টাকার প্রবাহে লাগাম দিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা

মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে রাখতে বাজারে মুদ্রা সরবরাহ কমিয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর) মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 July 2015, 12:21 PM
Updated : 30 July 2015, 01:27 PM

এতে আগামী ছয় মাসে মোট মুদ্রা সরবরাহে প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১৫ শতাংশ। আর অর্থবছর শেষে এই হার ১৬ শতাংশে দাঁড়াবে বলে ধরা হয়েছে।

গত ছয় মাসের মুদ্রানীতিতে এই হার ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ ছিল। এই হিসেবে আগামী ছয় মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আগের ছয় মাসের তুলনায় এক দশমিক ৫ শতাংশ পয়েন্ট মুদ্রা কম সরবরাহ করতে চায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমান বৃহস্পতিবার এ মুদ্রানীতি ঘোষণা করেন।

লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, “এবারের মুদ্রানীতি প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়তার পাশাপাশি ঋণ জোগানে প্রয়োজনের অতিরিক্ত স্ফীতি এড়িয়ে মূল্যস্ফীতি পরিমিত এবং সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা জোরালো করবে বলে আমাদের বিশ্বাস।”

এ মুদ্রানীতিতে মোট মুদ্রা সরবরাহ কম ধরায় বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলনও কমে গেছে। আগামী ছয় মাসের জন্য বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ। অর্থবছর শেষে এই প্রবৃদ্ধি ১৫ শতাংশে গিয়ে দাঁড়াবে বলে গভর্নর জানিয়েছেন।

গত ছয় মাসের (জানুয়ারি-জুন) মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ১৫ দশমিক ৫ শতাংশ। যদিও গত মে পর্যন্ত প্রকৃত ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ।

দেশের শিল্প-বাণিজ্যের গতি প্রবাহ বা উন্নয়ন পরিস্থিতি নির্ণয় করা হয় বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির তথ্যের ভিত্তিতেই।

এ মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাত কম টাকা পেলেও সরকারের ঋণ গ্রহণ বাড়বে বলে মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এজন্য আগামী ছয় মাসে সরকারের ঋণ গ্রহণে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে।

গত ছয় মাসের হিসাবে সরকারের ঋণগ্রহণে ২ দশমিক ৭ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এই তথ্য হিসাবে নিলে আগামী ছয় মাসে সরকারের ঋণ গ্রহণে প্রকৃত প্রবৃদ্ধি দাঁড়াবে ১০ দশমিক ৭ শতাংশ।   

বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি কমিয়ে ধরা হলেও গভর্নর বলছেন, “৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির জন্য যে অর্থ সরবরাহের দরকার তার ব্যবস্থা রয়েছে মুদ্রানীতিতে। বরং তার চেয়েও বেশি রয়েছে। আমাদের মুদ্রানীতি অনেক নমনীয়।”

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ বিরুপাক্ষ পাল বলেন, “হতাশ হবার কোনো কারণ নেই, এটি যথেষ্ট মাত্রার প্রবৃদ্ধি সহায়ক ও বিনিয়োগবান্ধব মুদ্রানীতি।”

আর সরকারের ঋণ প্রসঙ্গে গভর্নর বলেন, বিদায়ী অর্থবছরে সরকার কম ঋণ নেওয়ার কারণেই এবারের প্রাক্কলণকে বেশি বলে মনে হচ্ছে।

চলতি অর্থবছরের বাজেটে সরকার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে যে অর্থ ধার করার পরিকল্পনা করেছে তা গতবারের নেওয়া ঋণের তুলনায় ২৩ দশমিক ৭ শতাংশ বেশি।

গভর্নর বলেন, বিনিয়োগ কার্যক্রম জোরদার হওয়ার কারণে বৈদেশিক সম্পদের প্রবৃদ্ধি কমবে। চলতি অর্থবছরে এই প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ২ শতাংশে দাঁড়াবে।

এছাড়া বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও যে হারে বাড়ছে তাতে শিথিলতা আসবে। বৈদেশিক লেনদেনের ঘাটতি হতে পারে জিডিপির ২ শতাংশ মতো।

তবে এই ঘাটতিতে ‘উদ্বেগের কারণ নেই’ বলেই মনে করেন গভর্নর।  

মূল্যস্ফীতি কমে গেলে বা কমার প্রবণতা স্পষ্ট হলে নীতি সুদ হার (রেপো, রিভার্স রেপো) কমিয়ে আনা হবে বলেও জানান তিনি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতির ফলে সামাজিক বৈষম্য বাড়ছে কি না- এমন প্রশ্নে গভর্নর বলেন, “সামাজিক বৈষম্য আছে এ কথা ঠিক। তবে বর্তমানে কম আয়ের মানুষের হাতে অনেক মাত্রায় টাকা যাচ্ছে। প্রতিদিন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ৪৩০ কোটি টাকা লেনদেন হচ্ছে। এর ৮০ শতাংশ টাকা শহর থেকে গ্রামে যাচ্ছে। ৩২ লাখ লেনদেন হয়। এর ফলে মফস্বলের অর্থনীতি চাঙ্গা হচ্ছে।”

এছাড়া ১৬ হাজার কোটি টাকার কৃষি ঋণ, এক লাখ কোটি টাকার বেশি এসএমই ঋণ মানুষের আয় বাড়াচ্ছে বলে মন্তব্য করেন গভর্নর।

তিনি বলেন, “অভ্যন্তরীণ বাজার বেড়ে গেছে। এ কারণে হায়-হায়, খাই-খাই নেই। অন্য দেশে বৈষম্যও বাড়ে, গ্রোথও বাড়ে। আমাদের দেশে তা হচ্ছে না, বরং গ্রোথ বাড়ার সাথে সাথে বৈষম্য কমছে।” 

আরেক প্রশ্নের জবাবে গভর্নর বলেন, “গত ছয় মাসের মুদ্রানীতির ভঙ্গির সঙ্গে আগামী ছয় মাসের ভঙ্গির বিশেষ পরিবর্তন নেই। একই ধরনের মুদ্রানীতি। গাড়ি চলছে, হঠাৎ করে গাড়ির গতি বাড়িয়ে বা কমিয়ে অস্থিরতা আনতে চাই না।”

মানুষের জীবনের মান উন্নত করা, উদ্যোক্তা তৈরি এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিই এ মুদ্রানীতির মূল উদ্দেশ্য বলে জানান আতিউর রহমান। 

সামাজিক বৈষম্য প্রসঙ্গে ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী বলেন, “সামাজিক বৈষম্য অবশ্যই আছে। আমাদের দেশেও আছে। কিন্তু আমরা যেটা করছি, তা হল, যে বড় হচ্ছে তাকে টেনে ধরছি না। বরং যে পিছনে পড়ে যাচ্ছে তাকে সামনে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছি।”

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জাহাঙ্গীর আলম কনফারেন্স হলে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের চেইঞ্জ ম্যানেজমেন্ট অ্যাডভাইজার আল্লাহ মালিক কাজেমী, ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মো. রাজী হাসান, নাজনীন সুলতানাসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।