‘যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে’

যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকো শহরের কেন্দ্রে ধ্বংসস্তুপ থেকে রাতের অন্ধকারে সরে যায় মানব সভ্যতার প্রতিনিধিরা, আর ভোরের আলোর সঙ্গে উত্থান ঘটে এক দল এইপের। ম্যাট রিভসের ‘ডন অফ দ্য প্ল্যানেট অফ দ্য এইপস’- এইপদের এক ভিন্ন পৃথিবী তৈরির দিকে এগিয়ে যাওয়ার গল্প। 

শরীফুল হক আনন্দবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 August 2014, 10:41 AM
Updated : 17 August 2014, 10:41 AM

ধ্বংসপ্রায় পৃথিবী এবং এইপদের রাজত্ব

২০১১ সালে মুক্তি পাওয়া ‘রাইজ অফ দ্য প্ল্যানেট অফ দ্য এইপস’-এর সমাপ্তি যেখানে তার ঠিক ১০ বছর পর সান ফ্রান্সিসকো শহরে শুরু হয় ‘ডন অফ দ্য প্ল্যানেট অফ দ্য এইপস’-এর গল্প। ‘এএলজে-ওয়ান ওয়ান থ্রি’ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় সিমিয়ান ফ্লুতে আক্রান্ত হয়ে ধ্বংস হবার পথে মানবজাতি। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার কারণে বেঁচে যাওয়া এইপরা সিজারের নেতৃত্বে মুইর উডসে গড়ে তোলে তাদের সাম্রাজ্য। একদল মানুষের সঙ্গে তাদের আকস্মিক সাক্ষাৎ ঘটনার মোড় ঘুরিয়ে দেয়। দলপ্রধান ম্যালকমের মাধ্যমে সিজার জানতে পারে, ভাইরাসের প্রতিষেধক তৈরি হওয়ায় কিছু সংখ্যক মানুষ এখনও বেঁচে আছে পৃথিবীর বুকে। নিজেদের অস্তিত্ত্ব টিকিয়ে রাখতে ম্যালকম সিজারের সাহায্য প্রার্থনা করে, আর সেখান থেকেই বিপত্তির শুরু। অন্তর্দ্বন্দ্ব আর সাংঘর্ষিক মনোভাবে ইঙ্গিত আসে এক অনিবার্য সংঘাতের। শেষপর্যন্ত কি এই বিপর্যয় কাটাতে পারবে মানুষ এবং এইপরা? নাকি অচিরেই এক ভয়াবহ যুদ্ধে পৃথিবীর বুক থেকে বিলীন হয়ে যাবে এই দুই প্রজাতি? উত্তর জানার জন্য টানটান উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষা করতে হবে সিনেমা শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত।

সেকাল-একাল

সিনেমার জগতে ‘এইপ’দের আবির্ভাব ষাটের দশকের শেষে। ফরাসি উপন্যাসিক পিয়ের বুলের উপন্যাস থেকে প্রথম ১৯৬৮ সালে তৈরি হয় ‘প্ল্যানেট অফ দ্য এইপস’। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত মুক্তি পায় সিনেমাটির আরও চারটি সিকুয়াল ‘বিনিথ দ্য প্ল‍্যানেট অফ দ্য এইপস’, ‘এস্কেইপ ফ্রম দ্য প্ল্যানেট অফ দ্য এইপস’, ‘কনকোয়েস্ট অফ  দ্য প্ল্যানেট অফ দ্য এইপস’ এবং ‘ব্যাটল ফর দ্য প্ল্যানেট অফ দ্য এইপস’। 

২০০১ সালে টিম বার্টনের ‘প্ল্যানেট অফ দ্য এইপস’-এর রিমেইক করেন। এরপর আবার এক দশকের বিরতি। ২০১১ সালে রুপার্ট ওয়াইয়াট নিয়ে আসেন প্রিকুয়াল, ‘রাইজ অফ দ্য প্ল্যানেট অফ দ্য এইপস’। বক্স অফিস সাফল্য, জনপ্রিয়তা, সমালোচকের প্রশংসা- সবই অর্জন করে সিনেমাটি। সেই ধারাবাহিকতায় এবার এল ‘ডন অফ দ্য প্ল্যানেট অফ দ্য এইপস’।

