মজুদ করা যায় কতটুকু চাল

মিল মালিকদের কারসাজিতে বাঙালির প্রধান খাদ্যশস্য চালের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে অভিযোগ করে চালকলগুলোতে অভিযান শুরু করেছে সরকার।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকশহীদুল ইসলাম, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 Sept 2017, 03:38 PM
Updated : 18 Sept 2017, 04:07 PM

আমদানিকারক, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ী এবং চালকল মালিকরা কী পরিমাণ চাল মজুদ করতে পারবেন- সে বিষয়ে নীতিমালা থাকলেও তা বাস্তবায়নে খাদ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের তদারকি নেই।

খাদ্য অধিদপ্তরের একজন পরিচালক বলেছেন, নীতিমালা মেনে ১৫ দিন পর পর প্রত্যেকটি মিল পরিদর্শনের কথা, কিন্তু সেই জনবল তাদের নেই।

ধারাবাহিকভাবে চালের দাম বৃদ্ধির মধ্যে কুষ্টিয়ার খাজানগরে বাংলাদেশ চালকল মলিক সমিতির সভাপতি আব্দুর রশিদের চালকলসহ কয়েকটি মিলে এক সপ্তাহের ব্যবধানে দুই দফা অভিযান চালানো হয়।

এর মধ্যে গত সপ্তাহে র‌্যাবের অভিযানে অতিরিক্ত মজুদের দায়ে ‘রশিদ এগ্রো ফুড প্রোডাক্টস’ থেকে ৫০ টন চাল জব্দের পাশাপাশি ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। আর রোববার জেলা প্রশাসন টাস্কফোর্সের দ্বিতীয় দফার অভিযানে সেখানে নতুন করে কিছু মেলেনি। 

কিন্তু রশিদকে জরিমানা করার পর এই কদিনে মিনিকেট চালের দাম বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) চারশ টাকার মতো বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে অন্যান্য চালের দাম।

বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল ওনার্স অ্যাসোসিশেনের সাধারণ সম্পাদক কে এম লায়েক আলীর দাবি, তারা নিয়ম মেনেই ধান ও চাল মজুদ করেন।

“কোনো মিলেই অতিরিক্ত স্টক থাকে না। আমার জানা মতে কোনো মিলেই হিসেবের বেশি চাল নেই।”

তাহলে কুষ্টিয়ার আব্দুর রশিদের মিলকে কেন জরিমানা করা হয়েছে- এ প্রশ্নে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “শুনেছি ভোক্তা আইন লংঘনের জন্য জরিমানা করা হয়েছে। তবে ভোক্তা অধিকার আইন কীভাবে লংঘিত হল সেটা আমাদের জানা নেই।”

কী পরিমাণ খাদ্যশস্য কতদিন মজুদ রাখা যাবে তা নির্ধারণ করে ২০১১ সালের ৪ মে গেজেট জারি করে সরকারের খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়।

ওই গেজেট অনুযায়ী, লাইসেন্স ছাড়া কোনো ব্যবসায়ী এক টনের বেশি খাদ্যশস্য বা খাদ্য সামগ্রী মজুদ রাখতে পারবেন না।

আর আমদানিকারক, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ী এবং চালকল মালিকরা সরকার নির্ধারিত হারে ধান ও চাল নির্ধারিত সময়ের জন্য মজুদ করতে পারবেন।

>> অটোমেটিক, হাসকিং ও মেজর চালকলের মালিকরা তাদের পাক্ষিক (১৫ দিন) ছাঁটাই ক্ষমতার পাঁচগুণ ধান ৩০ দিনের জন্য মজুদ করতে পারবেন।

>> অটোমেটিক ও মেজর চালকলের মালিকরা পাক্ষিক ছাঁটাই ক্ষমতার দুই গুণ চাল এবং হাসকিং চালকলের মালিকরা সর্বোচ্চ ১০০ মেট্রিক টন চাল ১৫ দিন পর্যন্ত মজুদ রাখতে পারবেন।

>> পাইকারি বিক্রেতেরা সর্বোচ্চ ৩০০ টন ধান বা চাল ৩০ দিন মজুদ রাখতে পারবেন।

>> আর খুচরা বিক্রেতেরা ১৫ দিনের জন্য সর্বোচ্চ ১৫ টন এবং আমদানিকারকরা আমদানিকৃত ধান বা চালের সবটুকু ৩০ দিন পর্যন্ত মজুদ করতে পারবেন।

