৪৮-এ মাধুরী

পঞ্চাশে পা দিতে আর বাকি দু বছর। কিন্তু তার ভুবন ভোলানো হাসি সে কথা মনে আসতেই দেবে না। আজও রূপের দৌড়ে পাল্লা দিতে পারেন সদ্য তরুণীর সঙ্গে। তিনি মাধুরী দীক্ষিত - হিন্দি সিনেমার শত বর্ষের ইতিহাসে অন্যতম সেরা নায়িকা।

শান্তা মারিয়াবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 May 2015, 11:08 AM
Updated : 15 May 2015, 11:13 AM

মাধুরীর জন্ম ১৯৬৭ সালের ১৫ মে, মুম্বাইয়ে চিতপাওন ব্রাহ্মণ পরিবারে। বাবার নাম শংকর দীক্ষিত, মায়ের নাম স্নেহলতা। মহারাষ্ট্রের চিতপাওন ব্রাহ্মণরা মনে করেন বর্ণ হিসেবে তারা শ্রেষ্ঠ। মাধুরী অবশ্য তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছেন কৌলিন্যে নয়, প্রতিভায়। কারণ বলিউডে ফিল্মি কৌলিন্য তার ছিল না। তিনি কাপুর, খান, দেওল বা খান্না ছিলেন না। প্রতিষ্ঠিত কারও হাত ধরে এই মারাঠি নারী সিনেমায় আসেননি।

মাধুরীর শিক্ষাজীবন শুরু হয় মুম্বাইয়ে। ডিভাইন চাইল্ড হাইস্কুলের ছাত্রী ছিলেন তিনি। মুম্বাই ইউনিভার্সিটির মাইক্রোবায়োলজি বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন। তিনি কত্থক নাচের তালিম নেওয়া নৃত্যশিল্পী। তার মা উচ্চাঙ্গসংগীতের শিল্পী। মায়ের কাছ থেকে গানও শেখেন মাধুরী।

অনেক বাঙালি দর্শকই মনে করেন সুচিত্রা সেনের চেহারা, বিশেষ করে তার হাসির সঙ্গে মাধুরীর বেশ সাদৃশ্য রয়েছে। চলচ্চিত্রে মাধুরী তার ক্যারিয়ার শুরু করেন বাঙালি নারীর চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমেই। তাপস পালের বিপরীতে মাধুরী অভিনীত প্রথম সিনেমা ‘অবোধ’ মুক্তি পায় ১৯৮৪ সালে। সেখানে মাধুরীর ভূমিকা ছিল এক নিষ্পাপ বালিকাবধূর, যে বিবাহিত জীবনের কোনো মানেই বোঝে না। সিনেমাটি বক্স-অফিসে সাফল্য না পেলেও তার অভিনয় প্রশংসা পেয়েছিল। মাধুরীর সঙ্গে আরেক কিংবদন্তি অভিনেত্রী মধুবালারও রয়েছে দারুণ মিল। বিশেষ করে দুজনের হাসিই হৃদয়-ছোঁয়া।

৮৪ থেকে ৮৮। আট বছরে মাধুরীর আরও আটটি সিনেমা মুক্তি পায়। কিন্তু কোনোটিই বক্স-অফিসে সাফল্য পায়নি। তারপরও হতাশ হননি তিনি। ১৯৮৮ সালে মুক্তি পেলো এন চন্দ্রর সিনেমা ‘তেজাব’। অনিল কাপুরের বিপরীতে মাধুরী। সিনেমায় তার অভিনীত চরিত্রের নাম ছিল ‘মোহিনী’। ‘মোহিনী’র মোহিনী হাসির জাদুতে সত্যিই মুগ্ধ হল দর্শক। ব্লকবাস্টার হিট হল ‘তেজাব’। মাধুরী তার ‘এক দো তিন’ নাচের ছন্দে স্রেফ লাস্যময়ীই প্রমাণিত হলেন না, সেই সঙ্গে তিনি যে অভিনেত্রী হিসেবেও দারুণ, তারও সাক্ষর রাখলেন। সেবার ফিল্ম ফেয়ার পুরস্কার না জিতলেও সেরা অভিনেত্রী হিসেবে মনোনয়ন পেয়েছিলেন তিনি। ‘এক দো তিনে’র মাধ্যমে নৃত্যকুশলী হিসেবেও পরিচিতি পেলেন। এরপর মাধুরীর জন্য একের পর এক জনপ্রিয় নাচের নির্দেশনা দিয়েছেন নৃত্য নির্দেশক সরোজ খান। আর ক্রমশ মাধুরীর নাচ হয়ে উঠেছে কিংবদন্তি।

১৯৮৯ সালে সুভাষ ঘাই পরিচালিত ‘রাম-লাক্শমান’ও সুপারডুপার হিট। এখানেও মাধুরীর বিপরীতে ছিলেন অনিল। এ বছরেই মিঠুন চক্রবর্তীর বিপরীতে ‘প্রেম প্রতিজ্ঞা’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য আবার ফিল্মফেয়ারে সেরা অভিনেত্রীর মনোনয়ন।

এরপর আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি মাধুরীকে। একের পর এক ব্যবসাসফল সিনেমা। সে সময়ের হিট ছবি  ‘ত্রিদেব, ‘পারিন্দা’ তে মাধুরী নায়িকা হিসেবে ছিলেন। যদিও গল্পে তার তেমন ভূমিকা ছিল না। ‘কিষাণ-কানহাইয়া’, ‘জিন্দেগি এক জুয়া’, ‘জামাই রাজা’সহ অসংখ্য হিট ছবিতে অভিনয় করেন তিনি।

১৯৯০ সালে মুক্তি পায় মাধুরী ও আমির খান অভিনীত প্রেমের সিনেমা ‘দিল’। এ সিনেমায় অভিনয়ের জন্য প্রথমবারের মতো সেরা অভিনেত্রীর ফিল্মফেয়ার পুরস্কার জিতে নেন মাধুরী।

৯১ সালে মাধুরী, সঞ্জয় দত্ত এবং সালমান খান অভিনীত ত্রিভুজ প্রেমের সিনেমা ‘সাজন’ মাধুরীকে বলিউডের এক নম্বর নায়িকার আসন দিয়ে দেয়। এই সিনেমার প্রায় প্রতিটি গানের সঙ্গে মাধুরীর নাচ তাকে দর্শকের স্বপ্নকন্যায় পরিণত করে। সিনেমার গল্পও ছিল মূলত তাকে কেন্দ্র করেই। তাই তিনি যে একাধারে সুন্দরী ও সুঅভিনেত্রী তা প্রমাণিত হয়ে যায় আবারও।

১৯৯৩ সালে সঞ্জয় দত্ত ও জ্যাকি শ্রফের বিপরীতে ‘খলনায়ক’ সিনেমায় অভিনয়ের জন্য আবার সেরা অভিনেত্রীর ফিল্ম ফেয়ার পুরস্কার।

মাধুরীর বৈশিষ্ট্য হল, নাচ, অভিনয়, গুরুগম্ভীর, কমেডি সব কিছুতেই তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তিনি যেমন সুন্দরী তেমনি আবেদনময়ী। বিশেষ করে তার হাসিতে মোহিত হন দর্শক। তার মতো এমন বহুমুখী প্রতিভাধর অভিনেত্রী বলিউডে বিরল। মাধুরীর কথা বলতে গেলে তার নৃত্যকুশলতার কথা না বললেই নয়। পণ্ডিত বিরজু মহারাজের মতো কিংবদন্তি নৃত্যগুরুর নির্দেশনায় নেচেছেন তিনি।

‘ধক ধক করনে লাগা’, ‘চোলি কে পিছে কেয়া হ্যায়’, ‘তু শায়ের হ্যায়’, ‘এক লাড়কি হ্যায়’, ‘মার ডালা’-সহ অসংখ্য জনপ্রিয় গানের সঙ্গে তার নাচ দর্শক হৃদয়ে ঝড় তুলেছে।

মাধুরী অভিনয় করেছেন অনিল কাপুর,ঋষি কাপুর, বিনোদ খান্না, মিঠুন চক্রবর্তী,সঞ্জয় দত্ত, আমির খান, সালমান খান, শাহরুখ খানসহ প্রথম সারির নায়কদের বিপরীতে। অনিল কাপুর ও শাহরুখ খানের সঙ্গে জুটি বেঁধে অনেকগুলো হিট সিনেমা উপহার দিয়েছেন তিনি।

 ‘আনজাম’, ‘সংগীত’, ‘মৃত্যুদণ্ড’, ‘প্রেমগ্রন্থ’, ‘খলনায়ক’, ‘সাহেবান’, ‘বেটা’সহ অসংখ্য সিনেমায় তার সিরিয়াস অভিনয় সমালোচকদের ভূয়সী প্রশংসা পেয়েছে। ‘রাজা’ ও ‘খেল’-এর মতো সিনেমা দিয়ে প্রমাণ করেছেন কমেডিতেও তার জুড়ি নেই। প্রায় শ’খানেক ছবিতে অভিনয় করেছেন মাধুরী।

অভিনয় ক্যারিয়ারে ছয়টি ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড ঘরে তুলেছেন মাধুরী। চারটি সেরা অভিনেত্রী হিসেবে, একটি পার্শ্ব-চরিত্রে সেরা অভিনয়ের জন্য, আরেকটি বলিউডে ক্যারিয়ারের ২৫ বছর পূর্তির জন্য বিশেষ পুরস্কার। ১৩ বার ফিল্মফেয়ার আসরে সেরা অভিনেত্রী বিভাগে মনোনয়ন পেয়েছেন। ২০০৮ সালে ভারত সরকার তাকে পদ্মশ্রী সম্মাননা দিয়েছে।