এইপদের পেছনের তারকারা

হলিউডে সাই-ফাই অ্যাকশন কিংবা সাই-ফাই থ্রিলার সিনেমা নির্মাণ হচ্ছে অহরহই। তবে, সাই-ফাই ড্রামা ঘরানার সিনেমা নির্মাণ বেশ ঝুঁকিপূর্ণ এবং কষ্টসাধ্যও বটে। কিন্তু এই সিনেমার সাফল্য সম্ভব হয়েছে সিজিআই প্রযুক্তির দক্ষ ব্যবহার এবং সিনেমার কলাকুশলীদের অনবদ্য অভিনয়ের কারণেই। 

সিনেমার কেন্দ্রীয় চরিত্র ‘সিজার’কে রূপ দিয়েছেন অ্যান্ডি সারকিস। যতক্ষণ পর্দায় ছিলেন দর্শকদের নজর নিজের দিকেই ধরে রেখেছেন তিনি। ‘লর্ড অফ দ্য রিংস ট্রিলজি’র গলুম কিংবা ‘টিনটিন’ এর ক্যাপ্টেন হ্যাডক পর্দায় অ্যানিমেটেড চরিত্র রূপদানে এককথায় সিদ্ধহস্ত ৫০ বছর বয়সী এই তারকা। তার অভিনয় দক্ষতা এবং প্রাণবন্ত দেহভঙ্গী সিজার চরিত্রটিকে বাস্তব করে তুলেছে। দুর্ধর্ষ এইপ ‘কোবা’র চরিত্রে টোবি কেবেলও নৈপুণ্য দেখিয়েছেন। 

সিনেমার জগতে তেমন একটা পরিচিত না হলেও ম্যালকম চরিত্রে নিজের সেরাটাই দেওয়ার চেষ্টা করেছেন জেইসন ক্লার্ক। তবে ড্রিফাস চরিত্রে অনবদ্য ছিলেন প্রবীণ অভিনেতা গ্যারি ওল্ডম্যান। অন্যান্য চরিত্রে কেরি রাসেল, কোডি স্মিথ ম্যাকফি, নিক থারস্টন, জুডি গ্রিয়াররা ছিলেন মোটামুটি।

সিজিআই এবং ভিস্যুয়াল ইফেক্টস

সিনেমাটির সবচাইতে আকর্ষণীয় দিক হল এর প্রযুক্তির অসাধারণ ব্যবহার। এইপদের বেঁচে থাকার লড়াইটা বাস্তবিক হয়ে উঠেছে সিনেমার দুর্দান্ত সিজিআইয়ের কাজে। চমৎকার সব ভিস্যুয়াল ইফেক্টস আর মোশন সেন্সরের ব্যবহারে এইপদের অনুভূতিগুলো জীবন্ত হয়ে উঠেছে। অ্যাকশন দৃশ্যগুলোও সেলুলয়েডে এসেছে বাস্তবঘেষা হয়েই। নিপুণ সিনেমাটোগ্রাফির সঙ্গে প্রযুক্তির ব্যবহার- একটি সাই-ফাই সিনেমার সাফল্যের জন্য যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা প্রমাণ করেছে ‘ডন অফ দ্য প্ল্যানেট অফ দ্য এইপস’।

গল্পের খুঁটিনাটি

‘রাইজ অফ দ্য প্ল্যানেট অফ দ্য এইপস’ প্রখর বুদ্ধিমত্তার অধিকারী এইপদের অভ্যুত্থানের চিত্রকল্প নিয়ে এসেছিল। সিজার চরিত্রটি পরিপূর্ণতা পাওয়ায় ‘ডন অফ দ্য প্ল্যানেট অফ দ্য এইপস’-এর মূলগল্পটি ছিল এককথায় শ্বাসরুদ্ধকর। গল্প বলার ধরনেও পারদর্শীতা দেখিয়েছেন পরিচালক ম্যাট রিভস। বেঁচে থাকার জন্য দুইটি জাতির ভয়ঙ্কর সংগ্রামের উপাখ্যান চমৎকারভাবেই তুলে ধরতে পেরেছেন পরিচালক।

