লোকসঙ্গীত উৎসব: দ্বিতীয় দিনে বাঙালি শিল্পীদের জাদু 

ঢাকা আর্ন্তজাতিক লোকসঙ্গীত উৎসব ২০১৫র দ্বিতীয় দিনটি এক অর্থে ছিল লোকসঙ্গীত শিল্পীদের। বয়সে তারা কেউ কিশোর কেউ মধ্যবয়সী। বাংলা লোকসঙ্গীতকে গ্রাম্য ঘরের আঙ্গিনা পার করিয়ে নাগরিক সমাজ থেকে আন্তর্জাতিক সমাজে শুধু পরিচিত করানোই নয়, বহুল চর্চার মাধ্যমে তাদের প্রতিষ্ঠা বাড়াতেও ভূমিকা রেখে চলেছেন।

চিন্তামন তুষারচিন্তামন তুষারবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 Nov 2015, 01:10 PM
Updated : 15 Nov 2015, 06:30 AM

পবন দাস বাউল, মমতাজের কথা আলাদা। তাদের ভেতর থেকে শেকড়ের গন্ধ এখনও ভেসে আসে। বাংলা লোকসঙ্গীতকে বিশেষত উত্তরাঞ্চলের ভাওয়াইয়া গানকে নাগরিক সমাজে প্রতিষ্ঠিত করায় আব্বাসউদ্দীন অবিসংবাদিত। তারই তৃতীয় প্রজন্মের প্রতিনিধি নাশিদ কামাল মঞ্চে উঠেছিলেন এদিন। একে একে গাইলেন ‘নিমের দোতরা তুই মোর’, ‘যে জন প্রেমের ভাব জানে না’, ‘প্রাণ সখীরে’, ‘বা-হা-হা-ল করিয়া বাজান গো দোতরা’। প্রত্যেকটিই ভাওয়াইয়া - কোনটি দীঘলনাশা, কোনটি চটকা শ্রেণীভুক্ত। গানগুলো জনপ্রিয় করে গেছেন নাশিদ কামালের পিতামহ, ফুপুরা।

নাগরিক সমাজে পল্লীগীতিকে প্রতিষ্ঠিত ও জনপ্রিয় করার আরেক দিকপাল আবদুল আলীম। একাধারে গেয়ে জনপ্রিয় করে গেছেন বাউল, ভাটিয়ালি, সারি, মারফতি, মুর্শিদি ইত্যাদি বহু ধারার গান। তারই উত্তরসুরী জহির আলীম, আজগর আলীম, নুরজাহান আলীম। গাইলেন তাদেরই জন্মদাতার গাওয়া গান - ‘সর্বনাশা পদ্মা নদীরে’, ‘কলকল ছলছল’, ‘থাকতে পার ঘাটাতে’।

উত্তরসুরীদের পরপরই মঞ্চে উঠলেন বারী সিদ্দিকী। উকিল মুন্সী, সাধক চাঁনমিয়া, বিজয় নারায়ণ প্রমুখ লোক কবিরা যার কণ্ঠের যাদুতে ঠিকানা পেয়েছেন। বারী সিদ্দিকীর সঙ্গীতের ঝোঁক ও নেশার সবটাই তার প্রিয় বাশের বাঁশির প্রতি সমর্পিত। তবু তিনি পরিচিত হয়েছেন ‘জিন্দা লাশ’, ‘ঘরে জ্বালা বাইরেও জ্বালা’, ‘পূবালী বাতাসে’, ‘রজনী হোসনে অবসান’, ‘শুয়াচান পাখি’ গানগুলোর গায়ক হিসেবে। তবে সুযোগ করে নিয়ে বাঁশির সুর শুনিয়ে দিতে ভুল করেননি।

শহুরে তরুণদের লোকগানের প্রতি উৎসুক করে তুলতে একটা বড় ভূমিকা রেখেছিল জ্যাজ-ব্লুজ-লোক ফিউশন ব্যান্ড বাংলা। অন্যতম দুই সদস্য সায়ান চৌধুরী অর্ণব ও ফাইজান আর আহমেদ বুনো মিলে গড়েছেন অর্ণব অ্যান্ড ফ্রেন্ডস, তাদের সঙ্গ দিচ্ছেন পান্থ কানাই, নজরুল ইসলাম ও সাদুল ইসলাম সাদ। ‘সোনা দিয়া বান্ধাইয়াছি ঘর’ গেয়ে শুরু হয় তাদের এদিনের মঞ্চ পরিবেশনা, পরের গানটি হলো ‘হার কালা’। জনপ্রিয় গান দুটি গাওয়ার মাঝেই পান্থ কানাইয়ের কণ্ঠে লালন সাঁইজির ‘জাত গেলো’ এবং শ্রোতাদের দিয়ে গাওয়ানো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কেন মেঘ আসে’ শেষে চট্টগ্রামের লোকগান ‘চান মুখে মধুর হাসি’ ও ‘লাল পাহাড়ের দেশে যা’ গেয়ে শোনান।

এরপর চমক এলো, প্রথমবারের মতো চাচা-ভাতিজা তপন চৌধুরী ও অর্ণবের মঞ্চ ভাগাভাগি করে নেয়ায়। আশির দশকে নিজের শিখরচুম্বী জনপ্রিয়তার সময় তপন গেয়েছিলেন নিজ অঞ্চলের ‘আইচ্ছা পাগল মন’ গানটি, ভাতিজা অর্ণব ও তার দলের সঙ্গে গাইলেন এবার।

