চালের ‘সিন্ডিকেট’ ভাঙার কথা কেবল মুখে

চালের বাজারে অস্থিরতার জন্য খোদ প্রধানমন্ত্রী কারসাজির কথা বললেও ব্যবসায়ীদের সেই ‘সিন্ডিকেট’ ভাঙতে তেমন কোনো সাফল্য দেখাতে পারেনি সরকার।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকশহীদুল ইসলামবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Sept 2017, 04:40 PM
Updated : 20 Sept 2017, 04:45 PM

গত তিন মাসে রেকর্ড পরিমাণ আমদানির পরও মোটা চালের কেজি পৌঁছে গেছে ৫০ টাকায়। বাণিজ্যমন্ত্রী ও খাদ্যমন্ত্রী এজন্য মিল মালিকদের কারসাজিকে দুষছেন। ‘সিন্ডিকেট করে’ দাম বাড়ানো হয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছেন পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারাও।

অভিযোগের মুখে থাকা চালকল মালিকরা ‘সিন্ডিকেটের’ কথা অস্বীকার করে বলেছেন, তারা ১৭ হাজার ব্যবসায়ী, এতজন মিলে ‘সিন্ডিকেট’ করা অসম্ভব।  তারা ‘নিয়ম অনুযায়ী’ চাল মজুদ করছেন।

তাদের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সম্মানীয় ফেলো এম আসাদুজ্জামান বলছেন, ‘সিন্ডিকেট’ তো হয় তিন-চার জন মিলে।

গত কয়েক মাস ধরে চালের বাজারে অস্থিরতা চলছে। কোরবানির ঈদের পর দাম চড়তে থাকে। মোটা চালের দাম ৫০ টাকা ছাড়িয়ে যায়, সরু চাল ছাড়ায় ৬৫ টাকা।

সরকারি সংস্থা টিসিবির হিসেবে, মোটা চালের দাম গত এক মাসে বেড়েছে ১৮ শতাংশ, এক বছরে ৫০ শতাংশ। এক বছর আগে এই সময়ে মোটা চাল ৩৩ থেকে ৩৬ টাকা এবং সরু চাল ৪২ থেকে সর্বোচ্চ ৫৫ টাকায় বিক্রি হয়।

বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার আমদানি শুল্ক কমানোর পাশাপাশি সরকারিভাবেও চাল আমদানির উদ্যোগ নেয়। জুলাইয়ের শুরু থেকে গত আড়াই মাসে ছয় লাখ টন চাল আমদানি হলেও বাজারে দাম কমেনি।

জুন মাসের শেষে বাজেট পাসের আগে জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “এই মূল্য বৃদ্ধিটা বৃষ্টির কারণে। যেহেতু হাওরে ফসল নষ্ট হয়েছে; তার কারণে কিছু মূল্য বৃদ্ধি। আর এখানে হয়ত কিছু অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি থাকতে পারে।”

এরপর গত ১৩ জুলাই অবৈধভাবে চাল মজুদ করায় ১৬ হাজার মিল মালিককে তিন বছরের জন্য কালো তালিকাভুক্তির খবর জানান খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম।

তখন খাদ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদও চালের বাজারে ‘কারসাজির’ কথা বলেন। সেই ‘কারসাজির’ জাল ছিঁড়তে বিভিন্ন জেলায় আড়তে শুরু হয় অভিযান।

কুষ্টিয়ার খাজানগরে বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল ওনার্স অ্যাসোসিশেনের সভাপতি আব্দুর রশিদের চালকলে দুবার অভিযানের পর চালের দাম আরও বেড়ে যায়।

এই অবস্থায় চাল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মঙ্গলবার সভায় ফের ‘কারসাজির’ কথা বলে তোপের মুখে পড়েন খাদ্যমন্ত্রী কামরুল। ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে অভিযান (যা ব্যবসায়ীদের ভাষায় হয়রানি) স্থগিতের কথাও জানান মন্ত্রীরা। তখন ব্যবসায়ীরাও দাম কমিয়ে আনার আশ্বাস দেন।

মন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠকে চাল ব্যবসায়ীরা

তাহলে ‘সিন্ডিকেট’ ভাঙার কী হবে?

বন্যা ও রোগবালাইয়ের কারণে ফসলহানির পরেও এক কোটি ৯২ লাখ টন ধান ঘরে উঠেছিল জানিয়ে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল গত ১৪ সেপ্টেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, দেশের ভেতর এত চাল থাকলেও এ নিয়ে ‘চালবাজি ও রাজনীতি’ হচ্ছে।

এক শ্রেণির ব্যবসায়ী ও মিল মালিকরা চাল নিয়ে এই ‘চালবাজি’ করছেন অভিযোগ করেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী গত ১৫ সেপ্টেম্বর বলেন, চালের মজুদ রেখে কেউ কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করতে চাইলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

পুলিশ প্রধান এ কে এম শহীদুল হকও বলেন, বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করতে কেউ চাল মজুদ করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া আছে।

খাদ্য অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, চালের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ‘সিন্ডিকেটকারীদের’ চিহ্নিত করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল।

“ওই নির্দেশনার পর খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ ইউনিট তদন্ত করে একটি প্রতিবেদন তৈরির কাজে হাত দিয়েছে। চালের বাজার কেন অস্থির, সরকারের করণীয় কী- এসব ওই রিপোর্টে বিস্তারিত জানানো হবে।”

বড় বড় মিল মালিকদের সঙ্গে সরকারি দলের প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের ‘সখ্য’ রয়েছে বলেও দাবি করেন খাদ্য অধিদপ্তরের ওই কর্মকর্তা।

বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভী সম্প্রতি বলেন, “মজুদদারি ও সিন্ডিকেট তো সম্পূর্ণ আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণে। তারাই দীর্ঘ ৯ বছর যাবত সিন্ডিকেট করে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বৃদ্ধি করছে।”

কুষ্টিয়ায় আব্দুর রশিদের চালকলে অভিযান

‘সিন্ডিকেটকারীদের’ ধরতে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে- এ প্রশ্নে খাদ্যসচিব মো. কায়কোবাদ হোসেন বুধবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এটা সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ফাইন্ড আউট করার চেষ্টা করে। … যারা (সরকারি গুদামে) চাল দিয়েছে তাদের লিস্ট আছে, যারা চাল দেয়নি তাদেরও লিস্ট আছে।”

“এবার কী হয়েছে আপনারা ভালোই জানেন,”- মন্তব্যের পর তার বক্তব্যে এখন ‘সিন্ডিকেটকারীদের’ ধরার চেয়ে এখন বাজার সহনীয় করার উপরই সরকারের জোর দেওয়ার কথা প্রকাশ পায়।

“চাল মালিক যারা আছেন তাদেরকে শাস্তি দেওয়ার জন্য তো আমরা বসে নাই। তাদের সহযোগিতা নিতে হবে।”

খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. বদরুল হাসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, গত ১৩ জুলাইয়ের পর নতুন করে কোনো চাল ব্যবসায়ীকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়নি।

সরকার চায় না?

রাজধানীর কারওয়ান বাজার ও বাবুবাজারের কয়েকজন পাইকারি ও খুচরা চাল ব্যবসায়ী দাবি করেছেন, এবার সিন্ডিকেটের মাধ্যমেই চালের দাম বাড়ানো হয়েছে।

তাদের একজন বাবুল হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সিন্ডিকেট না করলে কখনই এভাবে চালের দাম বাড়ে না, অবশ্যই সিন্ডিকেট আছে।”

‘সরকার চাইলেই’ এই ‘সিন্ডিকেট’ ভেঙে দিয়ে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে বলে মনে করেন তিনি।

মিরপুর-১ নম্বর বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী বিল্লাল রাইসের মালিক ওয়াহিদুজ্জামান খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “চালের বাজারে এত অস্থিরতা গত ২৫ বছরের ব্যবসায়িক জীবনে দেখিনি। এটা পুরাপুরি মিলারদের কারসাজি।”

তাদের মতোই মত বিআইডিএসের সম্মানীয় ফেলো আসাদুজ্জামানের।

তিনি বলেন, “বাজারে চালের সরবরাহ কম কেন এবং দাম কেন বেশি- সেই প্রশ্ন ব্যবসায়ীদের করতে হবে। তাদের কাছে যে চাল আছে সেটা কেন বাজারে ছাড়ছেন না?

“তিন মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর ব্যবসায়ীরা কেজিতে দুই টাকা করে দাম কমানোর আশ্বাস দিলেও তাদের কাছ থেকে জানতে হত- কেজিতে ১৫ টাকা বেড়েছে কেন?”

চালের বাজারে অস্থিরতায় বাড়ছে ক্ষোভ

“কোন ব্যবসায়ীর কাছে কতটুকু খাদ্যশস্য মজুদ আছে সেই তথ্য সব সময়ই সরকারকে রাখার কথা থাকলেও গত চার বছরে সরকার এটা করেনি। গতবারের থেকে এবার মজুদ অনেক কমে যাওয়ার পরেও খাদ্য মন্ত্রণালয় কি নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছিল?” প্রশ্ন করেন তিনি।

সরকার ‘সিন্ডিকেট’ কেন ভাঙছে না- এ প্রশ্নে আসাদুজ্জামান বলেন, “সংসদীয় কমিটিতে যদি চালকল মালিকরা বসে, তাহলে কী অবস্থা হবে? এটা তো সর্ষের মধ্যে ভূত।”

সংসদীয় কমিটির সঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন আসাদুজ্জামান।

ব্যবসায়ীরা চালের দাম দুই-তিন টাকা কমানোর আশ্বাস দিলেও কমপক্ষে ১০ থেকে ১৫ টাকা কমানো উচিৎ ছিল বলে মত দিয়ে তিনি বলেন, মোটা চালের দাম এখন ৩২ থেকে ৪০ টাকার মধ্যে হওয়ার কথা।

‘এত লোকে সিন্ডিকেট কেমনে হয়?’

