ফিদেল ছিলেন আলোকবর্তিকা, কিউবা ছিল স্বপ্নের দেশ: সুমন

তিনি ছিলেন কিউবান বিপ্লবের অবিসংবাদিত নেতা। তার মৃত্যুতে কেবল কিউবা নয়, কেঁদেছে গোটা বিশ্বের সাম্যবাদের স্বপ্ন দেখা কোটি কোটি মানুষ। কিংবদন্তি ফিদেল কাস্ত্রোকে এবার নিজের মতো করে শ্রদ্ধা জানালেন ভারতীয় সংগীতশিল্পী কবীর সুমন। বাংলা ভাষার খেয়াল আঙ্গিকের একটি গান তিনি গেয়েছেন কাস্ত্রোকে নিয়ে। ভাটিয়ার রাগে গাওয়া খেয়াল বন্দীশটি প্রকাশ করেছেন মঙ্গলবার দুপুরেই।

সেঁজুতি শোণিমা নদীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 Nov 2016, 01:25 PM
Updated : 29 Nov 2016, 05:56 PM

‘আপনি ছিলেন বলে সাহস ছিল’ শিরোনামের গানটিকে সুমন অভিহিত করেছেন ‘তাদের সময়ের আলোকবর্তিকা’ ফিদেল কাস্ত্রোকে তার স্মরণের আশ্রয় হিসেবে।

এ বিষয়ে কবীর সুমন-এর সঙ্গে মঙ্গলবার বিকালে টেলিফোনে কথা হয় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।

তিনি বলেন, “আমাদের প্রজন্মের জন্য ফিদেল কাস্ত্রোর অনুপ্রেরণা ছিল প্রচণ্ড রকম। একটা সময় ছিল, যখন বাঙালি মধ্যবিত্ত যুবক-যুবতীরা বিপ্লবের স্বপ্ন দেখত তাকে ভেবেই। ওই সময়ে, ফিদেল ছিলেন আমাদের আলোকবর্তিকা, কিউবা ছিল স্বপ্নের দেশ।”

নিকারাগুয়ার ঐতিহাসিক সান্দানিস্তা বিপ্লব একজন সাংবাদিক হিসেবে খুব কাছ থেকে দেখেছেন সুমন। সেই সময়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন বই, ‘মুক্ত সান্দানিস্তা’। উত্তাল ওই সময়টাতে ফিদেল-এর আদর্শই তাকে পথ দেখিয়েছে বলে জানান তিনি।

ছবি: কবীর সুমন-এর ফেইসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে নেওয়া

তার ভাষ্যে, “আমি তো বিপ্লবের জন্য কিছু ত্যাগ করিনি; কিন্তু ফিদেল, রাউল, চে গেভারা- এরা আমাদের বিপ্লব নিয়ে ভাবিয়েছেন, স্বপ্ন দেখিয়েছেন। তরুণ বয়সে, যখন আমি নিকারাগুয়ায় গেলাম, সান্দানিস্তা কাফের সেই সময়টা, তখন কিন্তু ফিদেল-এর প্রতি বিশ্বাসই আমাদের শক্তি যুগিয়েছে।”

জার্মানিতে ডয়েচে ভেলের বাংলা বিভাগে কাজ করার সময় সুমন-এর পরিচয় ঘটে বাংলাদেশি তরুণ আল-ফারুক আবদুল্লাহ্-এর সঙ্গে। সেইসময় থেকেই গভীর বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া এই মানুষটিকেই নিজের সাম্প্রতিকতম গানটি উৎসর্গ করেছেন তিনি।

তিনি বলেন, “বাংলোদেশের নাগরিকদের জন্যও ফিদেল যে অনেক বড় অনুপ্রেরণার নাম, এটা আমি বুঝতে পারলাম, তাদের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে। আমাদের বয়স তখন ২৮-২৯ হবে, সালটা ১৯৭৮। জার্মানিতে দেখা হলো আল-ফারুক আবদুল্লাহ আর শাহজাহান ফারুকদের মতো তরুণদের সঙ্গে। গোটা বিশ্বের অবস্থাই তখন টালমাটাল; বাংলাদেশ তখন সদ্য যুদ্ধের ক্ষত থেকে ওঠা স্বাধীন এক দেশ, ইরিত্রিয়া, অ্যাঙ্গোলা, সাউথ আফ্রিকার মতো দেশগুলোতে চলছে বর্ণবাদ নিয়ে শেতাঙ্গদের বিরুদ্ধে লড়াই; বিপ্লবের আগুন জ্বলছে দক্ষিণ আমেরিকাতেও; নিকারাগুয়া, হন্ডুরাস আর এল-সালভাদোরের মতো দেশগুলোতে।”

স্মৃতির পাতা উল্টে তিনি বলতে থাকেন, “আমি দেখলাম, বাংলাদেশের যুবকেরাও ওইসময় একইভাবে আন্দোলিত। বিশেষ করে আমার বন্ধু আল-ফারুক আবদুল্লাহর সঙ্গে দীর্ঘ সময় ধরে আলাপ হতো। নিকারাগুয়ায় যেদিন গেলাম, তার আগের রাত্তিরে ফারুকের বাসায় খেতে গিয়েছিলাম। সেই রাত্তিরের কত গল্প, কত স্মৃতি!”

