মুভি রিভিউ: এজ অফ টুমরো

‘টপ গান’ থেকে শুরু করে 'মিশন ইম্পসিবল’ সিরিজ - টম ক্রুজের অ্যাকশন ঘরানার সিনেমার ভক্ত যারা, তাদের জন্য বাড়তি সাই-ফাই চমক নিয়ে এসেছে ‘এজ অফ টুমরো’। থ্রিডি প্রযুক্তির ব্যবহারে এই সিনেমার ধুন্ধুমার অ্যাকশন সিকোয়েন্সগুলো দর্শকের নজর কাড়বেই।

শরীফুল হক আনন্দবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 July 2014, 07:22 AM
Updated : 26 July 2014, 09:34 AM

লিভ, ডাই, রিপিট

সিনেমার গল্প শুরু হয় এমন এক সময়ে যখন পৃথিবীর মানুষ ভিনগ্রহবাসীদের আগ্রাসনের মুখোমুখি। মিমিক আর আলফাদের প্রধান মাস্টারমাইন্ড ওমেকার আক্রমনে ইতোমধ্যেই মানব সভ্যতার একটি বিরাট অংশ বিলীন হয়ে গেছে। পাবলিক অ্যাফেয়ার্স অফিসার উইলিয়াম কেইজ (টম ক্রুজ) ন্যাটোর নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড ডিফেন্স ফোর্সের প্রধান অফিসার ব্রাইহাম (ব্রেন্ডান গ্লিসন) এর সঙ্গে দেখা করতে এসে হন গ্রেফতার। তাকে তার পদ থেকে সরিয়ে নামিয়ে দেওয়া হয় সাধারণ এক সৈনিকের পদে। জে স্কোয়াডের সদস্য হিসেবে মিমিক এবং আলফাদের ধ্বংসলীলা ঠেকাতে তাকে নামতে হয় যুদ্ধে। কিন্তু বিপত্তিটা বাঁধে নীলাভ আলফার রক্ত কেইজের শরীরে লেগে যাওয়ার পর। টাইম-লুপের ফাঁদে পড়ে সে দেখা পায় ‘ফুল মেটাল লেডি’ রিটা ভ্রাটাস্কির (এমিলি ব্লান্ট)। জীবন-মৃত্যুর এই চক্র থেকে বেরিয়ে তাদের এগিয়ে যেতে হবে এলিয়েনদের প্রধান ওমেগাকে ধ্বংস করার জন্য। কিভাবে তারা এই অসম্ভবকে সম্ভব করবে? আদৌ কি বন্ধ হবে বাঁচা আর মরার মধ্যে কেইজের ঘুরপাক খাওয়া?  

সাই-ফাই রোমাঞ্চ

সিনেমাটির প্রধান আকর্ষণই হল থ্রিডি প্রযুক্তি ও কম্পিউটার জেনারেটেড ইমেজের (সিজিআই) ব্যবহারে অসাধারণ নৈপুণ্য।একটি সফল অ্যাকশন সিনেমা তৈরির যাবতীয় মশলা দেওয়া হয়েছে সিনেমাটিতে। ক্যামেরার পেছনে পরিচালক ডাগ লিম্যান এবং সিনেমাটোগ্রাফিতে ডিওন বেবে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। 

প্রত্যাশার চাপ

টম ক্রুজ এবং এমিলি ব্লান্ট-এর মত তারকাদের নিয়ে বড় বাজেটের 'এজ অফ টুমরো' দর্শকদের প্রত্যাশার পারদ ছিল অনেক উঁচুতেই তুলে দিয়েছিল। 

ক্রুজের সবশেষ সিনেমা ‘অবলিভিওন’ও ছিল সাই-ফাই এবং টাইম-লুপকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল এর কাহিনি। 'অবলিভিওন' সিনেমাতে একই সময়ের ফ্রেমে যেভাবে ঘুরপাক খান ক্রুজ, 'এজ অফ টুমরো' গল্পেও তার ভুমিকা খুব বেশি আলাদা কিছু মনে হয়নি। একই ধাঁচের গল্পকাঠামোর সাই-ফাই সিনেমায় অভিনয় করে দর্শকদের নতুন কিছু উপহার দেওয়া বেশ চ্যালেঞ্জিংই ছিল ক্রুজের জন্য। 

সেই চ্যালেঞ্জে ভালভাবেই উৎরে গেছেন ক্রুজ। অ্যাকশন আইকন থেকে বেরিয়ে হতবুদ্ধি, বিব্রত কিন্তু পরিশ্রমী এক অফিসারের ভূমিকায় টম ক্রুজ অভিনেতা হিসেবে তার অভিজ্ঞতারই পরিচয় দিয়েছেন।  

এর আগে ‘লুপার’ নামে আরও একটি সাই-ফাই অ্যাকশন সিনেমায় অভিনয় করলেও একজন যোদ্ধার চরিত্রে প্রথমবারে র মতই দেখা গেছে ব্রিটিশ অভিনেত্রী এমিলি ব্লান্টকে।  তবে 'ফুল মেটাল লেডি’ চরিত্রের মারকুটে দিকটি যথাযথভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারেননি তিনি। বিশেষ করে বিভিন্ন অ্যাকশন সিকোয়েন্সে সামুরাই তরবারি হাতে ব্লান্টকে ভাবলেশহীন বলে মনে হয়েছে। 

