চলচ্চিত্র যখন যুদ্ধের হাতিয়ার

স্বাধীনতাকামী চলচ্চিত্রকর্মীদের লড়াই বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের এক অনন্য অধ্যায়। চলচ্চিত্র নির্মাতা ও লেখক আলমগীর কবিরের ভাষায়,“মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশের উদ্দেশ্য বহির্বিশ্বে তুলে ধরার একটা জোর তাগিদ অনুভূত হয়েছিল।

নাজিয়া আফরিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 Dec 2014, 08:28 AM
Updated : 17 Dec 2014, 08:56 AM

” আর এ তাগিদ থেকেই তথ্যচিত্র নির্মাণে নিজেদের নিযুক্ত করেন চলচ্চিত্রযোদ্ধারা। তাদের উদ্যোগের ফলাফল ছিল জহির রায়হান পরিচালিত ‘স্টপ জেনোসাইড’।

পাকিস্তানি সেনাবাহিনির দখলে থাকা দেশের বেশিরভাগ অংশেই প্রবেশগম্যতা ছিল না, সেই সঙ্গে যুদ্ধক্ষেত্রে চিত্রায়নের ঝুঁকিতো ছিলই। তারপরও এই তথ্যচিত্রগুলো মুক্তিযুদ্ধের অনন্য দলিল এবং বাঙালি জনগোষ্ঠীর ওপর চালানো গণহত্যার প্রমাণ। 

বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় মুক্তিযুদ্ধকে সেলুলয়েডে ধারণের প্রথম উদ্যোগটা এসেছিল বাংলাদেশ বুদ্ধিজীবি সংগ্রাম পরিষদ এবং বাংলাদেশ শিল্পী ও কুশলী সহায়ক সমিতির তরফ থেকে।  যেসব বাংলাদেশি পেশাজীবী ও বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানি আগ্রাসনের হাত থেকে রক্ষা পেতে দেশ ছেড়েছিলেন, তারাই স্বাধীনতার লক্ষ্যে সৃজনশীল সমর্থন যোগাতে এবং জন্মভূমিতে ঘটে যাওয়া জঘন্য সব অপরাধকে নথিবদ্ধ করতে ও পৃথিবীর সামনে তুলে ধরতে এ দুটি সংগঠন গড়ে তোলেন। 

বিজয় দিবসে গ্লিটজের পাঠকদের জন্য অনুদিত হলো তাঁদের সেই উদ্যোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল: 

বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী সংগ্রাম পরিষদের তরফ থেকে একটি আবেদন

বাংলাদেশ বুদ্ধিজীবী সংগ্রাম পরিষদ বাংলাদেশের ছিন্নমূল শিক্ষক, বিজ্ঞানী, কবি, চিত্রশিল্পী, লেখক, সাংবাদিক এবং অভিনয়শিল্পীদের সংগঠন, যারা ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যা ও রাজনৈতিক অপসারণের জন্য দায়ী পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর রোষানলের হাত থেকে পালাতে সক্ষম হয়েছে। 

এই পরিষদের উদ্দেশ্য হচ্ছে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের যুদ্ধসংক্রান্ত উদ্যোগকে সমর্থন করা, আমাদের স্বাধীনতার বিষয়ে বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করা, আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে প্রশিক্ষণমূলক কাজ করা এবং আমাদের সদস্যরা যখন স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য কাজ করবেন তখন তাদের টিকে থাকার রসদ যোগানো। 

