বিদেশিদের কাছ থেকে সাড়ে ৮ কোটি ডলার হারাচ্ছে বাংলাদেশ: অ্যাকশনএইড

বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ ও সরকারকে প্রভাবিত করে ‘নিয়ন্ত্রণমূলক অপচুক্তি’র মাধ্যমে দেশ থেকে বছরে সাড়ে ৮ কোটি ডলার নিয়ে যাচ্ছে বিদেশি কোম্পানিগুলো।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 May 2016, 03:00 PM
Updated : 28 May 2016, 03:00 PM

শনিবার রাজধানীতে ‘দুর্বিনীত কর-আঘাত, অসমর্থিত বাজেট’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় এই হিসাব তুলে ধরেন দাতব্য সংস্থা অ্যাকশন এইড বাংলাদেশের পরিচালক আজগর আলী সাবরি।

‘অপচুক্তি: ব্যাপক রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলো’ শিরোনামের একটি প্রতিবেদনের ফলাফল সভায় উপস্থাপন করেন তিনি।

সাবরি বলেন, পাঁচশরও বেশি আন্তর্জাতিক চুক্তি নিয়ে চালানো এই সমীক্ষায় দেখা যায়, ২০১৩ সাল পর্যন্ত পৃথিবীর ৩২টি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বিনিয়োগ চুক্তি সম্পাদিত হয়, যার মধ্যে ১৮টিই অপচুক্তি।

 “এসব চুক্তির একটি ধারার কারণে বাংলাদেশে ব্যবসারত বহুজাতিক কোম্পানিগুলো প্রতিবছর ৮ কোটি ৫০ লাখ ডলার বা প্রায় ৭০০ কোটি টাকা নিয়ে যাচ্ছে দেশ থেকে। এই টাকা দিয়ে প্রতিবছর ৩৪ লাখ মানুষের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব।”

 

পরে আজগর আলী সাবরি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মূলত রাজনীতিক ও সরকারের কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের মতো নিয়ন্ত্রণমূলক অপচুক্তি করিয়ে এই আর্থিক সুবিধা নিচ্ছে।”

অপচুক্তির বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “১৮টি দেশের কোম্পানির সঙ্গে কঠিন শর্তে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি হয়।ওইসব চুক্তিতে ‘ট্যাক্স এগ্রিমেন্টের ডিভিডেন্ট ক্লজের’ দুর্বলতার কারণে বিদেশি কোম্পানিগুলো এই বিপুল কর ফাঁকি দিতে পারছে।”

ওই ধারার কারণে বিদেশি শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশের উপর করারোপে বাংলাদেশের ক্ষমতা সীমিত করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

সাবরি মনে করেন, বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দক্ষতা বৃদ্ধি ও পুনঃবিনিয়োগের কথা কথা বলা হলেও করপোরেটরা নিজেদের লাভ ছাড়া অন্য কিছু তেমন একটা আমলে নেয় না।

চলতি বছর ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত অ্যাকশন এইডের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বিদেশি মালিকানাধীন কোম্পানিগুলো যাতে কর না দিয়ে আয় দেশ থেকে নিয়ে যেতে না পারে, তার জন্য ‘বেরিয়ে যাওয়ার আঁকড়ে ধরার’ সোজাসাপ্টা নীতি গ্রহণ করতে হবে।

সভায় অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি আব্দুর রাজ্জাক বলেন, “কর্পোরেট ট্যাক্সের মতো প্রত্যক্ষ কর আদায়ে আমরা খুব বেশি চতুর ও দক্ষ হতে পারিনি। এছাড়া বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতেও আমাদের সুযোগ দিতে হয়েছে।

“তবে এক্ষেত্রে আমাদের যতোটা কঠোর ও কৌশলী হওয়া উচিৎ ছিল সেটা আমরা হতে পারিনি।”

তবে বিদেশি কোম্পানিগুলোর জন্য করা ওই চুক্তিগুলো পুনর্মূল্যায়ন বা বাতিল করার সময় এসেছে বলে মনে করেন চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদ।

“বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য আশির দশকে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোকে ডেকে আনতে হয়েছে। সেই সুযোগে তারা তাদের মতো করে চুক্তি করেছে এদেশের নীতিনির্ধারকদের দিয়ে। আমাদের দেশে কর ফাঁকি দিয়ে টাকা নিয়ে যাচ্ছে- এটা হতে পারে না।

নাম উল্লেখ না করে তিনি বলেন, “একটি বড় টেলিফোন প্রতিষ্ঠান মাত্র ৪৫০ জন লোক নিয়ে কাজ করছে। তারা আমাদের মানুষের জন্য কাজের ক্ষেত্র তৈরি করতে পারেনি।”

‘জামাই আদর না করলে, বিনিয়োগকারীরা আসবে না’ এরকম ভাবার সময় শেষ হয়েছে বলে মনে করেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক এই চেয়ারম্যান।

সভায় অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবির বলেন, “আমাদের সক্ষমতার অভাবে করপোরেটরা বেশি সুযোগ নিচ্ছে। আমরা বলছি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। তবে সেটা করতে গিয়ে আমরা যদি তাদের কর ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ করে দেই, সেটা যৌক্তিক না। কর বাড়ানোর মধ্য দিয়ে আমাদের গরিব মানুষের সুবিধা বাড়াতে হবে।”

মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টারে আয়োজিত ওই আলোচনা সভায় বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সদস্য অধ্যাপক স্বপন কুমার বালা ও বাংলাদেশ বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্টের প্রধান নির্বাহী ফেরদৌস আরা বক্তব্য দেন।

স্বপন কুমার বলেন, “যে দেশগুলোর সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে, সেদেশে যদি আমাদের বিনিয়োগ করা যেত তবে আমরা চুক্তির আলোকে কথা বলতে পারতাম। চুক্তি থেকে কীভাবে সুবিধা নিতে হবে সে বিষয়েও সচেতনতা দরকার।”

কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা বিদেশি বিনিয়োগের মূল লক্ষ্য থাকলেও বাস্তবে তা ঘটেনি বলে মনে করেন ফেরদৌস আরা।

“উল্টো তারা আমাদের টাকা নিয়ে যাচ্ছে। তাই বিদেশি বিনিয়োগ আমাদের প্রযুক্তি, কর্মসংস্থান কিংবা দক্ষতা বৃদ্ধিতে কতোটা কাজে আসছে- তা বিবেচনায় আনতে হবে।”

সভায় করপোরেট কর ফাঁকি কমাতে বেশ কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়: সব দেশ মিলে একটা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তৈরি করতে হবে যাতে কেউ সুযোগ না নিতে পারে; দেশীয় পর্যায়ে চুক্তিগুলো জনসম্মুখে প্রকাশ করতে হবে এবং সরকারসহ সব পর্যায়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে।