বাংলার দামাল ছেলে ফারুক

জন্ম ও বেড়ে ওঠা এই ইট কাঠ পাথরের ঢাকা শহরে অথচ বাংলার শ্যামল গ্রামের দামাল ছেলের রূপ তার চেয়ে বেশি করে পর্দায় কেউ তুলে ধরতে পারেনি। তিনি চলচ্চিত্র নায়ক ফারুক।

শান্তা মারিয়াবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 August 2016, 07:37 AM
Updated : 18 August 2016, 07:37 AM

‘সারেং বউ’, ‘লাঠিয়াল’, ‘নয়নমণি’, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ‘দিন যায় কথা থাকে’, ‘জনতা এক্সপ্রেস’, ‘সাহেব’, ‘মিয়াভাই’,‘নাগরদোলা’, ‘সুজনসখী’, ‘ঘরজামাই’, ‘ভাইভাই’,‘বিরাজবৌ’- এর মতো অসংখ্য চলচ্চিত্রে স্মরণীয় অভিনয়ের জন্য তার নাম বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সোনারজলে লেখা রয়েছে।

ফারুকের জন্ম পুরানো ঢাকায় ১৯৪৮ সালের ১৮ অগাস্ট। তার পুরো নাম আকবর হোসেন পাঠান দুলু। বাবার নাম আজগার হোসেন পাঠান। পুরানো ঢাকাতেই বড় হয়েছেন ফারুক। তিনি ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী ছিলেন।

১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ডাকে ছয় দফা আন্দোলনে যোগ দেন। প্রচুর পুলিশী হয়রানির শিকার হন সেসময়। তার নামে ৩৭টি মামলা দেওয়া হয়। উনসত্তরের গণ আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী ফারুক যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে। বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেন।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই তিনি চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করেছিলেন। ১৯৭১ সালে মুক্তি পায় তার অভিনীত প্রথম ছবি ‘জলছবি’।

মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে ফারুক আবার চলচ্চিত্র জগতে যোগ দেন। ১৯৭৩ সালে মুক্তি পায় খান আতাউর রহমান পরিচালিত ‘আবার তোরা মানুষ হ’। ছবিতে নায়ক ছিলেন সরকার ফিরোজউদ্দিন, নায়িকা ববিতা। ফারুক অভিনয় করেছিলেন এক মুক্তিযোদ্ধার চরিত্রে। ছবিতে তার বোন(সুলতানা) আত্মহত্যা করে প্রেমিকের বিশ্বাসঘাতকতায়। ছোট হলেও ফারুকের চরিত্রটি ছিল বেশ চ্যালেঞ্জিং।

১৯৭৪ সালে নারয়ণ ঘোষ মিতা পরিচালিত ‘আলোর মিছিল’-এ ববিতার বিপরীতে অভিনয় করেন তিনি। যদিও ছবিতে নায়ক ছিলেন রাজ্জাক। ১৯৭৫ সালে মুক্তি পায় নারায়ণ ঘোষ মিতার ‘লাঠিয়াল’। এ ছবিতে কেন্দ্রীয় চরিত্রে ছিলেন আনোয়ার হোসেন। ফারুকের চরিত্রও ছিল বেশ গভীর। ছবিতে ফারুকের বিপরীতে নায়িকা ছিলেন ববিতা। এ ছবিতে অভিনয়ের জন্য পার্শ্ব চরিত্রে সেরা অভিনেতার জাতীয় পুরস্কার পান ফারুক।

সে বছরই মুক্তি পাওয়া অন্য একটি ছবি তার ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ছবিটি ‘সুজন সখী’। গ্রামীণ পটভূমির গল্প। পারিবারিক কলহের জেরে ভেঙে যায় একটি যৌথ পরিবার। ছোটবেলার খেলার সাথী দুই চাচাতো ভাই-বোন আলাদা হয়ে যায়। বড় হয়ে আবার তাদের দেখা হয়। জন্ম নেয় প্রেম। তারপর পারিবারিক জটিলতা। মিলনাত্মক পরিণতি। মেলোড্রামাটিক ছবি।

এই ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র গ্রামীণ তরুণ সুজনের ভূমিকায় অনবদ্য অভিনয় করেন ফারুক। নায়িকা কবরীও ছিলেন দারুণ আবেদনময়ী। এই ছবির গান ‘সব সখীরে পার করিতে নেব আনা আনা’ দারুণ জনপ্রিয়তা পায়। এই গানের সঙ্গে ফারুক ও কবরীর অভিনয় এবং পর্দা রসায়ন আজও স্মরণ করেন পুরানো দিনের দর্শকরা। ছবিটি সুপার হিট হয়। আর এ ছবিতে অভিনয়ের সুবাদেই আমাদের চলচ্চিত্রে গ্রামীণ যুবকের চরিত্রে ফারুক স্থায়ী আসন গড়ে তোলেন। সুদর্শন ও প্রতিভাবান অভিনেতা ফারুক দর্শকের মন জয় করে নেন সহজেই।

