বাবার রেকর্ডকৃত গানগুলো নতুন করে গাইবেন আগুন।
Published : 13 Dec 2013, 04:53 PM
বাংলা চলচ্চিত্র ও সংগীতের কিংবদন্তি খান আতাউর রহমানের ৮৫তম জন্মবার্ষিকী ছিল বুধবার। জন্মদিনে বাবাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন তার ছেলে কণ্ঠশিল্পী ও অভিনেতা আগুন। গ্লিটজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন বাবার স্মৃতি সংরক্ষণ এবং প্রসারে উদ্যোগী হবেন তিনি।
গ্লিটজ: প্রথমত আপনি গানের মানুষ। আপনার সংগীতজীবনে খান আতাউর রহমানের অবদান কতটুকু?
আগুন: গানে হাতেখড়ির আগে বাবা আমাকে একটি বাঁশি কিনে দিয়েছিলেন। নিজে নিজেই একদিন সুর তুললাম। বাবা বোঝলেন, যার রক্তে সুর মিশে আছে, তাকে দিয়ে গান হবেই। একদিন বাবাকে বাজিয়ে শোনালাম। খুব আহামরি না হলেও বাবা মুগ্ধ হলেন। আমাকে উৎসাহ দিলেন। আসলে আমার যে কোনো সৃজনশীল কাজে বাবা উৎসাহ দিতেন। ক্লাস থ্রিতে যখন প্রথম হারমনিয়াম ধরলাম, ভীষণ কষ্ট হত সুর তুলতে। আমার অনেকদিন লেগেছিল হারমনিয়াম আয়ত্ব করতে। বাবা নিরাশ হতেন না। তিনি বলতেন, ‘তুমি পারবে।’
ক্লাস টেনে আমি ‘সাডেন’ নামে একটা ব্যান্ড গঠন করি। উচ্চ মাধ্যমিকে এসে ব্যস্ততা বেড়ে গেল। নিয়মিত টিভি প্রোগ্রাম ও স্টেজ শোতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। বাবা তখন উৎসাহ দিতেন, আমাদের চর্চা কেমন চলছে সে ব্যাপারে খোঁজ নিতেন।
একদিন ডাক আসে প্লেব্যাকের। ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ সিনেমার প্লেব্যাকের পর নাম কুড়াতে শুরু করলাম। আমার ব্যস্ত হয়ে পড়া বাবা দেখে যেতে পেরেছেন। সন্তান হিসেবে এ আমার সৌভাগ্য। আমি মনে করি, আমার উপর বাবার দোয়া সবসময় আছে।
গ্লিটজ: অভিনেতা হিসেবে বাবার প্রভাব কতটুকু?
আগুন: বাবাকে দেখে যে আমি অভিনয়ে উৎসাহী হয়েছি এমনটা নয়। নিজস্ব ভালোলাগা থেকে অভিনয়ে এসেছি। ভালো চিত্রনাট্য, নির্মাতা পেয়েছি বলে সিনেমাতেও অভিনয় করছি। তবে এটা সত্যি যে, বাবা আমার মধ্যে চিন্তার বীজ বুনে দিয়েছিলেন। ছোটবেলা থেকেই বাবার সঙ্গে এফডিসি যেতাম। কলাকুশলীদের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। অভিনয়ের প্রাথমিক শিক্ষাটা বাবার কারণে পেয়েছি। প্রতিরাতে আমাদের বাসায় অভিনেতা, গায়করা আসতেন। তাদের আড্ডা আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে।
আগুন: মোস্তফা মননের ধারাবাহিক ‘জীবন থেকে নেয়া’তে আমি রাজ্জাক অভিনীত ‘ফারুক’ চরিত্রে রূপদান করছি। এ নাটকে অভিনয় করতে গিয়ে আমি বাবার চরিত্রটি মনে করতে চেষ্টা করি। বাবা কী সাবলীল অভিনয় করেছেন। বাবার সংলাপগুলো মনে করি।
গ্লিটজ: খান আতার তিনটি সিনেমার স্বত্ব আপনাদের। এই তিনটি সিনেমা পুনর্নির্মাণ করতে চাইলে করণীয় কী?