“আমি এই গানটি ফারুককে উৎসর্গ করেছি সেসব স্মৃতির কথা মনে করেই। আমি নিশ্চিত, গানটি শুনে ফারুক মুচকি হেসে ভাববে, সেইসব সময়ের কথা, যখন ফিদেলকে ভেবে আমরা একসাথে উদ্বেল হয়েছি, আন্দোলিত হয়েছি।”

আল-ফারুক আবদুল্লাহ: ডয়েচে ভেল-এর বাংলা বিভাগের সাবেক প্রধান আল-ফারুক আবদুল্লাহকে সুমন উৎসর্গ করেছেন গানটি

চে গেভারা পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন বহু আগেই; সেই পথে পাড়ি জমালেন কাস্ত্রোও। নেই নেলসন ম্যান্ডেলাও। চে, কাস্ত্রোর দেখানো পথে ভেনেজুয়েলায় বিপ্লব আনা নেতা উগো চাবেসও গত হয়েছেন অনেকদিন। সুমন বললেন, তাদের সময়ের নায়কদের একে একে প্রস্থানের কালে পৃথিবীটাকে বড় নিঃসঙ্গ লাগে তার।

“দেখুন, ফিদেল মারা গেলেন নব্বই বছর বয়সে; তাই তার মৃত্যুকে অকাল প্রয়াণ আমি বলবো না। আর কিছুদিন পরে আমি পা দেব সত্তরে; এই বুড়ো বয়সে এসে ভাবি, আমাদের যৌবনের বীরেরা এখন আর কেউ নেই। পৃথিবীটাকে বড় নিঃসঙ্গ লাগে।”

মূলত বিপ্লবের গল্প, বিদ্রোহের কথা আর স্বাধীনতার আঁশ নিয়ে সহজ কথায় সরল লয়ে আধুনিক আঙ্গিকে এতোদিন গান গেয়ে এলেও, এবার রাগাশ্রয়ী খেয়াল কেন গাইলেন, সে কথাও স্বভাবসুলভ কৌতুকে জানিয়ে দিলেন সুমন।

“এই গানটি কিন্তু আধুনিক বাংলা গান হিসেবে আমি তৈরি করিনি, এটা হলো বাংলা খেয়াল। আপনারা হয়তো আশ্চর‌্য হবেন; ভাবতে পারেন বুড়ো বয়সে লোকটার কী মাথাটা খারাপ হলো? আমি বলবো, তা কেন হবে? নিশ্চয়ই তা নয়। আর খেয়াল যে কেবল হিন্দুস্থানী হবে, হিন্দিতে ‘সাইয়া সাইয়া’ করলেই যে খেয়াল হয়ে যায়- তা কেন? বাংলাতেও তো খেয়াল হতে পারে!”

তিনি আরও বলেন, “আমি আসলে দীর্ঘ দিন ধরেই টুকটুক করে বাংলা খেয়াল নিয়ে কাজ করছি। এটাও সেরকম একটি প্রয়াস। আসলে এই বুড়ো বয়সে এসে ফিদেলকে কী করে মনে রাখবো, এই চিন্তা থেকেই গানটিকে খেয়াল হিসেবে তৈরি করা, যেখানে আমি বারবার ‘আপনি ছিলেন বলে সাহস ছিল’ বলতে পারবো; সঙ্গে একটু সারগামাও করতে পারব। সেকারণেই গানটি এভাবে গাওয়া।”

যাকে উৎসর্গ করে গানটি গাওয়া, সেই আল-ফারুক আবদুল্লাহ সাদর অভ্যর্থনা জানিয়েছেন বন্ধুর এই উদ্যোগকে।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দযোদ্ধা, ডয়েচে ভেলের বাংলা বিভাগের এই সাবেক প্রধান গ্লিটজকে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করে বলেন, “কবীর সুমন পরম ভালোবাসায় ভাটিয়ারি রাগে একটি বাংলা খেয়াল বন্দীশ আমায় উৎসর্গ করেছেন।গর্ব হচ্ছে, খুবই আনন্দ হচ্ছে।”

তিনি আরও বলেন, “নানা অনুষঙ্গে সুমন আমায় মাঝ মাঝে স্মরণ করেন। ফিদেল কাস্ত্রোর প্রয়াণে স্বভাবতই আমরা ব্যথিত। কিউবা, কাস্ত্রো, চে গেভারা, নিকারাগুয়া নিয়ে আমাদের সময় কেটেছে একদা। জার্মানিতে ডয়েচে ভেলের বাংলা বিভাগে এবং ওয়াশিংটন ডিসিতে বাংলা অনুষ্ঠানের কর্মী হিসেবে বহু বছর আমাদের একসঙ্গে কেটেছে- বন্ধুর মতো, ভাইয়ের মতো।”

বন্ধুর প্রতি কৃতজ্ঞতাও জানালেন তিনি, “আমরা দুজনই মনে করি ফিদেল কাস্ত্রো মরেন না, চিরায়ত থাকেন। সুমন এই যে নতুন খেয়াল আমাকে উৎসর্গ করলেন, এটা কাস্ত্রোর প্রতি তার শ্রদ্ধা জ্ঞাপন। বাংলা গানকে সুমন যা দিয়েছে, তার জন্য আমরা তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকব। এবার বাংলা খেয়াল নিয়ে তার নিরলস চর্চার পরিচয় পাচ্ছি। বন্ধু কবীর সুমন সুস্থ থাকুক, আরও গান আমাদের উপহার দিক, সংগীত চর্চা নিয়ে ব্যপ্ত থাকুক- এই কামনা করি।”

সাউন্ডক্লাউডে প্রকাশ করা গানটি সুমন রেকর্ড করেছেন ঘরে বসেই।