্ত আমরা, যাকে পড়ার বইয়ে 'কিংকর্তব্যবিমুঢ়' বলে, তেমনি হইয়া হাঁ করিয়া রহিলাম। পণ্ডিত মহাশয় একবার মাত্র বিকট শব্দ করিয়া, তার পর হঠাৎ হাত পা ছুঁড়িয়া একলাফে টেবিল ডিঙ্গাইয়া, একেবারে ক্লাসের মাঝখানে ধড়্‌ফড় করিয়া পড়িয়া গেলেন। সরকারী কলেজের নবীন পাল বরাবরই হাই জাম্পে ফার্স্ট প্রাইজ পায়, তাহাকেও আমরা এরকম লাফাইতে দেখি নাই। পাশের ঘরে নিচের ক্লাশের ছেলেরা চিৎকার করিয়া 'কড়াকিয়া' নামতা আওড়াইতেছিল- তাহারাও হঠাৎ ভয়ে আড়ষ্ট হইয়া থামিয়া গেল। দেখিতে দেখিতে ইস্কুলময় হুলুস্থুল পড়িয়া গেল- দারোয়ানের কুকুরটা পর্যন্ত যারপরনাই ব্যস্ত হইয়া বিকট ঘেঁউ ঘেঁউ শব্দে গোলমালের মাত্রা ভীষণ রকম বাড়াইয়া তুলিল।

মিনিট পাঁচেক ভয়ানক আওয়াজের পর যখন সব ঠাণ্ডা হইয়া আসিল, তখন পণ্ডিত মহাশয় বলিলেন, "কিসের শব্দ হইয়াছিল দেখ।" দারোয়ানজি একটা লম্বা বাঁশ দিয়া অতি সাবধানে আস্তে আস্তে, তক্তার নিচ হইতে একটা হাঁড়ি ঠেলিয়া বাহির করিল- রামপদর সেই হাঁড়িটা, তখনও তাহার মুখের কাছে একটুখানি মিহিদানা লাগিয়াছিল। পণ্ডিত মহাশয় ভয়ানক ভ্রূকুটি করিয়া বলিলেন, "এ হাঁড়িটা কার?" রামপদ বলিল, "আজ্ঞে আমার।" আর কোথা যায়- অমনি দুই কানে দুই পাক ! "হাঁড়িতে কি রেখেছিলি !" রামপদ তখন বুঝিতে পারিল যে, গোলমালের জন্য সমস্ত দোষ তাহার ঘাড়ে আসিয়া পড়িতেছে। সে বেচারা তাড়াতাড়ি বুঝাইতে গেল, "আজ্ঞে ওর মধ্যে মিহিদানা এনেছিলাম, তারপর-" মুখের কথা শেষ না হইতেই পণ্ডিত মহাশয় বলিলেন, "তারপর মিহিদানাগুলো চীনেপট্‌কা হয়ে ফুটতে লাগল, না?" বলিয়াই ঠাস্‌ ঠাস্‌ করিয়া দুই চড়।

অন্যান্য মাস্টারেরাও ক্লাশে আসিয়া জড় হইয়াছিলেন ; তাঁহারাও এক বাক্যে হাঁ-হাঁ করিয়া রুখিয়া আসিলেন। আমরা দেখিলাম বেগতিক। বিনা দোষে রামপদ বেচারা মার খায় বুঝি ! এমন সময় দাশু আমার শ্লেটখানা লইয়া পণ্ডিত মহাশয়কে দেখাইয়া বলিল, "এই দেখুন, আপনি যখন ঘুমোচ্ছিলেন, তখন ওরা শ্লেট নিয়ে খেলা করছিল- এই দেখুন কাটকুটের ঘর কাটা।" শ্লেটের উপর আমার নাম লেখা, পণ্ডিত মহাশয় আমার উপর প্রচণ্ড এক চড় তুলিয়াই হঠাৎ কেমন থতমত খাইয়া গেলেন। তারপর দাশুর দিকে কটমট করিয়া তাকাইয়া বলিলেন, "চোপ্‌ রও, কে বলেছে আমি ঘুমোচ্ছিলাম?" দাশু খানিকক্ষণ হাঁ করিয়া বলিল, "তবে যে আপনার নাক ডাকছিল?" পণ্ডিত মহাশয় তাড়াতাড়ি কথাটা ঘুরাইয়া বলিলেন, "বটে? ওরা সব খেলা কচ্ছিল? আর তুমি কি কচ্ছিলে?" দাশু অম্লানবদনে বলিল, "আমি পটকায় আগুন দিচ্ছিলাম।" শুনিয়াই সকলের চক্ষুস্থির ! ছোকরা বলে কি?

প্রায় আধমিনিট কাহারও মুখে আর কথা নাই। তারপর পণ্ডিত মহাশয় হঠাৎ একেবারে হুঙ্কার দিয়া বলিলেন, "কেন পটকায় আগুন দিচ্ছিলে?" দাশু ভয় পাইবার ছেলেই নয়, সে রামপদকে দেখাইয়া বলিল, "ও কেন আমায় মিহিদানা দিতে চাচ্ছিল না?" এমন অদ্ভুত যুক্তি শুনিয়া রামপদ বলিল, "আমার মিহিদানা, আমি যা ইচ্ছা তাই করব।" দাশু তৎক্ষণাৎ বলিয়া উঠিল, "তা হলে আমার পট্‌কা আমিও যা ইচ্ছা তা করব।" এরূপ পাগলের সঙ্গে আর তর্ক করা চলে না ! কাজেই মাস্টারেরা সকলেই কিছু-কিছু ধমক-ধামক করিয়া যে যার ক্লাশে চলিয়া গেলেন। সে 'পাগলা' বলিয়া তাহার কোনো শাস্তি হইল না। ছুটির পর আমরা সবাই মিলিয়া চেষ্টা করিয়াও তাহার দোষ বুঝাইতে পারিলাম না। সে বলিল, "আমার পট্‌কা, রামপদর হাঁড়ি। যদি আমার দোষ হয়, তা হলে রামপদরও দোষ হয়েছে। ব্যাস্‌ ! ওর মার খাওয়াই উচিত।"