যে সম্প্রদায় থেকে আমাদের সদস্যরা এসেছেন, ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের রাত থেকেই সে গোষ্ঠী বিশেষ সেনা কর্মকাণ্ডের লক্ষ্য হয়েছে। বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের প্রতি সেনাবাহিনীর বিদ্বেষ কতটা তীব্র তার প্রমাণ পাওয়া যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশজন শিক্ষককে তাদের স্ত্রী এবং সন্তানদের সামনে ঠাণ্ডা মাথায় গুলি করে হত্যা করার ঘটনার মাধ্যমে। তাদের অপরাধ ছিল গণতান্ত্রিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধের প্রতি সমর্থন, স্বৈরাচারী শাসনের বিরোধিতা, বাঙ্গালির ভাষাগত এবং সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের দাবি, বাংলাদেশ আন্দোলনের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং দার্শনিক ভিত্তিকে ভাষা প্রদান। বাঙ্গালির স্বায়ত্বশাসনের দাবিকে স্তব্ধ করে দিতে রাজনৈতিক নেতাদের পাশাপাশি বুদ্ধিজীবী শ্রেণীকেও নিশ্চিহ্ণ করে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল সেনাবাহিনী। 

স্বায়ত্বশাসনের এই দাবীর উত্থান ২৩ বছরের অনাচার এবং বঞ্চনা যা বাঙ্গালিকে সইতে হয়েছে, পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও এর উন্নয়নে তাদের সামান্যই ভাগ দেওয়া হয়। সশস্ত্র বাহিনি এবং উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে তাদের প্রতিনিধিত্ব ছিল না থাকার মতোই এবং পাট থেকে আসা বৈদেশিক মুদ্রার বড় অংশই পশ্চিম পাকিস্তানে শিল্প গড়ে তুলতে ব্যয় করা হতো আর বাংলাদেশে ছিল তাদের জন্য সংরক্ষিত বাজার। বাঙ্গালিরা উপনিবেশিক আদলের এই শোষণের অবসান ঘটাতে চেয়েছিল এবং নিজেদের উন্নয়নে নিজেদের অর্থনৈতিক সম্পদ নিয়ন্ত্রণের অধিকার চেয়েছিল। এই দাবি পশ্চিম পাকিস্তানে ক্ষমতায় থাকা পূঁজিবাদী-আমলাতান্ত্রিক-সামরিক গোষ্ঠীর স্বার্থে আঘাত হেনেছিল, ২২টি ধনী পরিবার যারা জাতীয় সম্পদের ৮০% নিয়ন্ত্রণ করতো। 

গত ডিসেম্বরে যখন সাধারণ নির্বাচনের ফল জনগণের চাপের মুখে মেনে নেওয়া হলো, তখনই প্রমাণ হয়েছিল যে বাঙ্গালির দাবী প্রায় সর্বসম্মত, রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবুর রহমান, বাংলাদেশের জনগণের নেতা, যার দল আওয়ামী লীগ জাতীয় সভার ১৬৯টির মধ্যে ১৬৭টি আসন জিতে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে, তার সঙ্গে রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য এক কপট আলোচনা শুরু করলেন। আলোচনার আড়ালে, যা দীর্ঘায়িত করা হচ্ছিল, ইয়াহিয়া খান দুই বছর পুরোনো একটি ছকে শেষ আঁচড় কাটছিলেন, যেটি ছিল সাংবিধানিক দাবীকে কঠোর বলপ্রয়োগের মাধ্যমে ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়া। ইয়াহিয়ার মধ্যযুগীয় সেনারা আধুনিক অস্ত্রসজ্জিত হয়ে ২৫শে মার্চের মধ্যরাতের দিকে বাংলাদেশের নিরীহ মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। এরপর যে গণহত্যা এবং ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়, ইতিহাসে তা নজিরবিহীন। 