মন্ত্রী থেকে শুরু করে পাইকার ও খুচরা বিক্রেতাদের মুখে ‘সিন্ডিকেটের’ কথা এলেও বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল ওনার্স অ্যাসোসিশেনের নেতারা সেই অভিযোগ উড়িয়ে দিচ্ছেন।

সমিতির সাধারণ সম্পাদক কে এম লায়েক আলী বুধবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের দোষ দেওয়া সবচেয়ে সহজ, কারণ আমরা প্রতিবাদ করতে পারি না।

“চিনি ও তেল ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করতে পারে কারণ তারা সংখ্যায় অল্প। ১৭ হাজার ব্যবসায়ী মিলে কেমনে সিন্ডিকেট হয়? সিন্ডিকেট করে করে চালের দাম বাড়ানোর প্রশ্নই আসে না।”

এই কারসাজির জন্য কুষ্টিয়া ও নওগাঁর চালকল মালিকদের বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল উঠেছে।

কুষ্টিয়া জেলা চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদীন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, একে অন্যের ঘাড়ে দোষ না দিয়ে সংশ্লিষ্ট সবাই বসে তা খুঁজে বের করা উচিৎ।

“খাদ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে মিলার, ব্যবসায়ী, কৃষক, ভোক্তা ও গণমাধ্যমের দুজন করে প্রতিনিধি নিয়ে এক জায়গায় বসে খুঁজে বের করা হোক যে, এই চালের মূল্য বৃদ্ধির চক্রান্তে গোড়া কোথায় বা কারা জড়িত।”

বোরো ফসল ওঠার আগে এখন কৃষকের হাতে ধান নেই বলে কুষ্টিয়ার কৃষক ও আড়তদাররা জানিয়েছেন।

আয়ুব আলী নামে এক আড়তদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখন তো মৌসুম না, ফলে কৃষকরা হাটে ধান আনছে না। ধানের মজুত এখন মিলারদের দখলে।”

বারখাদা এলাকার কৃষক আব্দুল আজিজ বলেন, “বর্তমান বাজারে ধানের দাম বৃদ্ধি বা হ্রাস যাই হোক না কেন সবই এখন মিলার ও ব্যবসায়ীদের হাতে।”

কৃষক ও আড়তদাররা বলছেন, চাল সব এখন মিলারদের হাতে

চালকল মালিক আব্দুস সামাদ বলছেন, ভোক্তাদের পছন্দের চিকন চাল উৎপাদনে মিলগুলোকে মজুত রাখতে হয়।

চালকল মালিক মোমিন মন্ডল বলেন, কুষ্টিয়ার চালের মোকাম খাজানগরের ৩১টি অটোসহ সচল হাস্কিং রাইচ মিলগুলি তাদের মজুত থেকেই চাল উৎপাদন করে যাচ্ছে।

সরকার নিজের গুদামে থাকা চাল কম দামে বাজারে ছেড়ে দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও এবার মজুদ না থাকায় তা করতে পারছে না। ফলে ব্যবসায়ীরাও সুযোগ বুঝে চালের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে বলে অভিযোগ।

বর্তমানে সরকারি গুদামে ৩ লাখ ৪৫ লাখ টন চাল মজুদ রয়েছে। গত বছরের এই সময়ে মজুদ ছিল ৭ লাখ ৯১ হাজার টন চাল।

আমদানি শুল্ক কমানোর আগে জুলাইয়ের শুরুতে সরকারি গুদামে ১ লাখ ৬৫ হাজার টন চাল মজুদ ছিল।

আমদানির পরও বাজার নিয়ন্ত্রণে নিজেদের অসহায়ত্বের প্রকাশ ঘটিয়ে খাদ্য অধিদপ্তরের পরিচালক কাজী নুরুল ইসলাম বলেন, “বড় মিলারদের কাছে চাল থাকে, এরাই তো বাজারটা নিয়ন্ত্রণ করে। বাংলাদেশের ভোজ্য তেলের বাজারও তাই, কয়েকটা কোম্পানি ভোজ্য তেল আনে, তারা যদি দাম বাড়িয়ে দেয় তাহলে করার কিছু নাই।”

[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কুষ্টিয়া প্রতিনিধি হাসান আলী]