আগুন: ‘নবাব সিরাজদ্দৌলা’,‘এখনও অনেক রাত’ এবং ‘আবার তোরা মানুষ হ’ এ তিনটি সিনেমার স্বত্ব আমাদের। বাকিগুলো বাবা বিক্রি করে দিয়েছেন। সেই সিনেমাগুলোর মালিকরা যদি পুনর্নির্মাণ করতে চান সে উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। আমাদের তিনটি সিনেমা যদি কেউ পুনর্নির্মাণ করতে চান, সেক্ষেত্রে পুরো পরিকল্পনা শোনার পর আমরা অনুমতি দেব। এ সিনেমাগুলোতে বাবার চরিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব পেলে আমি অভিনয় করব। বাবার চরিত্রে অভিনয় করাটা দারুণ ব্যাপার।
গ্লিটজ : তার কোন সিনেমাটি আপনার মনে দাগ কেটেছে?
আগুন: বাবা অভিনীত প্রথম সিনেমা ‘জাগো হুয়া সাভেরা’। এ সিনেমাতে বাবার অনবদ্য অভিনয় আমাকে মুগ্ধ করেছে। ওটা দেখে আমরা ঘাবড়ে গিয়েছিলাম, পঞ্চাশ দশকে এমন সিনেমা নির্মাণ সম্ভব! জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’, তার পরিচালিত ‘মনের মত বউ’, ‘এ দেশ তোমার আমার’,‘কখনও আসেনি’, ‘আবার তোরা মানুষ হ’, সিনেমাগুলোতে বাবার অভিনয় আমাকে মুগ্ধ করেছে।
গ্লিটজ: তার সঙ্গে সিনেমা দেখতে যাওয়ার কোনো মজার স্মৃতি আছে?
আগুন: বাবার সঙ্গে প্রচুর সিনেমা দেখেছি। আমরা যখন মোহাম্মদপুরে ছিলাম প্রায় বিকালেই বাবার সঙ্গে বিভিন্ন হলে যেতাম। বাংলা, ইংরেজি মিলিয়ে প্রচুর সিনেমা দেখেছি। বাবার সঙ্গে শেষ দেখা সিনেমা ‘সুজনসখী’। বাবা পরিচালিত সিনেমাটি পুনর্নির্মাণ করেছিলেন শাহ আলম কিরণ। এ সিনেমায় আমি প্লেব্যাক করেছি।
আগুন: বাবার সত্যি কথা বলার গুণটি আমাকে মুগ্ধ করেছে। তিনি কখনও মিথ্যার আশ্রয় নেননি। আর কোনো ব্যাপার পছন্দ না হলে বাবা মুখের উপর ‘না’ বলে দিতেন।
গ্লিটজ: জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে বাবার ভূমিকা কতটুকু?
আগুন: বাবা সবসময় ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যে বিশ্বাস করতেন। ছোটবেলা থেকেই সে শিক্ষা পেয়েছি। আমি যখন প্রাইমারির গণ্ডি পেরিয়ে হাইস্কুলে যাব, বাবা একদিন জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি আসলে কী হতে চাও।’
আমি কখনও বলতাম পাইলট হব। কখনও প্রকৌশলী বা বিজ্ঞানী হতে চেয়েছি। সবকিছু নিয়েই আমার জানার তুমুল আগ্রহ দেখে বাবা মুগ্ধ হতেন। আমি কখনও বাবা-মাকে অনুসরণ করতে চাইনি। আমি আমার মতো করে বড় হতে চেয়েছি। বাবা আমার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। আমাকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছেন বাবা।
গ্লিটজ: সন্তান হিসেবে তার কাজগুলো কীভাবে এগিয়ে নিচ্ছেন। তার স্মৃতি সংরক্ষনেই-বা কী উদ্যোগ নিয়েছেন?
আগুন: বাবা প্রচুর সিনেমাতে অভিনয় করেছেন। সংগীত পরিচালনা করেছেন। প্রতিটি সিনেমাই ইতিহাস তৈরি করেছে। বাবার গানগুলো নিয়ে কাজ করছি। আমার বোন রোমানা ইসলাম বাবার সেরা গানগুলো নিয়ে ‘অস্তিত্ব’ শিরোনামে একটি অ্যালবাম করেছে। আমি একটি অ্যালবামে বাবার একটি গান গেয়েছি। বাবার গান তো অনেকেই গেয়েছেন। সত্যি কথা হল, বাবার অধিকাংশ গানের রেকর্ডিং ভালো নয়। সে রেকর্ডিং শুনে গান তোলা খুব কষ্টসাধ্য। এ গানগুলো পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছি। যারা খান আতার গান শুনতে চায়, নিজেরা গাইতে চায় তাদের জন্য একটি অ্যালবাম প্রকাশের পরিকল্পনা আছে।
আগুনের ছবি তুলেছেন ইশরাত জাহান মনি।