তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি তিন হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫ হাজার ৩০০ টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব চূড়ান্ত করেছে সরকার গঠিত মজুরি বোর্ড।
Published : 04 Nov 2013, 03:04 PM
বোর্ড গঠনের প্রায় পাঁচ মাস পর সোমবার মালিক ও শ্রমিক পক্ষের প্রতিনিধিদের নিয়ে মজুরি বোর্ডের নবম সভায় এই প্রস্তাব চূড়ান্ত করা হয়।
তবে ওই প্রস্তাবে আপত্তি জানিয়ে মালিকপক্ষের প্রতিনিধিরা ভোট না দিয়ে সভা থেকে বেরিয়ে যান।
ভোটাভুটিতে ছয় সদস্যের মধ্যে চারজনের সমর্থন পাওয়ায় ৫ হাজার ৩০০ টাকা ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের খসড়া প্রস্তাব চূড়ান্ত করা হয়েছে বলে বোর্ডের চেয়ারম্যান এ কে রায় জানান।
সভা শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা অনেক চেষ্টা করেছি সমঝোতার। কিন্তু মালিকপক্ষ রাজি হয়নি। তারা চলে গেলেন। আমি বাধ্য হয়েছি ভোট করে সিদ্ধান্তে আসতে। অধিকাংশ সদস্য শ্রমিক পক্ষের দেওয়া ৫৩০০ টাকার প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছেন।”
ন্যূনতম মজুরি বিধিমালা-১৯৬১ এর সপ্তম ধারা অনুযায়ী সদস্যদের ভোটের মাধ্যমে পোশাক শিল্পের এই ন্যূনতম মুজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
গত বৃহস্পতিবার বোর্ডের অষ্টম সভায় মালিকপক্ষ ৪ হাজার ২৫০ টাকা প্রস্তাব করেন। কিন্তু শ্রমিকপক্ষের বিরোধিতায় আবারো বসতে হয় বোর্ডকে।
শ্রমিকরা এর আগে আট হাজার ১১৪ টাকা ন্যূনতম মজুরির দাবি জানিয়ে এলেও সোমবার বোর্ডের সভায় শ্রমিকপক্ষের দুই প্রতিনিধি ৫ হাজার ৩০০ টাকার প্রস্তাব করেন।
রাজধানীর তোপখানা রোডে মজুরি বোর্ডের কার্যালয় ঘেরাও করে গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্ট ও বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক ঐক্য পরিষদের নেতা-কর্মীদের বিক্ষোভের মধ্যেই এ বৈঠক চলে।
গার্মেন্ট মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন পর্যবেক্ষক হিসাবে এই সভায় উপস্থিত ছিলেন। তবে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিজিএমইএ সভাপতি আতিকুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করছি। এই বেতন দেয়ার সক্ষমতা আমাদের শিল্পের নেই।
“বিশ্ব বাজারে পোশাকের দাম কমছে। আবার ডলারের বিপরীতে আমাদের টাকার মান বাড়ছে। এই মুহূর্তে আমাদের ওপর এই সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিলে তা হবে আত্মহত্যার শামিল।”
মঙ্গলবার বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলন করে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানানো হবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
এখন নিয়ম অনুযায়ী বোর্ডের এই সিদ্ধান্ত গেজেট আকারে প্রকাশ করা হবে। আগামী ১৪ দিন এই প্রস্তাবের ওপর সব পক্ষ মতামত জানাতে পারবে। ১৫তম দিনে বোর্ড বৈঠক করে সকল পক্ষের মতামতের ভিত্তিতে প্রস্তাবটি চূড়ান্ত করে মন্ত্রণালয়ে পাঠাবে।
মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পেলেই মজুরি বোর্ডের এই প্রস্তাব বাস্তবায়নের আদেশ দেবে সরকার।
এ কে রায় বলেন, শ্রমিকদের পক্ষ থেকে প্রথমে ৮ হাজার টাকা প্রস্তাব করা হয়। এরপর ৬০০০, সাড়ে ৫ হাজার এবং সর্বশেষে ৫ হাজার ৩০০ টাকার প্রস্তাব দেয় তারা।