অন্যান্য খাদ্যশস্য মজুদ

>> পাইকারি বিক্রেতেরা সর্বোচ্চ ২০০ টন গম বা গমজাত দ্রব্য ৩০ দিনের জন্য মজুদ করতে পারবেন। আর খুচরা বিক্রেতেরা ১৫ দিনের জন্য সর্বোচ্চ ১০ টন এবং আমদানিকারকরা আমদানিকৃত সবটুকু গম এক মাস মজুদ রাখতে পারবেন।

>> পাইকারি বিক্রেতেরা সর্বোচ্চ ৫০ টন পরিশোধিত চিনি ৩০ দিনের মজুদ করতে পারবেন। আর খুচরা বিক্রেতেরা ৩০ দিনের জন্য সর্বোচ্চ পাঁচ টন চিনি এবং আমদানিকারকরা আমদানিকৃত চিনির ৫০ ভাগ ৪০ দিনের জন্য মজুদ করতে পারবেন।

>> পাইকারি বিক্রেতেরা সর্বোচ্চ ৩০ টন পরিশোধিত সয়াবিন তেল ও পরিশোধিত পামওয়েল ৩০ দিনের জন্য মজুদ রাখতে পারবেন। খুচরা বিক্রেতেরা সর্বোচ্চ পাঁচ টন পরিশোধিত সয়াবিন তেল ও পরিশোধিত পামওয়েল সর্বোচ্চ ৩০ দিন মজুদ রাখতে পারবেন। আর আমদানিকারকরা আমদানিকৃত ভোজ্য তেলের ২৫ শতাংশ মজুদ করতে পারবেন ৫০ দিনের জন্য।

>> পাইকারি বিক্রেতেরা সর্বোচ্চ ৪০ টন ডাল ৩০ দিনের জন্য মজুদ করতে পারবেন। খুচরা বিক্রেতেরা ২০ দিন মজুদে রাখতে পারবেন সর্বোচ্চ পাঁচ টন ডাল। আমদানিকারকরা আমদানিকৃত ডালের ২৫ শতাংশ ৬০ দিনের জন্য মজুদ করতে পারবেন।

না মানলে কী হবে?

বাংলাদেশের ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে মজুদদারি নিষিদ্ধ করে কঠোর সাজার বিধান রাখা হয়েছে।

আইনে মজুদদারির সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, কোনো আইন দ্বারা বা আইনের আবর্তে কোনো ব্যক্তি মজুদ অথবা গুদামজাত করার সর্বোচ্চ পরিমাণের বেশি দ্রব্য মজুদ বা সংরক্ষণ করলে তা মজুদদারি হিসেবে গণ্য করা হবে। 

এ আইনে মজুদদারি বা কালোবাজারির সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বা আজীবন কারাদণ্ড। অপরাধের মাত্রা ভেদে অন্যান্য মেয়াদের কারাদণ্ড ও জরিমানাও করা যেতে পারে।

তবে অভিযুক্ত ব্যক্তি যদি প্রমাণ করতে পারে যে, তিনি আর্থিক বা অন্যভাবে লাভের জন্য মজুদ করেননি, সেক্ষেত্রে তাকে সর্বোচ্চ তিন মাসের জেল ও জরিমানা করা যাবে।

নজরদারিই নেই

সরকার ২০১১ সালের গেজেটের মাধ্যমে চাল, গম ও গমজাতীয় দ্রব্য ছাড়াও ভোজ্য তেল (সয়াবিন ও পামওয়েল), চিনি এবং ডালকে খাদ্য সমাগ্রী হিসেবে ঘোষণা করে এবং মজুদের অনুমোদিত পরিমাণ নির্ধারণ করে দেয়।

গেজেটে বলা হয়েছে, আমদানিকারক বা পাইকারি বিক্রেতেরা অনুমোদিত মেয়াদের মধ্যে মজুদে থাকা পণ্য বিক্রি করতে না পারলে তা সরকারের নির্ধারিত কর্মকর্তাকে নির্ধারিত ছকে জানাতে হবে।

যারা লাইসেন্সধারী ব্যবসায়ী, তাদের আমদানি, ক্রয়, মজুদ ও বিক্রয়ের হিসাব নির্ধারিত ছকে ১৫ দিন পর পর লাইসেন্স প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ বা ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে। ওই কর্তৃপক্ষ মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে তদন্ত করে তা খাদ্য মন্ত্রণালয়কে জানাবে।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, খাদ্য অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের প্রতি মাসে কমপক্ষে দুইবার গুদামের মজুদ পরিস্থিতি তদারকি করে প্রতিবেদন দেওয়ার বিধান আছে।

“গুরুত্বপূর্ণ এই কাজটিই নিয়মিতভাবে হচ্ছে না। অনেক খাদ্যগুদাম কয়েক বছরেও একবার পরীক্ষা হয় না। মন্ত্রণালয়ে যেসব প্রতিবেদন আসে তাতে প্রকৃত চিত্র থাকে না।”

বিষয়টি স্বীকার করে খাদ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (পরিচালক সরবরাহ, বণ্টন ও বিপণন) কাজী নুরুল ইসলাম সোমবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রায় দুই হাজার রাইস মিল রয়েছে দেশে। সে অনুযায়ী আমাদের এত লোক নেই। ১৫ দিন পর পর প্রতিটি মিল দেখার লোকবল নেই। এত দিন তো আমাদের (মিল) দেখার দরকারও পড়েনি, এখন দরকার পড়ছে।”

ধান-চালের পাশাপাশি অন্যান্য খাদ্যশস্য অতিরিক্ত মজুদ করলে অভিযানের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেওয়া যায় জানিয়ে তিনি বলেন, “মিল মালিকরা মিলের ক্যাপাসিটি থেকে পাঁচগুণ বেশি ধান এক মাস পর্যন্ত রাখতে পারবেন। একটা মিলের পাক্ষিক ক্যাপাসিটি ৩০০ টন হলে মাসে ক্যাপাসিটি ৬০০ টন। অর্থাৎ ৩০০০ টন ধান সে এক মাস রাখতে পারবে। এটা লংঘন করলে আমরা অভিযান চালাচ্ছি। ভ্রাম্যমাণ আদালতও পরিচালনা করা যাবে।”

নুরুল ইসলাম বলেন, বৃষ্টি-বাদল হলে মিল মালিকরা অনেক সময় ধান ভাঙাতে পারেন না বা অনেক সময় ভাঙানো ধান বিক্রি হয় না। তেমন পরিস্থিতিতে সরকারকে জানালে যৌক্তিক ক্ষেত্রে সময় দেওয়া হয়।

কত লাভ করা যাবে?

চালের দাম বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে সরকার শুল্ক কমানোর পর গত চার মাসে বেসরকারিভাবে ভারত থেকে সাড়ে ছয় লাখ টন চাল আমদানি হয়েছে বলে জানান নুরুল ইসলাম।

কিন্তু আমদানি করা পণ্য কত শতাংশ লাভে দেশের বাজারে বিক্রি করা যাবে- সে বিষয়ে কোনো নিয়ম না থাকায় বাজার নিয়ন্ত্রণে সাফল্য আসছে না। পুরো বিষয়টি নির্ভর করছে ব্যবসায়ীর মর্জির ওপর। 

খাদ্য অধিদপ্তরের পরিচালক বলেন, “কত পারসেন্ট লাভ দেবেন? তারা তো চেষ্টা করবে ২০ শতাংশ লাভ করতে। কারণ আমাদের তো কোনো নিয়ম নাই, এখানে সরকারের ইন্টারভেনশন লাগে। কিন্তু মার্কেট এত বড়… আপনি ইন্টারভেনশন করবেন কীভাবে? এত ব্যবসায়ী… এদের তো নিয়ন্ত্রণ করা যায় না যদি তাদের মধ্যে কোনো নৈতিকতাবোধ ও দায়বদ্ধতা না থাকে।”

নুরুল ইসলাম বলেন, “লাভ করুক, একটু সীমিত আকারে লাভ করলেই হয়। যুক্তিসঙ্গত হল- সব খরচ বাদ দিয়ে কেজিতে এক টাকা দেড় টাকা লাভ করতে পারেন। কিন্তু এখানে তো সুযোগ বুঝে তিন-চার টাকাও বাড়িয়ে দিচ্ছেন।”

মজুদদারি নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে খাদ্য অধিদপ্তরের এই কর্মকর্তা বলেন, সবাই বড় মিলার না। বড় মিলারদের কাছে চাল থাকে, আর তারাই বাজার নিয়ন্ত্রণ করে।

“বাংলাদেশে ভোজ্য তেলের বাজারও তাই, কয়েকটা কোম্পানি ভোজ্য তেল আনে, তারা যদি দাম বাড়িয়ে দেয় তাহলে করার কিছু নাই।”