হারিয়ে যাওয়া চুম্বন

রাজ্জাক-ববিতা জুটিকে নিঃসন্দেহেই বলা চলে ঢাকাই ছবির অন্যতম সেরা রোমান্টিক জুটি। এই জুটির সবচেয়ে আলোচিত ও সমাদৃত সিনেমা ‘অনন্ত প্রেম’। ৩৭ বছর আগে মুক্তি পাওয়া সিনেমাটির জন্যই চিত্রায়িত হয়েছিল বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের প্রথম চুম্বন দৃশ্য।

শান্তা মারিয়াবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 August 2014, 08:22 AM
Updated : 1 August 2014, 09:06 AM

‘অনন্ত প্রেম’ মুক্তি পায় ১৯৭৭ সালের মার্চ মাসে। সেই সময়ের তুলনায় ছবিটি ছিল দারুণ সাহসী। ছবির শেষ দৃশ্যে নায়ক নায়িকার গভীর চুম্বনের দৃশ্য ছিল যা সেই সময়ে রীতিমতো হইচই ফেলে দিয়েছিল। কিন্তু চুম্বনের দৃশ্য বাদ দিয়েই ছবিটি মুক্তি পায়।

সিনেমাটির গল্পকাঠামোতেও ছিল নতুনত্ব। সিনেমায় দেখা যায় রাজ্জাক এবং তার তিন বন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। ববিতা একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। রাজ্জাকের এক বন্ধু ববিতাকে পছন্দ করে। কিন্তু ববিতা কোনোভাবেই তার প্রেমের প্রস্তাবে সাড়া দেয় না। বন্ধুকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে রাজ্জাক ও তার অন্য দুই বন্ধু ব্ল্যাক আনোয়ার ও এটিএম শামসুজ্জামান। বন্ধুর পরামর্শ মতো তারা তিনজন একটি নির্জন স্থানে ববিতাকে আক্রমণ করে। ববিতার সাহায্যে এগিয়ে আসে সেই বন্ধু। সাজানো মারপিটের মাধ্যমে সবাইকে হারিয়ে সে ববিতার চোখে ‘হিরো’ বনে যায়। পরে বাড়ি পৌছে দেওয়ার নাম করে ববিতাকে একটি নির্জন জায়গায় নিয়ে যায় এবং ধর্ষণ করতে উদ্যত হয়। সে সময় চিৎকার শুনে রাজ্জাক এবং বন্ধুরা এগিয়ে যায়।

এবার সত্যিকারের মারামারির এক পর্যায়ে রাজ্জাকের হাতে ওই বন্ধু খুন হয়ে যায়। বন্ধুর লাশ গাড়ির লাগেজ ক্যারিয়ারে নিয়ে শহরে ফেরে বন্ধুরা। ববিতাকে তার বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে রাজ্জাক পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। এ ঘটনার সঙ্গে একজন নারীর নাম জড়িত হলে তার বদনাম হবে সে কারণে পুলিশের কাছে পুরো ঘটনা খুলে না বলে রাজ্জাক বলেন টাকা নিয়ে ঝগড়ার কারণে বন্ধুকে খুন করেছেন তিনি একাই। পরে পুলিশ হেফাজত থেকে পালান তিনি।

অন্যদিকে শৈশবে মাতৃহীন ববিতা সৎ মায়ের অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য আসছিলেন। কিন্তু এক লম্পট ব্যক্তির সঙ্গে তার বিয়ে দিতে চাইলে বিয়ের আসর থেকে তিনিও পালান। ট্রেনে রাজ্জাক ও ববিতার আবার দেখা হয়ে যায়। দুজনেই পালিয়ে চলে যায় পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম অরণ্যে। সেখানে নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে তারা একে অপরের প্রেমে পড়ে যান।

ব্ল্যাক আনোয়র ও এটি এম শামসুজ্জামান পুলিশের কাস্টডি থেকে পালাতে গিয়ে গুলি খেয়ে মারা যান। ফলে প্রকৃত ঘটনার সাক্ষী দেওয়ার মতো কেউ থাকে না। রাজ্জাকের নামে পুলিশের হুলিয়া জারি হয়। অরণ্যের গভীরে প্রেমিক প্রেমিকা তাদের সুখের নীড় গড়ে তোলে।

পুলিশ এক পর্যায়ে নায়ক-নায়িকার সন্ধান পায়। অরণ্যের মধ্যে তাদের ধাওয়া করে পুলিশ। পালিয়ে বাঁচার জন্য সীমান্ত পাড়ি দিতে যায় তারা। একটি ঝর্ণা পার হওয়ার সময় পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয় দুজনের। মৃত্যুর সময় পরস্পরকে চুম্বন করেন তারা। শেষ পর্যন্ত ঝর্ণার তীরে পড়ে থাকে প্রেমিক প্রেমিকার আলিঙ্গনাবদ্ধ প্রাণহীন দেহ।

‘অনন্ত প্রেম’ রাজ্জাক পরিচালিত প্রথম ছবি। প্রযোজকও ছিলেন তিনি। রাজলক্ষী প্রোডাকশনসের ব্যানারে নির্মিত সিনেমাটি ছিল সুপার ডুপার হিট।

