টানা অবরোধে মহাসড়কে যান চলাচল বিঘ্নিত হওয়ায় পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থায় সঙ্কট তৈরি হয়েছে, যার প্রভাব পড়েছে বাজারে।
Published : 18 Jan 2015, 07:34 PM
১৫ দিনে ক্ষতি ‘১৭ হাজার কোটি টাকা’
শত কোটি টাকা ক্ষতির শঙ্কায় পর্যটন সংশ্লিষ্টরা
মহাসড়কে প্রায়ই নাশকতা ঘটায় পরিবহন মালিকরা ট্রাক ও কভার্ড ভ্যানের ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছেন দেড় থেকে দুইগুণ। এদিকে আমদানি করা পণ্য বন্দরে আটকে থাকায় দেশের প্রধান দুই পাইকারী বাজার ঢাকার মৌলভীবাজার ও চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে পণ্য মজুদেও টান পড়েছে।
এর প্রভাবে পাইকারী বাজারে প্রায় প্রতিটি পণ্যের দাম বেড়েছে। মান ভেদে চালের দামই কেজিতে বেড়েছে ১ থেকে দেড় টাকা।
শনিবার রাজধানীর মৌলভীবাজার ঘুরে দেখা যায় চিনির দাম আগের মতো থাকলেও তেলের দাম বেড়েছে। গত সপ্তাহে সয়াবিন তেলের দাম যেখানে লিটারে ৮০ টাকা ছিল, এখন তা বেড়ে ৯২ টাকা হয়েছে। লিটারে ৪ টাকা বেড়েছে পামঅয়েলের দাম।
ময়দা বস্তা প্রতি ৫০ থেকে ৮০ টাকা, মসুর ও মুগ ডাল এবং ছোলার দাম প্রতি কেজিতে ১০টাকা; জিরা, দারুচিনি, এলাচ, লবঙ্গ, জয়ফলসহ সব ধরনের মলসার দামও কেজি প্রতি মোটামুটি ৩০ টাকা করে বেড়েছে।
মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আব্দুর রাজ্জাক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “টানা অবরোধে মজুদ পণ্য প্রায় শেষ দিকে। আবার আমদানি করা পণ্য বন্দরে এলেও অবরোধের কারণে খালাস করে গুদামে আনা যাচ্ছে না। যারা ঝুঁকি নিয়ে মাল আনছেন তাদের পরিবহন খরচ পড়ছে বেশি। এজন্য দামও বাড়তির দিকে।”
চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় পাইকারী বাজার খাতুনগঞ্জের হাসান অ্যান্ড ব্রাদার্সের মালিক মীর মোহাম্মদ হাসান জানান, পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধি ও মহাসড়কে নাশকতার আশঙ্কায় খাতুনগঞ্জে পণ্য আনা-নেওয়া ৭০ শতাংশ কমে গেছে।
“পরিবহনের ভাড়া বাড়ায় ব্যবসায়ীরা দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে পণ্য আনা কমিয়ে দিয়েছেন। খাতুনগঞ্জে ক্রেতা না আসায় বিক্রিও কমে গেছে।”
ঢাকার বাবু বাজারের চাল ব্যবসায়ী রফিকুল বলেন, “প্রতি সপ্তাহে আমার ছয় ট্রাক চাল লাগাত। এ সপ্তাহে এক ট্রাকও আসছে না। এক গাড়ি চালের দাম ছয় লাখ টাকা। সেখানে লাভ হয় দুই হাজার টাকা। গাড়ি যদি পুড়ে যায় তাহলে তো পুরোটাই ক্ষতি।’’
বর্তমানে বিদেশ থেকে চাল আমদানি করতে না হলেও চলমান পরিস্থিতিতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ঢাকায় চাল আনতে কেজি প্রতি ১ থেকে দেড় টাকা লাগছে বলে খুচরা বাজারেও দাম বাড়ছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
পাইকার ব্যবসায়ীরা জানান, ঢাকা-চট্টগ্রাম পথে ভোগ্যপণ্য পরিবহনে আগে মাঝারি একটি ট্রাকের ভাড়া পড়ত ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। বড় ট্রাক ও কভার্ড ভ্যানে লাগত ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা।
সেখানে এখন বড় ট্রাকের ভাড়া বেড়ে ২৫ হাজার টাকা হয়েছে বলে হাসান অ্যান্ড ব্রাদার্সের মীর মোহাম্মদ হাসান জানান।
পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা বলছেন, নাশকতার কোনো ঘটনা ঘটলে ভাড়ার চেয়ে ক্ষতির পরিমাণ কয়েকগুণ বেশি হয়। মহাসড়কের ঝুঁকি আর জ্বালানি স্বল্পতার কারণে ‘বাধ্য হয়ে’ তারা ভাড়া বাড়াচ্ছেন।
চট্টগ্রাম থেকে দেশের বিভিন্ন জেলায় পণ্য পরিবহনের জন্য ট্রাক-কর্ভাড ভ্যান ভাড়া পাওয়া যায় নগরীরর কদমতলিতে। শনিবার সেখানে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকা পর্যন্ত বড় ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যানের ভাড়া চলছে ২২ থেকে ২৫ হাজার টাকা। আর ছোট ট্রাকের ভাড়া ১৫ হাজার টাকা।
খুলনা, রাজশাহী ও হিলি বন্দর থেকেও ট্রাকের ভাড়া বেড়েছে। খুলনা ও হিলি বন্দর থেকে বড় ট্রাকের ভাড়া নেওয়া হচ্ছে ৫০ থেকে ৫৫ হাজার টাকা, অবরোধের আগেও যা ৩৫-৪০ হাজার টাকা ছিল।
রাজশাহী থেকে চট্টগ্রামে চলাচলকারী ট্রাকের ভাড়া ৫০ হাজার থেকে বেড়ে ৬০-৬৫ হাজার টাকায় উঠেছে।
শনিবার খুলনা থেকে খাতুনগঞ্জে পেঁয়াজ নিয়ে আসা ট্রাক চালক মো. ইব্রাহিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মহাসড়কে যে কোনো সময় হামলা হতে পারে- রাস্তায় নামলেই ভয় থাকে।
“গাড়ির কিছু হলে ক্ষতি পোষানোর বিষয় থাকে। এছাড়া জ্বালানিও কম পাওয়া যাচ্ছে। তাই মালিক ভাড়া বাড়িয়েছে।”
চট্টগ্রামের ট্রান্সপোর্ট ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল্লাহ ফারুক নোবেল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গাড়িতে আগুন দিলে যে ক্ষয়ক্ষতি হয় তা মেরামতে খরচ হয় ভাড়ার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি।
“যাদের বেশি গাড়ি আছে তারা ভয়ে ভাড়া দিচ্ছেন না। যেসব মালিকের একটি-দুটি গাড়ি, তারাই ব্যবসা বাঁচাতে ভাড়া দিচ্ছে। এসব কারণে ভাড়া কিছুটা বেশি।”
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পরিবহন মালিক বলেন, নাশকতা হলে গাড়িটি ক্রেন দিয়ে সরাতে হয়। তার খরচও দিতে হয় পরিবহন মালিককে।
“ক্ষতিপূরণ নেওয়ার চেয়ে গাড়ি সরিয়ে পণ্যের মালিককে মালামাল বুঝিয়ে দেওয়াই তখন জরুরি হয়ে দাঁড়ায়।”
মহাসড়কে পুলিশ-র্যা ব-বিজিবির টহল থাকলেও অনেক মালিক পণ্য আনা-নেওয়ার ঝুঁকি নিতে চান না বলে জানান পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর পরিচালক অঞ্জন শেখর দাশ।
তিনি বলেন, “গাড়ির হয়তো বীমা করা আছে, কিন্তু পণ্যের তো বীমা নেই। এ কারণে নির্ধারিত সময়ে রপ্তানি পণ্য পাঠাতে সমস্যা হচ্ছে।”
পরিবহন খরচ বৃদ্ধি প্রসঙ্গে অঞ্জন বলেন, ঢাকা থেকে ১৫ থেকে ১৮ হাজার টাকার গাড়ির ভাড়া এখন ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা। ২০১৩ সালে সহিংসতার সময় এ ভাড়া আরও বেশি উঠেছিল।
“অবরোধ-সংঘাত কারো কাম্য নয়। ব্যবসায়ীরা শান্তি চায়।”
গত ৫ জানুয়ারি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সারা দেশে অবরোধের ডাক দেওয়ার পর প্রতিদিনই গাড়ি ভাংচুর ও গাড়িতে আগুন দেওয়া হচ্ছে।
অবরোধের প্রথম কয়েকদিন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে তেমন কোনো নাশকতা না ঘটলেও গত সোমবার রাতে মিরসরাইয়ে একটি ট্রাকে পেট্রোল বোমা ছোড়া হলে একজন নিহত হন। বুধবার বিকালে সীতাকুণ্ডের মীরের হাটে একটি কাভার্ড ভ্যানে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা।
বৃহস্পতিবার রাতে সীতাকুণ্ড উপজেলার কালুশাহ মাজার সংলগ্ন এলাকায় দুটি ট্রাক ও একটি কর্ভাড ভ্যানে আগুন দেয় অবরোধকারীরা। ভাংচুর করা হয় আরও অন্তত পাঁচটি গাড়ি।
চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের সহকারী সুপার (সীতাকুণ্ড মডেল থানা) সাইফুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এবার চোরাগোপ্তা হামলা হচ্ছে। পরিবহন চালক- মালিকরা শঙ্কায় আছেন। অনেকে মহাসড়কে গাড়ি নিয়ে নামার আগে ফোন করে পরিস্থিতি জানতে চান।”
তবে মহাসড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশ-বিজিবির টহল জোরদার করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পাহারা দিয়ে পণ্যবাহী যানবাহন পার করে দিচ্ছে বলে জানান তিনি।
প্রশাসনের পক্ষ থেকে আগেও এ ধরনের আশ্বাস এলেও ভরসা পাচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, পরিস্থিতির উন্নতি না ঘটলে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করা সত্যিই কঠিন হবে।