১৯৭৬ সালে মুক্তি পায় ফারুক অভিনীত তিনটি ছবি। ‘সূর্যগ্রহণ’ ছবিতে কিছুটা নেতিবাচক চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। তবে আমজাদ হোসেনের ‘নয়নমণি’ ছবিটির বাণিজ্যিক সাফল্য ফারুককে নায়ক হিসেবে আরও প্রতিষ্ঠা এনে দেয়। এতে ববিতার বিপরীতে নায়ক ছিলেন তিনি। ‘নয়নমণি’র সাফল্য ববিতা-ফারুক জুটিকেও প্রতিষ্ঠিত করে। ১৯৭৮ সালে ‘সারেং বৌ’ মুক্তি পায়। শহীদুল্লাহ কায়সারের কালজয়ী উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত ছবিটি নারীকেন্দ্রিক হলেও ‘কদম সারেং’ চরিত্রে জীবনঘনিষ্ট অভিনয়ের জন্য সমালোচকদের প্রশংসা কুড়ান ফারুক।

এ ছবিতে অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন ফারুক যা বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে ক্ল্যাসিক হিসেবে গণ্য। সিনেমায় তার বিপরীতে ছিলেন কবরী।

সে বছরই ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ ছবিতে কেন্দ্রীয় পুরুষ চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। নারীকেন্দ্রিক এ ছবিতে নায়িকা ছিলেন ববিতা। এ ছবিতে গ্রামীণ রাজনীতির ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে মায়ের তুলে দেওয়া বিষে মৃত্যু হয় মিলন নামে প্রতিবাদী যুবকের। মিলন চরিত্রে দুর্দান্ত অভিনয় করেন ফারুক। বিশেষ করে মৃত্যুর দৃশ্যে তার অভিনয় দর্শককে কাঁদায়।

১৯৭৯ সালে ফারুক হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের অন্যতম প্রধান নায়ক। সে বছর তার অভিনীত ত্রিশটির বেশি চলচ্চিত্র মুক্তি পায়। বিশেষ করে গ্রামীণ তরুণের আইকন হয়ে যান তিনি।। গ্রামের সহজ সরল প্রতিবাদী যুবকের চরিত্রে ফারুকের বিকল্প কেউ ছিলেন না। এমনকি এখনও এই ধরনের চরিত্রে তাকে অতিক্রম করতে পারেননি কোনো অভিনেতা।

১৯৭৯ সালে মুক্তি পাওয়া তার অভিনীত ছবিগুলোর মধ্যে ‘নাগরদোলা’, ‘কথা দিলাম’, ‘সাহেব’, ‘ছোট মা’, ‘দিন যায় কথা থাকে’, ‘ঘরজামাই’, ‘এতিম’, ‘ভাইভাই’, ‘জনতা এক্সপ্রেস’, ‘মাটির পুতুল’সহ বেশ ক’টি ছবি বাণিজ্যিক সফলতা পায়। পর্দায় তার অভিনীত ‘দিন যায় কথা থাকে’, ‘তুমি আরেকবার আসিয়া’ ইত্যাদি গান লোকের মুখে মুখে ফেরে।

গ্রামের বেকার যুবক, পরিশ্রমী কৃষক, ট্রাকচালক, ট্রেনচালক, ইত্যাদি চরিত্রের মাধ্যমে তিনি সাধারণ দর্শকের মনের নায়কে পরিণত হন। ‘জনতা এক্সপ্রেস’ ছবিতে নিজের শিশু সন্তানকে বলি দিয়ে ট্রেনযাত্রীদের জীবন বাঁচিয়েছেন এমন এক ট্রেনচালকের ভূমিকায় অসামান্য অভিনয় করেন ফারুক।

পরবর্তিতে ফারুক অভিনীত ছবিগুলোর মধ্যে ‘সখী তুমি কার’, ‘মিয়াভাই’, ‘ঝিনুকমালা’, ‘মায়ের আঁচল’ ইত্যাদি বাণিজ্যিক সাফল্য পায়। ‘সখী তুমি কার’ ছবিতে অবশ্য শাবানার বিপরীতে শহুরে ধনী যুবকের চরিত্রে অভিনয় করে সাফল্য পেয়েছিলেন তিনি; কিন্তু তার গ্রামীণ পটভূমির ছবিগুলোই বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছে সবসময়। ‘মিয়াভাই’ সাফল্য পাওয়ার পর দর্শকমহলে তার ‘মিয়াভাই’ নামটি জনপ্রিয়তা পায়।

কবরী, সুচন্দা, শাবানা, ববিতা, রোজিনা, অঞ্জনা, সুচরিতা, অঞ্জুঘোষসহ সত্তর ও আশির দশকের সব শীর্ষ নায়িকার বিপরীতে কাজ করলেও ববিতা-ফারুক জুটিই ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয়। তাদের পর্দারসায়ন এত চমৎকার ছিল যে পর্দার বাইরে তাদের প্রেম চলছে এমন গুঞ্জনও আশির দশকের ফিল্মি ম্যাগাজিনগুলোতে প্রকাশিত হয়। যদিও তারা কেউই এ বিষয়ে কখনও মুখ খোলেননি।

নব্বই দশকের শেষে কয়েকটি চলচ্চিত্রে চরিত্রাভিনেতা হিসেবে দেখা যায় ফারুককে। তবে ব্যক্তিগত ব্যবসায়িক ব্যস্ততার জন্য তিনি রূপালি পর্দা থেকে কিছুটা দূরে সরে যান।

চলচ্চিত্র জগতের সঙ্গে ঘনিষ্ট যোগাযোগ না রাখলেও নায়ক ফারুক অভিনীত শতাধিক চলচ্চিত্র তাকে বাংলাদেশের রুপালি পর্দায় স্মরণীয় করে রেখেছে।