‘এইপ’দের নিয়ে নির্মিত প্রত্যেকটি সিনেমার পেছনে লুকিয়ে ছিল কোনো না কোনো একটি বার্তা। পারমাণবিক শক্তির ভয়াবহতা, প্রযুক্তির অপব্যবহার থেকে শুরু করে সাম্প্রদায়িকতা, দাসত্ব, শ্রেণী-বৈষম্য-আরও বিভিন্ন ইস্যু প্রতীকীভাবে উঠে এসেছে এই সিরিজের সিনেমাগুলোতে। ‘ডন অফ দ্য প্ল্যানেট অফ দ্য এইপস’ সিনেমাটিতে মূলত যুদ্ধের ভয়াবহতা ফুটে উঠেছে। ব্যাপারটি আরও ভালোভাবে বোঝা যায় সিনেমার একটি অর্থবহ দৃশ্যের মাধ্যমে। সিটি হলের শীর্ষ টাওয়ারে দেখা যায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পতাকা। ছিন্ন একটি মার্কিন পতাকার ওপরে অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে এইপ কোবা। এইপ এবং মানুষ- দুটি প্রজাতিতেই দেখানো হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন প্রটাগনিস্ট এবং অ্যান্টাগনিস্ট। এইপদের রাজত্বে সিজার এবং কোবার সংঘর্ষ আর মানব সম্প্রদায়ে ম্যালকম এবং ড্রিফাসের স্নায়ুযুদ্ধ- আস্থা ও সংঘাতের চিরকালীন বয়ান তুলে ধরে।

সংক্ষিপ্ত কিন্তু রোমাঞ্চকর এক গল্প নিয়ে নির্মিত সিনেমাটির অ্যাকশন সিকোয়েন্সগুলো ছিল শিহরণ জাগানোর মতো। তবে, গল্পে খুঁত যে একেবারেই নেই, তা কিন্তু নয়। এইপদের মধ্যে নারী চরিত্রগুলো পুরুষের মতই প্রাধান্য পেলেও নিজেদের টিকিয়ে  রাখার লড়াইয়ে মানব সমাজে নারীদের অবদান খুব সামান্যই ছিল সিনেমাজুড়ে। কেরি রাসেলের ‘এলি’ চরিত্রটি একটি বিশেষ দৃশ্য ছাড়া বলতে গেলে পুরো সিনেমাতেই ছিল অপ্রয়োজনীয় এবং গল্পের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট বিস্ফোরণে বেশ কয়েকজন হতাহত হলেও ম্যালকম সেখান থেকে অক্ষত অবস্থায় বেঁচে ফিরলেন- সে দৃশ্য দেখেও দর্শকরা ভ্রু কোঁচকাতে পারেন। আর কিছু কিছু দৃশ্য এতো সহজেই অনুমেয় যা গল্পে ধার কিছুটা হলেও কমিয়ে দেয়। সিজার আর কোবার মধ্যকার সংলাপগুলো বাদে সিনেমার সংলাপ সাধারণ এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে একঘেঁয়ে মনে হতে পারে।

সবশেষ

শিউরে দেওয়া সংঘাত এবং গল্পের নাটকীয়তার মিশেলে ‘ডন অফ দ্য প্ল্যানেট অফ দ্য এইপস’কে একটি সফল সাই-ফাই সিনেমা বলা চলে। নির্মাতারা এরই মধ্যে জানিয়েছেন, ২০১৬তেই আসতে পারে এই সিরিজের আরেকটি সিকুয়াল। দর্শক, সমালোচক- দুটি মহলেই ব্যাপক সমাদৃত হয়েছে ‘ডন অফ দ্য প্ল্যানেট অফ দ্য এইপস’। রটেন টম্যাটোজে ‘৯১ শতাংশ নতুন’ ভোট নিয়ে সিনেমাটি রীতিমতো অবাকই করে দিয়েছে সবাইকে। বক্স অফিসেও সাফল্যের ঘোড়া ছুটছে দুর্দান্ত গতিতে। পরের সিকুয়ালও যে রোমহর্ষক এক গল্প উপহার দিতে যাচ্ছে, তার ইঙ্গিতও রয়েছে ‘ডন অফ দ্য প্ল্যানেট অফ দ্য এইপস’-এ, আর তা এসেছে সিজারের কণ্ঠেই- ‘যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।'

</div>  </p>