ইয়াহিয়ার এই বিশ্বাসঘাতকতার লক্ষ্য ছিল গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, যা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠের অধিকার তা অস্বীকার করা এবং বাংলাদেশে উপনিবেশিক শ্বাসনযন্ত্র কায়েম রাখা। এই লক্ষ্যকে আরও এগিয়ে নিতে, ইসলামাবাদ গণহত্যার এক সুপরিকল্পিত প্রকল্প শুরু করেছে যাতে তাদের সমস্যার অবসান ঘটে। তাদের সেনাবাহিনী নিরস্ত্র বাঙ্গালি, নারী, শিশু, বৃদ্ধ ও জরাগ্রস্তদের উন্মাদের মতো হত্যা করছে। তারা এ পর্যন্ত ১০ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে এবং ৭০ লাখেরও বেশি মানুষকে নিষ্ঠুরতার হাত থেকে বাঁচতে ভারত ও বার্মায় পালিয়ে যেতে বাধ্য করেছে। এরা শহরগুলোতে পাড়ার পর পাড়া এবং গ্রামকে গ্রাম বিলীন করে দিয়েছে। সন্ত্রাস সৃষ্টির এদের প্রিয় পদ্ধতি হচ্ছে গ্রামে আগুন লাগিয়ে দেওয়া এবং পালাতে থাকা পুরুষদের নির্মমভাবে হত্যা করা আর মেয়েদের অপহরণ করে তাদের সম্মান ছিনিয়ে নেওয়া ও নির্যাতন করা। সংক্ষেপে বলতে গেলে, পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনী হত্যা, ধর্ষণ ও লুণ্ঠনের এমন এক অভিযান চালাচ্ছে যার মাত্রা আটিলা কিংবা হিটলারের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। 

বাংলাদেশি জনগণকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হচ্ছে। আমরা বিশ্বাস করি বিশ্বব্যাপী বুদ্ধিজীবীদের মানবতার প্রতি কর্তব্য রয়েছে এবং বাংলাদেশের প্রতিও, যেখানে মানবতা যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। 

বিশ্বব্যাপী বুদ্ধিজীবীদের প্রতি আমাদের আবেদন:  

১) বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধে নিজ নিজ দেশে আন্দোলন গড়ে তুলুন। 

২) পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলুন এবং ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অফ জাস্টিস এবং জাতিসংঘে বাংলাদেশ প্রসঙ্গটি উত্থাপনে চাপ প্রয়োগ করুন।  

৩) স্বৈরাচারী শাসন এবং উপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম, যা আজ সম্পূর্ণ স্বাধীনতার সংগ্রামে পরিণত হয়েছে, তাকে সমর্থন দিন। 

৪) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিতে নিজ নিজ সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করুন। 

৫) শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্য রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তিকল্পে চাপ প্রয়োগ করুন

৬) আমাদের উদ্দ্যেশ সফলে আর্থিক সহায়তা দিন

সভাপতি

ড. এ আর মল্লিক - উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

সহ-সভাপতি

ড. কে. এস. মুরশিদ - প্রধান, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

অধ্যাপক এস. আলী আহসান - প্রধান, বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

কামরুল হাসান - চিত্রশিল্পী

রণেশ দাশগুপ্ত - সাংবাদিক

সাধারণ সম্পাদক

জহির রায়হান - কথাসাহিত‍্য্যিক ও চলচ্চিত্র নির্দেশক

যুগ্ম সম্পাদক

ড. মো. বেলায়েত হোসেন - রিডার, পদার্থবিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

নির্বাহী সম্পাদকমন্ডলী

হাসান ইমাম - অভিনেতা

সাদেক খান - শিল্প সমালোচক

মওদুদ আহমেদ - ব্যারিস্টার

ড. মতিলাল পাল - অর্থনীতিবিদ

ব্রজেন দাস - আন্তর্জাতিক ত্রীড়াবিদ

ওয়াহিদুল হক - সঙ্গীতজ্ঞ ও সাংবাদিক

আলমগীর কবির - সাংবাদিক ও সমালোচক

ফয়েজ আহমদ - সাংবাদিক

এম. এ. খায়ের - চলচ্চিত্রনির্দেশক

কামাল লোহানী - সাংবাদিক

মুস্তাফা মনোয়ার - চিত্রশিল্পী ও টিভি প্রযোজক

---

বাংলাদেশ বুদ্ধিজীবি মুক্তিসংগ্রাম পরিষদ

৯ সার্কাস অ্যাভিনিউ

কলকাতা ১৬ - ভারত