হকার থেকে জনি ওয়াকার

মাতালের অভিনয় তিনি এতই ভালো করতেন যে হুইস্কির বিখ্যাত ব্র্যান্ডের নামে রুপালি পর্দায় তার নাম হয় জনি ওয়াকার। অথচ তিনি কখনও মদ স্পর্শ করেননি।

শান্তা মারিয়াবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 July 2015, 03:20 PM
Updated : 29 July 2015, 03:20 PM

বলিউডের এই কিংবদন্তি কৌতুকশিল্পী জনি ওয়াকারের প্রকৃত নাম ছিল বদরুদ্দিন জামালুদ্দিন কাজি। সমাজের একেবারে প্রান্তিক অবস্থান থেকে তিনি হয়েছিলেন বলিউডের উজ্জ্বল তারকা। পরিবেশকরা বিশেষভাবে অনুরোধ জানাত নির্মাতাদের ছবিতে যেন জনি ওয়াকার থাকেন, তাহলে বাণিজ্যিক সাফল্য নিশ্চিত হবে।

জনি ওয়াকারের জীবনের গল্পও সিনেমার মতোই। গত শতকের বিশের দশকে ভারতের ইন্দোরে জামালুদ্দিন কাজির জন্ম। তার বাবা ছিলেন কারখানা শ্রমিক। দশ ভাইবোনের মধ্যে জামালুদ্দিন ছিলেন দ্বিতীয়। তার বাবা যে কারখানায় চাকরি করতেন সেটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চরম অভাবে পড়ে পরিবারটি। তারা মহারাষ্ট্রে চলে আসেন। এখানে পরিবারে একমাত্র উপার্জন করতেন জামালুদ্দিন। ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ার সময় স্কুল ছেড়ে কাজে নামতে হয় তাকে। রাস্তায় রাস্তায় লজেন্স, ক্যান্ডি, কুলফি, সবজি ও নানা ধরনের জিনিস ফেরি করতেন তিনি।

হকার জামালুদ্দিন কিন্তু অভিনয়ের প্রতি দারুণ আগ্রহী ছিলেন। কিশোর বয়সে তার স্বপ্ন ছিল সিনেমায় অভিনয় করার। বস্তির শিশুদের অভিনয় দেখাতেন। তার সহজাত প্রতিভা ছিল কৌতুক অভিনয়ের। একটু বড় হয়ে তিনি মুম্বাইয়ে বাসের হেল্পার হন| পরে বাসের কনডাকটর হন। এই সময় তিনি বাস যাত্রীদের অভিনয় দেখিয়ে আনন্দ দিতেন। তার মনে আশা ছিল হয়তো এই যাত্রীদের মধ্যে কোনো চলচ্চিত্র পরিচালক থাকবেন যিনি তাকে সিনেমায় সুযোগ করে দিতে পারবেন।

সত্যিই এইভাবে একদিন সুযোগ এলো। একজন সহকারী পরিচালক তাকে ‘হালচাল’ ছবিতে জুনিয়র আর্টিস্ট হিসেবে ছোট্ট একটি পার্ট দেন। ‘হালচাল’ ছবির সেটে জামালুদ্দিন উপস্থিত জনতাকে তার কৌতুক অভিনয় দেখিয়ে আনন্দ দিচ্ছিলেন। সেই সময় প্রখ্যাত অভিনেতা, চিত্রনাট্যকার ও নির্মাতা বলরাজ সাহানির নজরে পড়েন তিনি। বলরাজ সাহানি তাকে নিয়ে যান পরিচালক গুরু দত্তের কাছে। জামালুদ্দিন মাতালের অভিনয় করে দেখান। অভিজ্ঞ জহুরির মতোই গুরুদত্ত এই রত্নকে চিনতে পারেন। মাতালের ভূমিকায় তার অভিনয়ে মুগ্ধ হয়ে গুরুদত্ত তার নতুন নাম দেন জনি ওয়াকার।