অন্যদিকে মালিকপক্ষ প্রথমে ৩ হাজার ৬০০ টাকা এবং পরে ৪ হাজার ২৫০ টাকা ন্যূনতম মজুরির প্রস্তাব দেন।
“আজও মালিকপক্ষ ৪ হাজার ২৫০ টাকার প্রস্তাবে অটল থাকে। ফলে আমি বাধ্য হয়ে ভোট করেছি।”
বোর্ডের সদস্য শ্রমিক পক্ষের প্রতিনিধি সিরাজুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, “মালিকপক্ষ ৪ হাজার ৪৫০ টাকা পর্যন্ত মানতে রাজি আছে বলে বোর্ডকে জানিয়েছে। শ্রমিকপক্ষ থেকে ইতিবাচক সাড়া পেলে তারা এ প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকভাবে দিতে চায়। কিন্তু আমরা তাতে সাড়া দিইনি।”
প্রস্তাবিত ৫ হাজার ৩০০ টাকা ন্যূনতম মজুরির মধ্যে মূল বেতন ধরা হয়েছে ৩ হাজার ২০০ টাকা।
এছাড়া ১ হাজার ২৮০ টাকা বাড়ি ভাড়া, ৩২০ টাকা চিকিৎসা ভাতা, ২০০ টাকা যাতায়াত ভাতা এবং খাদ্য ভর্তুকি বাবদ ৩০০ টাকা ধরা হয়েছে।
এর আগে সর্বশেষ ২০১০ সালের ২৭ জুলাই পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি তিন হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়।
সাধারণত ৫ বছর পর পর ন্যূনতম মজুরি পুনর্নির্ধারণ করার নিয়ম থাকলেও বাংলাদেশে কখনোই তা ঠিকভাবে অনুসরণ করা হয়নি।
গত তিন বছরে মূল্যস্ফীতির কারণে ওই কাঠামো পর্যালোচনা করার দাবি জানিয়ে আসছিল শ্রমিক সংগঠনগুলো।
বোর্ড গঠনের পর আলোচনার মধ্যেই মালিক ও শ্রমিক পক্ষের টানাপড়েনে সাভার, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক শ্রমিক বিক্ষোভ ও ভাংচুরের ঘটনা ঘটে।
প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলারের এই শিল্পে ৩৬ লাখের বেশি শ্রমিক জড়িত, যাদের অধিকাংশই নারী। বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হলেও আগের মজুরি কাঠামোই সব কারখানায় ঠিকমতো অনুসরণ করা হয় না বলেও অভিযোগ রয়েছে।
গত বছরের নভেম্বরে তাজরীন ফ্যাশনসে আগুন এবং গত ২৪ এপ্রিল সাভারে রানা প্লাজা ধসের প্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যমে বাংলাদেশের পোশাক কারখানার কর্মপরিবেশ ও শ্রমিকদের স্বল্প মজুরির বিষয়টি নতুন করে সামনে চলে আসে।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে বাংলাদেশি পোশাক বর্জনেরও হুমকি দেয়া হয়।
এই প্রেক্ষাপটে গত জুনে পোশাক খাতের বেতন পুননির্ধারণের জন্য নতুন মজুরি বোর্ড ঘোষণা করেন শ্রমমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু। ২৪ জুন এ বিষয়ে গেজেট জারি হয়।
সাবেক জেলা জজ এ কে রায়ের নেতৃত্বে এই বোর্ডে নিরপেক্ষ সদস্য হিসাবে রয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. কামাল উদ্দীন। আর মালিকপক্ষের স্থায়ী সদস্য হিসাবে কাজী সাইফুদ্দীন আহমদ, শ্রমিকপক্ষের স্থায়ী সদস্য হিসাবে ফজলুল হক, গার্মেন্টস মালিক প্রতিনিধি হিসাবে বিজিএমইএর পরিচালক আরশাদ জামাল এবং গার্মেন্টস শ্রমিক প্রতিনিধি হিসাবে সিরাজুল ইসলাম এই বোর্ডে রয়েছেন।
এর আগে গত ১২ মে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী বলেছিলেন, বোর্ড যখনই মজুরি নির্ধারণ করুক না কেন, সেটা কার্যকর হবে গত ১ মে থেকে।
প্রথমে ওই তারিখ নিয়ে আপত্তি করলেও পরে মালিকেরা ঘোষণা দেন, মজুরি বোর্ড যে সিদ্ধান্ত দেবে, সেটাই তারা মানবেন।
১৯৮৫ সালে পোশাক খাতের জন্য গঠিত দেশের প্রথম মজুরি বোর্ড ৫০০ টাকা ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করে। এরপর ১৯৯৪ সালে ৯৩০ টাকা, ২০০৬ সালে ১ হাজার ৬৬২ টাকা ৫০ পয়সা ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়।