২০১৩ সালে বড় অসময়ে চলে গেলেন তিনি, মাত্র ৪৯ বছর বয়সে। তবে তার সৃষ্টির মধ্যে তিনি আজও বেঁচে আছেন, থাকবেন চিরদিন।
ঋতুপর্ণের জন্ম কলকাতায় ১৯৬৩ সালের ৩১ অগাস্ট। তার বাবা-মা দুজনেই চলচ্চিত্রজগতের মানুষ ছিলেন। বাবা সুনীল ঘোষ ছিলেন তথ্যচিত্র নির্মাতা।
ঋতুপর্ণ লেখাপড়া করেন কলকাতাতেই সাউথ পয়েন্ট হাইস্কুলে। যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে অর্থনীতির ছাত্র ছিলেন তিনি। আশির দশকে বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠানের কপিরাইটার হিসেবে পেশাজীবন শুরু করেন। সে সময় বিজ্ঞাপনের চিত্রনাট্য লিখে বেশ খ্যাতিও পান। তবে তার মূল আগ্রহ ছিল চলচ্চিত্রে। সত্যজিৎ রায়ের ভাবশিষ্য ছিলেন।
চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করেন নব্বইয়ের দশকে। প্রথম শুরু করেন তথ্যচিত্র দিয়ে।
ছোটদের জন্য লেখা শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের গল্প থেকে তৈরি হলো প্রথম কাহিনিচিত্র ‘হীরের আংটি’। ১৯৯২ সালে মুক্তি পায় ছবিটি। ১৯৯৪ সালে মুক্তি পেলো ‘উনিশে এপ্রিল’। দ্বিতীয় ছবিতেই বাজিমাত।দেবশ্রী রায়, অপর্ণা সেন অভিনীত ছবিটির জন্য দুটি জাতীয় পুরস্কার জিতে নিলেন তিনি। সেইসঙ্গে জয় করেন দর্শকের ভালোবাসা। গতানুগতিক ফর্মুলা ছবির বদলে ভিন্ন ধারার এমন একটি ছবি দেখে দর্শক যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো। সমালোচকদের প্রশংসা তো কুড়ালোই, বাণিজ্যিক সাফল্যও পেল ছবিটি।
‘অসুখ’(১৯৯৯) সেরা ছবি হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জয় করে। আর ‘উৎসব’ ছবির জন্য ২০০০ সালে সেরা পরিচালকের জাতীয় পুরস্কার পান ঋতুপর্ণ। প্রতিটি ছবিতেই যেন নিজেকে ছাড়িয়ে যান তিনি।বিশেষ করে ‘উৎসব’-এ সনাতন দুর্গা পূজার প্রেক্ষাপটে যে গল্প তিনি তুলে আনলেন তা শুধু একটি পরিবারের নয়, যেন মধ্যবিত্তের ক্ষয়িষ্ণুমুল্যবোধের সংকটকেই সামনে নিয়ে এল। ২০০৩ সালে মুক্তি পেল ‘শুভ মহরত’ এবং ‘চোখের বালি’। প্রথমটি একটি রহস্যকাহিনি। আর দ্বিতীয়টি তো রীতিমতো ইতিহাস। রবীন্দ্রনাথের বিনোদিনীকে নতুনরূপে পর্দায় নিয়ে এলেন ঋতুপর্ণ। বিনোদিনী চরিত্রে ঐশ্বরিয়া যেমন ছিলেন অনবদ্য তেমনি মহেন্দ্র চরিত্রে অসামান্য অভিনয় করেন প্রসেনজিত।‘চোখের বালি’ বাংলা চলচ্চিত্রের অগ্রযাত্রায় এক মাইল ফলক।
২০০৪ সালে মুক্তি পায় ঋতুপর্ণের প্রথম হিন্দিছবি ‘রেইনকোট’। অজয় দেবগন-ঐশ্বরিয়া অভিনীত ছবিটি সেরা ছবির জাতীয় পুরস্কার পায়। বিগ-বাজেটের হিন্দি ছবির তুলনায় ‘রেইনকোট’ ছিল একেবারেই আলাদা ধাঁচের। গুটিকয় চরিত্র। মাত্র কয়েকটি সেট। অথচ সংলাপ, চিত্রনাট্য ও পরিচালকের মুন্সীয়ানায় তা হয়ে ওঠে অসামান্য। অজয়-ঐশ্বরিয়ার অভিনয়ও ছিল দারুণ।
২০০৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘অন্তরমহল’ কিছুটা বিতর্কিত হয়েছিল কয়েকটি দৃশ্যের কারণে।তবে সেখানে তিনি নিছক যৌনতা প্রচার করেননি মোটেই। বরং নিকট অতীতের কিছু অন্ধকারকে তুলে ধরেছিলেন।ছবিটিতে অভিনয় করেছিলেন অভিষেক বচ্চন, জ্যাকি শ্রফ, রুপা গাঙ্গুলি ও সোহা আলি খান।
‘লাস্ট লিয়ার’ মুক্তি পায় ২০০৭ সালে। এখানে প্রবীণ মঞ্চঅভিনেতার ভূমিকায় অমিতাভ বচ্চন ছিলেন অনবদ্য। ২০০৮ সালে মুক্তি পাওয়া ‘খেলা’ সিনেমার মাধ্যমে প্রথমবারের মতো বাংলা ছবিতে অভিনয় করেন মনিষা কৈরালা। ওই বছরই ‘সব চরিত্র কাল্পনিক’ ছবিটি বাংলা ভাষায় সেরা চলচ্চিত্র হিসেবে ভারতের জাতীয় পুরস্কার পায়।
২০০৯ সালে মুক্তি পাওয়া ‘আবহমান’ ছবিটি ঋতুপর্ণকে আবার সেরা পরিচালকের জাতীয় পুরস্কার এনে দেয়।
ঋতুপর্ণর ছবির বৈশিষ্ট্য ছিল তিনি মারদাঙ্গা অ্যাকশন, ঘটনার ঘনঘটা, নাচ-গানের মতো বিনোদনের চটকের পরিবর্তে মানুষের গল্প, মনোজগতের গল্প বলতে ভালোবাসতেন।চলচ্চিত্রের ভাষা তার ছবিতে ছিল প্রধান। ছোট্ট একটি দৃশ্যের মাধ্যমে তিনি সৃষ্টি করতেন দ্বন্দ্ব। সামান্য একটি ইঙ্গিতে খুলে যেতো আপাত গোপন মনোজগতের দ্বার। দর্শককে নিয়ে যেতে পারতেন ভাবনার সিঁড়িতে। পৌঁছে দিতে পারতেন মানবিক অনুভূতির শিখরে।
ঋতুপর্ণ শুধু একজন প্রতিভাবান পরিচালকই ছিলেন না, তিনি চিত্রনাট্যকার, গীতিকার এবং অভিনেতা হিসেবেও ছিলেন সফল। সংলাপ রচনার ক্ষেত্রেও প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। ওড়িয়া ভাষার ছবি ‘দেইথিল্লি মা কু’তে তিনি প্রথম অভিনয় করেন। ২০১১ সালে তিনি অভিনয় করেন ‘আরেকটি প্রেমের গল্প’ এবং ‘মেমরিজ ইন মার্চ’ ছবিতে। ‘আরেকটি প্রেমের গল্প’ ছবির বিষয়বস্তু ছিল সমকামিতা। ব্যক্তিজীবনে ঋতুপর্ণ ছিলেন সমকামী এবং সেকথা তিনি স্বীকার করতে দ্বিধা করেননি। ‘আরেকটি প্রেমের গল্প’ ছবিতে একজন সমকামী চিত্রপরিচালকের ভূমিকায় দুর্দান্ত অভিনয় করেন তিনি। এই চরিত্রটিকে বাস্তবানুগ করার জন্য তাকে কিছু হরমোন চিকিৎসা করতে হয় যা পরবর্তীতে তার দেহে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
২০১৩ সালের ৩০ মে হৃদরোগে তার মৃত্যু হয়।মাত্র ৪৯ বছর বয়সে তার এই মৃত্যুতে বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য যে অপূরণীয় ক্ষতি হলো তা পূরণ হবার নয়।