গান শেষে তপন জানালেন, “জীবনে প্রথমবার ভাতিজার সঙ্গে এক মঞ্চে” উঠলেন তিনি।

মঞ্চে উঠেই ‘জয় গুরু’ বলে সম্ভাষণ জানালেন আন্তর্জাতিক খ্যাতি পাওয়া ভারতের পবন দাস বাউল। অর্ণব অ্যান্ড ফ্রেন্ডস সঙ্গত করলেন তার সঙ্গে। এবার তার একমাত্র সফরসঙ্গী অর্ধাঙ্গীনী মিমলি। তাকে ক্ষেপী বলে পরিচয় করিয়ে দিলেন। মঞ্চে একটানা মন্দিরা বাজিয়ে গেলেন তিনি টু শব্দ না করে।

কোমলে কড়ি মিশিয়ে ‘কতদিনের সে ভাব’-এর টানা টানা সুরে শুরু হয় পবন দাসের পরিবেশনা। এরপর ‘চঞ্চল মন’ শোনালেন অভাবনীয় ঢিমা তালের সংগীতায়োজনে। একফাঁকে জানালেন, অর্ণবদের সঙ্গে তার সংগীতের প্রেম জমিয়ে তোলার সময় তেমন পাননি। রিহার্সাল করেছেন খুবই অল্প সময়ের জন্য।

তাই সম্ভবত ‘বসুন্ধরার বুকে’, ‘দিল কী দয়া’র সেই আবেগমথিত গিটার সলোগুলো শোনা হলো না। আর ‘মনমতি’ও গাইলেন একেবারেই অপরিচিত ভঙ্গীতে। গানটি গাইতে গাইতে শোনালেন বাউল তত্বের গুঢ়কথা - “এই মনই মন্দির, মসজিদ। তাই বাউল বলছেন, এই মন ভজলেই ঈশ্বরকে পাওয়া যাবে।” 

বাউলদের সাধন-ভজনের এক উপায় সংগীত। পবন দাসের পরিবেশনায় সেই কথা মূর্ত হয়ে উঠলো। ‘মনমতি’ গাইতে গাইতে খমক বাজিয়ে তার সঙ্গে পায়ের মুদ্রা তৈরি সহজ কথা নয়।

লোকসঙ্গীত গেয়ে এদেশীয় শিল্পীদের মধ্যে খ্যাতি পাওয়া অন্যতম শিল্পী মমতাজ বেগম। পালাগান গাইয়ে থেকে রেকর্ড অ্যালবামের শিল্পী হয়ে ওঠার পুরো পথটাই হেঁটেছেন শেকড়ের জোরে। মানিকগঞ্জের পালাগানের খণ্ডাংশ গেয়েই শুরু করেন এদিনের মঞ্চ পরিবেশনা।

তারেক মাসুদ তার ‘মাটির ময়না’ সিনেমায় ‘বেস্তে যাইতে চাও গো’ শিরোনামের পালাগান পরিবেশন করেন। সেই গানটির খণ্ডাংশ অর্ণব অ্যান্ড ফ্রেন্ডসের সঙ্গে পরিবেশন করেন মমতাজ। এরপর যখন ‘আগে যদি জানতাম’ গাইতে শুরু করলো, উৎসব প্রাঙ্গনে নেমে এল স্তব্ধতা। এরপর ‘ভেঙ্গে মোর ঘরের চাবি’, ‘খাজাবাবা খাজাবাবা’, ‘বান্ধিলাম পিরিতের ঘর’, ‘মরার কোকিলে’ - গানগুলো মাতিয়ে তুললো দর্শককে। 

সবশেষে মঞ্চে ওঠে চীনের ইউনান আর্ট অ্যান্ড কালচারাল গ্রুপ। তাদের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির সঙ্গে খানিকটা পরিচিত হওয়ার সুযোগ মেলে। অ্যাক্রোব্যাটিক নাচের মাঝেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ওগো বিদেশীনী’ গেয়ে শোনান ইউনানের এক তরুণ। শুনতে খারাপ লাগে না, হাজার হোক বিদেশীর কণ্ঠে রবীবাবুর গান!

দ্বিতীয় দিনেও ছিল উদ্বোধনীর আনুষ্ঠানিকতা। স্কয়ার গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান সান ইভেন্টস ও মাছরাঙ্গা টেলিভিশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অঞ্জন চৌধুরীর আমন্ত্রণে এদিন মঞ্চ আলো করেন এমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ও ভারতীয় হাইকমিশনার পঙ্কজ শরন।

আপাত পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের ভীড়েই মঞ্চে জায়গা করে নিয়েছিলেন তরুণ এবং কিশোর শিল্পীরা।

সার্বিকভাবে দ্বিতীয় দিনে বাংলাদেশের বৈচিত্র্যময় লোকসঙ্গীতের সামগ্রিক স্বাদ দিয়েছেন শিল্পী-সাধকরা। ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, বাউল, পালাগান, প্রখ্যাত লোককবিদের গান, সিলেট-চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান কি ছিল না এদিন!

ছবি: ফেইসবুক