সার্জেন্ট ফেরেলের চরিত্রে বিল প্যাক্সটন ছিলেন অনবদ্য। অন্য চরিত্রগুলোতেও অভিনয় নৈপুণ্য দেখিয়েছেন মোটামুটি সবাই। 

পরিচালকের দৃষ্টিকোণ

জাপানি লেখক হিরোশি সাকুরাজাকার উপন্যান ‘অল ইউ নিড ইস কিল’ এর ওপর ভিত্তি করে নির্মীত সিনেমাটিতে পরিচালক ডাগ লিমান নন লিনিয়ার বা বিচ্ছিন্ন গল্পপ্রবাহের রীতি ব্যবহার করেছেন। 

‘দ্য বর্ন আইডেন্টিটি’র মত সিনেমা পরিচালনা করা লিমান দক্ষতা দেখিয়েছেন অন্য সাই-ফাই সিনেমাগুলোর পুরনো তত্ত্বগুলোকে নতুন ভাবে সাজাতে। কিন্তু, যারা সাই-ফাই সিনেমা থেকে একটু দ্রুত গল্পের পরিবর্তন এবং জমজমাট ক্লাইম্যাক্স চান- তাদের কাছে এই সিনেমা কিছুটা বিরক্তিকর মনে হতে পারে। কারণ, টাইম-লুপের বিষয়টি বোঝানোর জন্য কিছু দৃশ্য এবং সংলাপ বার বার ফিরে এসেছে । সিনেমাতে সিকোয়েন্সের বৈচিত্র অনেক কম এবং একটি দৃশ্যই বারবার দেখানোতে একঘেয়েমি সৃষ্টি হয়। 

তবে সিনেমাটির কিছু অংশের দৃশ্যায়নে ক্লাসিক কিছু সিনেমা থেকে অনুপ্রাণীত হওয়ার বিষয়টি লক্ষ্যনীয় । অফিসার বেইস ক্যাম্পে কেইজ এবং সার্জেন্ট ফেরেলের সংলাপে পরিচালক স্ট্যানলি কুবরিকের বিখ্যাত সিনেমা ‘ফুল মেটাল জ্যাকেট’- এর আবহ পাওয়া গেছে কিছুটা। আর সমুদ্রসৈকতে ভিনগ্রহবাসীদের আগ্রাসন ঠেকাতে কেইজ এবং অন্য সৈনিকদের আগমনের দৃশ্যটি স্টিভেন স্পিলবার্গ এর ‘সেভিং প্রাইভেট রায়ান’ সিনেমার একটি দৃশ্যের রূপান্তর বলেই মনে হয়।

লিমানের মূল সাফল্য সাই-ফাই অ্যাকশনের সার্থক দৃশ্যায়ন। সমুদ্রসৈকতে মিমিকদের আক্রমণ ঠেকাতে কেইজবাহিনীর প্রতিরোধ কিংবা ওমেগাকে ধ্বংস করতে প্যারিসের লুভর মিউজিয়ামের জমজমাট ক্লাইম্যাক্স দর্শকদের বিনোদন দেবেই। সিনেমার সংলাপগুলোও ছিল বেশ প্রাণবন্ত।

রাজনীতির হাল হকিকত

বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে মূল গল্পের একটি সম্পূরক সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে সিনেমাটি। সিনেমার শুরুতে গোটা বিশ্বের সব জাতির সৈন্যদের নিয়ে ‘ইউনাইটেড ডিফেন্স ফোর্সে’র মত একটি সেনাবাহিনী দেখানো হলেও তাতে বৈশ্বিক বৈচিত্রের ব্যাপারটি অনুপস্থিত। ব্রিটিশ এবং স্কটিশ সেনাদের দেখা গেলেও এশিয়া কিংবা আফ্রিকা মহাদেশের কোনো প্রতিনিধি দেখা যায়নি। সিনেমার নায়ক উইলিয়াম কেইজ ছাড়া পুরো বাহিনীতে আর কোনো মার্কিনিও চোখে পড়ে না।

সিনেমার আরেকটি অদ্ভুত বিষয়, এর গল্পকাঠামোতে সমসাময়িক রাজনীতিকে টেনে আনার ব্যাপারটি। ‘এজ অফ টুমরো’র গল্প খুব বেশিদিন পরের নয়, সেটা বোঝাতেই হয়তো, সিনেমার শুরুতে দেখা যায়, মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন এক জোট হয়েছেন দুনিয়া বাঁচানোর স্বার্থে। ব্যাপারটি বর্তমান যে কোন রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে বেমানান হলেও পরিচালক বিশ্ব মোড়লদের একত্রে এনে দর্শকদের কি বোঝাতে চেয়েছেন, সেটা দুর্বোধ্যই থেকে গেছে সিনেমার শেষ পয‍র্ন্ত।

সবশেষ

‘এজ অফ টুমরো’ মুক্তি পাবার পর থেকে বেশ জমজমাট ব্যবসা করে যাচ্ছে বক্স অফিসে। ইতোমধ্যে বিশ্বজুড়ে আয় করেছে ৩৫ কোটি মার্কিন ডলারেরও বেশি। এমনকি অধিকাংশ সমালোচকদেরও মুখ খুলতে দেয় নি সিনেমাটি৤ রোটেন টমেটোস এ ’৯০ শতাংশ নতুন’ ভোটই যার প্রমাণ।