তারা বলছেন, এই পরিস্থিতিতে রাজস্ব ঘাটতি পূরণে সরকারের সামনে করজাল সম্প্রসারণের বিকল্প থাকবে না। আর সেই চাপ সামাল দিতে হবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে।
এ বিষয়ে সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের পরামর্শ, কর আদায় আরও সহজ করে এর আওতা বাড়াতে হবে। যারা বিদ্যমান কাঠামোতে করযোগ্য হয়েও তা দিচ্ছেন না, তাদের করজালে আনতে হবে। তাহলে রাজস্ব আদায় বাড়বে।
বাজেট আলোচনায় সমাপনী বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছ থেকে এ বিষয়ে কোনো পরিকল্পনা পাওয়া যায়নি। আর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান ফোন না ধরায় তার ভাবনাও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম জানতে পারেনি।
চার লাখ ২৬৬ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব অপরিবর্তিত রেখেই বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেট পাস হয়েছে। সেখানে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে দুই লাখ ৮৭ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা।
এর মধ্যে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট থেকে ৯১ হাজার ২৫৪ কোটি টাকা, অর্থাৎ অংকের হিসাবে বাজেটের প্রায় এক-চতুর্থাংশ আসবে বলে ধরা হয়েছে।
এই ভ্যাট আইন ২০১৬ সালের ১ জুলাই থেকে কার্যকরের কথা থাকলেও ব্যবসায়ীদের প্রবল বিরোধিতায় তা এক বছর পেছানো হয়। এবার মুহিত অটল থাকার কথা বললেও বাজারে বিরূপ প্রভাব পড়ার শঙ্কা এবং নির্বাচনের দেড় বছর আগে ভোটের সমীকরণ মেলাতে গিয়ে শেষমেষ সরকার পিছু হটে।
বুধবার জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘অনুরোধে’ মুহিত তার অর্থবিলে সংশোধনী আনেন; ভ্যাট আইনের বাস্তবায়ন ঝুলে যায় অন্তত দুই বছরের জন্য।
কিন্তু একইসঙ্গে প্রশ্ন ওঠে, বড় অংকের ভ্যাট আদায়ের পরিকল্পনা ভেস্তে গেলে সরকারের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য পূরণ হবে কীভাবে। আর মুহিতের ভাষায় তার সর্বশ্রেষ্ঠ বাজেটইবা কীভাবে বাস্তবায়ন হবে।
বিদায়ী অর্থবছরে ভ্যাট থেকে ৭২ হাজার ৭৬৪ কোটি টাকা সংগ্রহের লক্ষ্য ঠিক করেও তা আদায় করতে না পেরে ৬৮ হাজার ৬৭৫ কোটি টাকার সংশোধিত লক্ষ্য ঠিক করা হয়। আর আগামী অর্থবছরে তার চেয়েও ৩৩ শতাংশ বেশি, অর্থাৎ ৯১ হাজার কোটি টাকা ভ্যাট বাবদে আদায় করতে চাইছে সরকার।
সবক্ষেত্রে অভিন্ন ১৫ শতাংশ ভ্যাট আদায় করতে না পারলে বিদ্যমান প্যাকেজ ভ্যাটের মাধ্যমে ওই লক্ষ্য কতটুকু পূরণ করা সম্ভব?
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “স্বাভাবিকভাবেই হয়ত গতবছরের চেয়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা বেশি ভ্যাট আদায় হবে। এছাড়া যেসব প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট নিবন্ধন নেই, এরকম আরও প্রতিষ্ঠানকে ভ্যাটের আওতায় আনা গেলে সেখান থেকে হয়ত আরও ১০ হাজার কোটি টাকা আদায় করা যাবে।
কিন্তু তারপরও প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা ঘাটতির হিসাব মেলে না। সে কারণে এবারও বাজেট সংশোধনের সময় আকার ছোট করতে হবে বলে মনে করছেন মির্জ্জা আজিজ।
সাবেক গভর্নর ফরাসউদ্দিন বলছেন, ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন নিয়ে সরকার ও ব্যবসায়ীরা যেভাবে মুখোমুখি অবস্থানে চলে গিয়েছিল- তা কাঙ্ক্ষিত নয়। তার বদলে বুধবার যেভাবে ভ্যাট বিতর্কের সমাপ্তি টানা হয়েছে, তা তিনি ‘সন্তোষজনক’ বলেই মনে করছেন।
তবে তিনি এও বলেছেন, “মূসক আইনটি মানুষকে আমরা বোঝাতে পারলাম না, এটা ব্যর্থতা।”
গত দু-তিন মাসে রাজস্ব আহরণের গতি বাড়ায় ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়ে যাবে বলেই মনে করছেন ফরাসউদ্দিন।
সেক্ষেত্রে ভ্যাট আইন কার্যকর না করে পুরনো ভ্যাট কাঠামোতে পৌনে তিন লাখ কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আদায় সম্ভব হবে?
এ প্রশ্নে ফরাসউদ্দিনের উত্তর- “আগের ভ্যাট আইন আছে, সেটা দিয়ে ভ্যাট আদায় হচ্ছে। নতুন আইনে অনেক ছাড় দেয়ার বিষয় ছিল। সেটা থাকবে না।… সরকারকে নতুন নতুন ক্ষেত্র বের করে আদায় বাড়াতে হবে।”
এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, দেশে কর শনাক্তকরন নম্বরধারীর (টিআইএন) সংখ্যা ২৮ লাখের বেশি। বাস্তবে করযোগ্য মানুষের সংখ্যা কোটির বেশি। কিন্তু কর দেন ১২ থেকে ১৪ লাখ মানুষ। অর্থাৎ, এখানে কর আদায় বাড়ানোর যথেষ্ট সুযোগ আছে।
এবার বাজেটে এক লাখ ১২ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা ঘাটতি ধরা হয়েছে, যা মেটানোর জন্য বৈদেশিক ঋণ, অভ্যন্তরীণ ব্যাংক ঋণ ও সঞ্চয়পত্র থেকে এক লাখ ১২ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা (সাত বিলিয়ন ডলার) সংগ্রহের পরিকল্পনা করেছেন মুহিত।
“কিন্তু বাংলাদেশ কখনোই তিন, সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলারের বেশি বৈদেশিক অর্থ ব্যবহার করতে পারেনি। ফলে বিদেশ থেকে টাকা পেলেও এক বছরের মধ্যে সাত বিলিয়ন ডলার ব্যবহার করে ফেলবে, এটা আশা করা দুরুহ,” বলেন মোয়াজ্জেম।
এজন্য ঘাটতি মেটাতে সঞ্চয়পত্রের ওপর ‘অতিরিক্ত নির্ভরশীল’ না হয়ে সরকারকে ব্যাংক ঋণের দিকে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
[প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন শহীদুল ইসলাম]