১৯৯৯ সালে মাধুরী বিয়ে করেন মার্কিন প্রবাসী ভারতীয় হার্ট সার্জন শ্রীরাম নেনেকে। বিয়ের পর ২০০০ সালে ‘গজগামিনী’, ২০০১ সালে ‘লজ্জা’ এবং ২০০২ সালে মুক্তি পায় মাধুরী অভিনীত ‘দেবদাস’।

 ‘লজ্জা’ সিনেমায় মাধুরী অভিনয় করেন এক যাত্রা-অভিনেত্রীর ভূমিকায়। সেখানে তার অভিনীত চরিত্রের নাম ছিল জানকী। নারী অধিকারের পক্ষে ওই সিনেমায় প্রতিটি প্রধান নারী চরিত্রের নাম ছিল সীতার বিভিন্ন নামানুসারে। সেখানে জানকী প্রশ্ন তোলে সীতার অগ্নিপরীক্ষার যৌক্তিকতা ও পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে। অসাধারণ অভিনয় করে মাধুরী সমালোচকদের প্রশংসা অর্জন করেন।

‘গজগামিনী’ ছিল আর্ট ফিল্ম। মাধুরীর ভক্ত বিখ্যাত শিল্পী মকবুল ফিদা হোসেনের নির্মাণ ছিল এটি। এই সিনেমায় প্রাচীনযুগ থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত শ্বাশত ভারতীয় নারীর রূপকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বিভিন্ন চরিত্রের মাধ্যমে। মকবুল ফিদা হোসেন এই শিল্পচিত্রটিকে মূলত মাধুরীর সৌন্দর্যের বেদীতে তার অর্ঘ্য হিসেবে অভিহিত করেছিলেন।

সঞ্জয় লিলা বানসালির ‘দেবদাস’ সিনেমায় চন্দ্রমুখীর ভূমিকায় মাধুরী অসামান্য অভিনয় করেন। ‘ঢাই শাম রোখলে’ এই নাচের বোল তিনি যে মুদ্রায় ফুটিয়ে তোলেন তা তুলনাবিহীন। ‘দেবদাস’ উপন্যাসের চন্দ্রমুখী যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে মাধুরীর মধ্যে।

এরপর সংসার সন্তান নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন মাধুরী। প্রবাসে তিনি সাধারণ এক গৃহবধূর সরল জীবন উপভোগ করেন। স্বামী ও দুই ছেলেকে নিয়ে তার সুখের সংসার।

২০০৬ সাল থেকেই আবার মুম্বাইয়ে সপরিবারে বাস করতে ফিরে আসেন তিনি। ২০০৭ সালে মুক্তি পায় ‘আজা নাচলে’। ছবিটিতে তার নাচ ও অভিনয় প্রশংসা পায়।

এর মধ্যে টিভি রিয়েলিটি শো ‘ঝলক দিখলা জা’র মাধ্যমে ছোট পর্দায় জনপ্রিয় হয়েছেন তিনি।

২০১৪ সালে মুক্তি পেয়েছে মাধুরী অভিনীত ডার্ক কমেডি ‘দেড় ইশকিয়া’। বক্স-অফিসে তেমন সাফল্য না পেলেও, সমালোচকদের কাছে প্রশংসা পেয়েছে সিনেমাটি। প্রশংসিত হয়েছে বেগম পারার ভূমিকায় মাধুরীর অভিনয়। এর আগে ‘ইয়ে জাওয়ানি হ্যায় দিওয়ানি’ সিনেমায় আইটেম সং ‘ঘাগরা’ দিয়ে মাধুরী প্রমাণ করেছেন এই বয়সেও সৌন্দর্যে ও আবেদনে তিনি অনবদ্য। গত বছর মাধুরী অভিনীত ‘গুলাব গ্যাং’ মুক্তি পায়। নারী অধিকারে সোচ্চার এক নারীর ভূমিকায় এই সিনেমাতেও তার অভিনয় প্রশংসিত হয়।

মাধুরী সমাজসেবামূলক বিভিন্ন কাজের সঙ্গে যুক্ত। তিনি ইউনিসেফের গুডউইল অ্যাম্বাসেডর। টিভি পর্দার জনপ্রিয় মুখ তিনি। নাচের জন্য অনলাইন স্কুল পরিচালনা করছেন।

বলিউডে সুন্দরী ও সুঅভিনেত্রীর অভাব নেই, কিন্তু মাধুরী দীক্ষিত আছেন একজনই।