১৯৫১ সালে মুক্তি পায় গুরুদত্তর নতুন ছবি ‘বাজি’। এই ছবিতে অভিষেক ঘটে জনি ওয়াকারের। গুরু দত্তর ছবিতে নিয়মিত শিল্পী হন জনি ওয়াকার। ‘ট্যাক্সি ড্রাইভার’, ‘সি আই ডি’, ‘মেরে মেহবুব’, ‘পিয়াসা’ ইত্যাদি ছবির দৌলতে জনি ওয়াকার কমেডি অভিনয়ে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেন। তার নামে টিকিট বিক্রি বেশি হতো। তিনি কয়েকটি ছবিতে গান গেয়েও তুমুল জনপ্রিয়তা পান। জনি ওয়াকার ৩০০টির বেশি ছবিতে অভিনয় করেন।

পঞ্চাশ, ষাট ও সত্তরের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত তিনি ছিলেন ব্যস্ত তারকা। সে সময় তার অভিনীত বিখ্যাত ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘নয়া দৌড়’, ‘মধুমতি’, ‘জাল’, ‘দেবদাস’, ‘চোরি চোরি’, ‘ছু মন্তর’, ‘অমরদীপ’, ‘কালাপানি’, ‘চৌধভিন কা  চান্দ’, ‘আর পার’, ‘শিকার’, ‘হাংগামা’, ‘মেরে হুজুর’, ‘সুরজ’, ‘আপ কি কসম’, ‘আনন্দ’ ইত্যাদি। গুরু দত্তর ছবিতে অভিনয় করতে সবচেয়ে সাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন তিনি। গুরু দত্ত তাকে অভিনয়ে যথেষ্ট স্বাধীনতা দিতেন। অনেক সংলাপ জনি ওয়াকার নিজেই তৈরি করে নিতেন তাৎক্ষণিকভাবে। গুরু দত্তর অকাল মৃত্যুর পর তিনি ছবির জগত থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে থাকেন।

বিশেষ করে হিন্দি ছবিতে কমেডিয়ানের অভিনয়ে ও সংলাপে যখন থেকে অশালীনতা ও ভাঁড়ামি প্রাধান্য পেতে থাকে তখন থেকেই তিনি নিজেকে গুটিয়ে নেন। জনি ওয়াকার বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে বলতেন, তিনি তিনশর বেশি ছবিতে অভিনয় করেছেন কিন্তু তার একটি সংলাপ বা একটি দৃশ্য সম্পর্কেও সেন্সর বোর্ড কখনও আপত্তি করতে পারেনি। তিনি সুস্থ কৌতুক, বুদ্ধিদীপ্ত হাস্যরসে বিশ্বাস করতেন। সিনেমায় কমেডির নামে ভাঁড়ামি, স্থূল বিনোদন, অশালীন অঙ্গভঙ্গি বা অশ্লীল সংলাপে তিনি রাজি হননি। এ কারণেই সত্তর দশকের মাঝামাঝি থেকে তিনি ছবিতে অভিনয় করা কমিয়ে দেন। আশির দশকে তিনি মাত্র দু’তিনটি ছবিতে অভিনয় করেন। দীর্ঘ বিরতির পর ১৯৯৭ সালে তার অভিনীত সর্বশেষ ছবি ‘চাচি ৪২০’ মুক্তি পায়।

আশি ও নব্বইয়ের দশকে তিনি জুয়েলারি ব্যবসায় মনোনিবেশ করেন এবং সাফল্য পান। ব্যক্তি জীবনে তিনি ছিলেন পরিশীলিত আচরণের জন্য বিখ্যাত। নিজে স্কুলে লেখাপড়া করতে পারেননি বলে সন্তানদের শিক্ষায় ছিলেন মনোযোগী। তার সন্তানরা উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়।‘আর পার’ ছবির সহঅভিনেত্রী নুরজাহানকে তিনি বিয়ে করেন।

‘মধুমতি’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য ১৯৫৮ সালে জনি ওয়াকার পার্শ্ব-চরিত্রে সেরা অভিনেতার ফিল্ম ফেয়ার পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৬৮ সালে ‘শিকার’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য ফিল্মফেয়ার আসরে কমেডি চরিত্রে সেরা অভিনেতার পুরস্কার পান।

বলিউডের এই কমেডি তারকা ২০০৩ সালের ২৯ জুলাই মৃত্যু বরণ করেন।