এ ছবির সংগীত পরিচালক ছিলেন আজাদ রহমান। ‘এপার ওপার’ ছবির মতো অসাধারণ কাজ উপহার দিয়েছিলেন তিনি এ ছবিতেও। এ ছবির একটি গান সময়ের স্পর্শ বাঁচিয়ে বাংলা চলচ্চিত্রের ক্ল্যাসিক গানে পরিণত হয়েছে। গানটি হলো খুরশিদ আলম ও সাবিনা ইয়াসমিনের গাওয়া “ও চোখে চোখ পড়েছে যখনি”। কাপ্তাইয়ের অসাধারণ সুন্দর লোকেশনে শুটিং হয়েছিল। শেষ দৃশ্যটি ছাড়াও ববিতা-রাজ্জাকের প্রেমের বেশ কিছু সাহসী দৃশ্য ছিল এতে। অভিনয় এতটাই প্রাণবন্ত ও স্বাভাবিক হয়েছিল যে দুজনের মধ্যে বাস্তবজীবনেও প্রেম চলছে এমন গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে ছবি মুক্তির পর। এ ছবির জন্য ববিতা ৫০ হাজার টাকা পারিশ্রমিক তো নিয়েছিলেনই আরও অতিরিক্ত ২০ হাজার নিয়েছিলেন চুম্বন দৃশ্যের জন্য, যা সে সময় ছিল অকল্পনীয় সাহসিকতা।

রাজ্জাক এক স্মৃতিচারণে বলেছিলেন, ববিতা নাকি দৃশ্যটি করার পর খুব নার্ভাস হয়ে পড়েন। তিনি তখনও অবিবাহিত ছিলেন। ভয় পেয়েছিলেন এমন একটি দৃশ্যে অভিনয় করার পর তার হয়তো আর বিয়ে হবে না। পরবর্তীতে তিনি অবশ্য দৃশ্যটির শিল্পিত রূপ দেখে মুগ্ধ হন। ওই সময়ের বিখ্যাত চলচ্চিত্র বিষয়ক পত্রিকা ‘চিত্রালী’তে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সেন্সর বোর্ডও দৃশ্যটিকে ছাড়পত্র দিয়েছিল। ওই প্রতিবেদনে রাজ্জাক বলেছিলেন, “মানুষের স্বাভাবিক আচার আচরণকে স্বাভাবিকভাবে আসতে না দিলে ছবিতে অশ্লীলতা এবং বিকৃতি আসতে বাধ্য। ঢাকার অসংখ্য ছবিতে এর প্রমাণ রয়েছে। আমার ছবিতে একটিও অশ্লীল দৃশ্য নেই। আমি দৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে বলতে পারি-- আমার ছবির চুম্বন দৃশ্যটাকে কারো কাছেই অশ্লীল মনে হবে না।”

শেষমুহূর্তে অবশ্য দৃশ্যটাকে বাদ দেওয়া হয়। সেন্সর বোর্ডের সবুজ সংকেত থাকা সত্ত্বেও ঠিক কি কারণে নির্মাতারা দৃশ্যটিকে রাখেননি-- সেটি এখনও স্পষ্ট নয়।

দৃশ্যটি রেখে দেওয়া হলে, সেটিই হতো বাংলা সিনেমার প্রথম গভীর চুম্বন দৃশ্য। চিত্রালীর দাবি অনুযায়ী, এর আগে বাংলা সিনেমায় চুমুর দৃশ্য এলেও, সেগুলো ছিল মূলত চুম্বনের ইঙ্গিতবাহী, সরাসরি চুম্বন নয়। আবার বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩ সালের সিনেমা ‘কাঁচের স্বর্গ’তেও পরিচালক ই আর খান একটি চুমুর দৃশ্য রেখেছিলেন, যা পরে বাদ দেওয়া হয়।

“১৯৭৩ সালে পরিচালক ই আর খান ‘কাঁচের স্বর্গ’ ছবিতে লোকান্তরিত শিল্পী রাজু আহমেদ এবং শিউলি আহমেদের একটি চুম্বন দৃশ্য চিত্রায়িত করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দৃশ্যটি ছবিতে থাকেনি। তবে ‘চুমু-চুমু ভাব’ সম্বলিত কিছু ছবি অবশ্য ঢাকায় মুক্তি পেয়েছে।”

শুধু সাহসী দৃশ্যের জন্যই নয়, ‘অনন্ত প্রেম’ দর্শকের মন জয় করেছিল এর অসাধারণ পরিচালনা, অভিনয়, সংলাপ, দৃশ্যায়ন আর সংগীতের জন্য। বিশেষ করে দুজন ভাগ্যতাড়িত নরনারীর প্রেমকে শিল্পসার্থকভাবে পর্দায় তুলে ধরেছিল ছবিটি। ববিতার সেই সময়ের অসাধারণ সৌন্দর্য ও গ্ল্যামার ছবির সাফল্যে বড় ভূমিকা রেখেছিল। ছবিটি সাদা কালো হলেও গানের দৃশ্য ও শেষ দৃশ্য ছিল রঙিন।

ছবিটিতে আরও অভিনয় করেছিলেন রওশন জামিল, কাজী এহসান, খলিল, ওবায়দুল হক সরকার। ছবির প্রেমের দৃশ্যে দর্শক যেমন আবেগ আপ্লুত হয়েছে তেমনি শেষ দৃশ্যে বিয়োগান্তক পরিণতি দেখে চোখ মুছতে মুছতে হল থেকে বেরিয়েছে। এবং ভালোলাগার দৃশ্যগুলো দেখতে আবার টিকেট কেটে হলমুখী হয়েছে। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত নির্মিত প্রেমের ছবির মধ্যে নিঃসন্দেহে অন্যতম সেরা রাজ্জাক-ববিতা জুটির ‘অনন্ত প্রেম’।

ছবি কৃতজ্ঞতা: বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ।