ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের স্মরণিকায় ইতিহাস বিকৃতির ঘটনায় অব্যাহতি পাওয়া ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার রেজাউর রহমান ‘মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ লালন করেন না’ অভিযোগ করে তার শাস্তি দাবি করেছেন সহকর্মীরা, যাদের নাম ওই প্রকাশানায় এসেছে।
Published : 02 Jul 2016, 11:45 AM
রেজাউরের আদর্শ নিয়ে প্রশ্ন তুলে শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক এএসএম মাকসুদ কামাল বলেছেন, বিএনপির আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত উপাচার্যের সময়ে ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার হওয়া রেজাউর ‘সেই’ উপাচার্যের ঘনিষ্ঠজন ছিলেন।
“তিনি তো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের আদর্শ লালন করেন না। (স্মরণিকায়) তথ্য যেগুলো এসছে, এটা তার ভেতরের কথা। সাব-কনশাস মাইন্ডে তিনি সেটা প্রকাশ করে ফেলেছেন।”
‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের না হয়েও’ এতদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে কীভাবে রেজাউর দায়িত্ব পালন করলেন- সে প্রশ্নে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি আওয়ামী সমর্থক শিক্ষকদের নীল দলের নেতা মাকসুদ কামাল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর স্মরণিকায় জিয়াউর রহমান হলের বর্ণনা দিতে গিয়ে সাবেক সামরিক শাসক জিয়াকে ‘বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি, সাবেক সেনাপ্রধান ও মুক্তিযোদ্ধা’ বলা হয়, যিনি বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন।
এ বিষয়টির পাশাপাশি স্মরণিকায় জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান এবং মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত জগন্নাথ হলের ইতিহাস নিয়ে যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, তার ভাষা নিয়েও শুক্রবার বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের আলোচনাসভায় কড়া প্রতিবাদ আসে।
এ নিয়ে ছাত্রলীগ কর্মীদের বিক্ষোভের মধ্যে দুপুরে ভিসি বাংলার সামনে ভাঙচুরের শিকার হয় উপাচার্য আরেফিন সিদ্দিকের গাড়ি। স্মরণিকার প্রকাশনার দায়িত্বে থাকা ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার সৈয়দ রেজাউর রহমানকে বিকালে অব্যাহতি দেওয়া হলেও ছাত্রলীগ ভিসি বাংলোর সামনে অবস্থান নিয়ে তার পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যায়।
ওই স্মরণিকায় প্রকাশক হিসেবে ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার সৈয়দ রেজাউর রহমানের পাশাপাশি উপদেষ্টা হিসেবে উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক নাসরীন আহমাদ ও উপ-উপাচার্য (প্রশাসন ) অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামানের নাম দেখা যায়। আর এ ধরনের প্রকাশনায় হলের পরিচিতির তথ্য প্রভোস্টদের হাত দিয়েই আসার কথা।
তবে স্মরণিকায় ‘ইতিহাস বিকৃতির’ পর নিজেদের দায় অস্বীকার করে রেজাউরের আদর্শিক অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বাকি সবাই।
জিয়াউর রহমান হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক জিয়া রহমান বলেন, “অফিসিয়ালি বিভিন্ন সময় তথ্য চাওয়া হলে আমরা হল অফিস থেকে সেটা দিয়ে থাকি। এ ধরনেরে স্মরণিকা বের করার ক্ষেত্রে সেটা মানা হয় না। এবার বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের স্মরণিকায়ও তথ্যগুলো সেভাবে এসেছে।”
এই প্রভোস্ট বলেন, স্মরণিকার জন্য কমিটি থাকে; সম্পাদনা পর্ষদও থাকে। তারাই বিষয়গুলো দেখেছে।
এ ঘটনার জন্য রেজাউরের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ারও দাবি জানান জিয়া।
এই দাবি আদায়ের জন্য সন্ধ্যায় জিয়া হলে জরুরি সভা ডাকার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “প্রশাসনের মধ্যে বিরোধী শক্তি ঘাপটি মেরে আছে- এই ঘটনা তারই প্রমাণ। বহিরাগত কারও ইন্ধনে ইস্যু তৈরি করা হচ্ছে কিনা- সেটাও আমাদের ভেবে দেখতে হবে।”
অধ্যাপক জিয়া বলেন, “ছাত্ররা যেভাবে আন্দোলনে নেমেছে সেটার পক্ষে আমাদের সমর্থন আছে। আমরা উপাচার্যসহ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এমন তথ্য বিভ্রাটের বিষয়ে নির্মোহ আছি।”
স্মরণিকার জন্য হল থেকে ‘অফিসিয়ালি’ কোনো তথ্য নেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ অসীম সরকারও।
জগন্নাথ হলের পরিচিতিতে সেখানে লেখা হয়েছে, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যালঘু তথা হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সম্প্রদায় এবং উপজাতি ছাত্রদের জন্য এই হল প্রতিষ্ঠিত হয়’।
সংখ্যালঘু ও উপজাতি শব্দ দুটি নিয়ে বিক্ষোভকারীরা আপত্তির কথা জানালেও একে ‘বড় ধরনের কোনো বিষয়’ হিসাবে দেখছেন না জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ অসীম সরকার।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এটা মেজর কিছু না। সংখ্যালঘু শব্দে কিছু যায় আসে না।”
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. মফিজুর রহমান বলেন, “যে আর্টিকেলটা ছাপা হয়েছে, সেটা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের নিজের লেখা বাইলাইন প্রবন্ধ। দাপ্তরিকভাবে বা আমি ব্যক্তিগতভাবে কোনো ইনপুট দেইনি। উনি নিজেই লিখেছেন।”
তথ্য বিকৃতির বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে মফিজুর রহমান বলেন, “এটা ইতিহাস বিকৃতির চেষ্টা। অনাকাঙ্ক্ষিত এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এ বিষয়ে তদন্ত হবে। তদন্তের পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
সৈয়দ রেজাউর রহমানের লেখা ‘গৌরবজ্জ্বল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ বইয়ের তথ্য অনুসারে ১৯৮২ সালে টিএসসির সহকারী পরিচালক হিসাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ পান তিনি।
এরপর ১৯৮৬ সালে তাকে উপাচার্যের সচিবের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৯৯৩ সালে তিনি আবার টিএসসির ছাত্র-নির্দেশনা ও পরামর্শ দান দপ্তরে বদলি হন। সেখান থেকে ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রারের দায়িত্বে আসেন ২০০৭ সালে; উপাচর্যের দায়িত্বে তখন বিএনপির আমলে নিয়োগ পাওয়া অধ্যাপক এসএমএ ফায়েজ।
ক্ষমতার পট পরিবর্তনে ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। ওই বছর ১৫ জানুয়ারি উপাচার্য পদে আসেন অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার পদে রেজাউরের ওপরই তিনি আস্থা রাখেন। অবশ্য পুরোপুরি রেজিস্ট্রারের দায়িত্ব তার আর পাওয়া হয়নি।
স্মরণিকায় ইতিহাস ‘বিকৃতির’ বিষয়টিকে বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের অনুষ্ঠানের পর সাংবাদিকদের সামনে ‘মুদ্রণ ত্রুটি’ হিসাবে বর্ণনা করেন রেজাউর।
তবে স্মরণিকার দুই উপদেষ্টা অধ্যাপক নাসরীন আহমাদ ও অধ্যাপক আখতারুজ্জামান।
অধ্যাপক নাসরীন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কর্তৃপক্ষ হিসাবে যেহেতু আমাদের নাম ওখানে আছে, আমাদের বাণী আছে, সেটা আমরা দেখে-শুনে দিই। এখানে কী থাকবে এবং কাদের নাম স্মরণ করা হবে তা সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরা হয়।
“এ জিনিসটা খুব তাড়াহুড়ার মধ্যে হল, এর মধ্যে ষড়যন্ত্রে জড়িতরা আমাদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়েছে।”
তিনি বলেন, স্মরণিকাটি তারা দেখে ‘ওকে’ করেননি। যিনি প্রবন্ধ লিখেছেন, দায়িত্ব ‘সম্পূর্ণ তার’।
“যেহেতু আমার নাম এখানে এসেছে, সেজন্য দুঃখপ্রকাশ করছি এবং কাজটি যে করেছে তার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।”
উপ-উপাচার্য হিসেবে ‘সম্প্রতি নিয়োগ পাওয়ার’ কথা বলে অধ্যাপক আখতারুজ্জামানও নিজের দায় এড়ানোর চেষ্টা করেছেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, তাকে উপদেষ্টা করা হলেও প্রকাশের আগে একবারও তিনি স্মরণিকাটি দেখেননি, কিছু জানেনও না।
“আমি দায়িত্ব পেয়েছি কয়েকদিন আগে। আমি এখানে আসার আগে থেকেই স্মরণিকা প্রকাশের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল।”
অধ্যাপক আখতারুজ্জামান বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের আলোচনা অনুষ্ঠানে স্মরণিকায় তথ্য বিকৃতির বিষয়টি উঠে এলে তাকে (সৈয়দ রেজাউর) ফোনে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তুমি যে আমাকে উপদেষ্টা করেছ, একবারও কি আমার কোনো উপদেশ নিয়েছ? একবারও কি আমাকে স্মরণিকা দেখিয়েছ?
“এর উত্তরে সে বলেছিল, কনভেনশনালি প্রতিবারই এভাবে করা হয়ে থাকে।”