চার দশক আগে যুদ্ধাপরাধের একটি অভিযোগে চাঁপাইনবাবগঞ্জের মাহিদুর রহমান ও আফসার হোসেন চুটুর সাজা হওয়ার পরও ট্রাইব্যুনালের মামলায় নতুন করে একই অভিযোগ যুক্ত করায় তদন্ত কর্মকর্তাকে ‘অযোগ্য’ বলে তিরস্কার করা হয়েছে এ মামলার রায়ে।
Published : 20 May 2015, 07:03 PM
এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সহকারী পুলিশ সুপার জেড এম আলতাফুর রহমানকে নতুন করে ট্রাইব্যুনালের কোনো মামলার তদন্তভার দেওয়া ঠিক হবে না বলেও আদালত পর্যবেক্ষণ দিয়েছে।
বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ বুধবার এ মামলার রায় ঘোষণা করে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়ে অপহরণ, নির্যাতন ও হত্যার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধে যুক্ত থাকায় প্রসিকিউশনের প্রথম অভিযোগে মাহিদুর ও আফসারকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়। দ্বিতীয় অভিযোগে তাদের দেওয়া হয় পাঁচ বছরের কারাদণ্ড।
তৃতীয় অভিযোগে নির্যাতন, অপহরণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ এবং চার জনকে হত্যার ঘটনায় ১৯৭২ সালের দালাল আইনে দুই আসামির যাবজ্জীবন সাজা হয়। ওই রায়ের পর আফসার ও মাহিদুর জেলও খাটেন।
এ বিষয়টি উল্লেখ করে ট্রাইব্যুনালের রায়ে প্রসিকিউশনের তৃতীয় অভিযোগ বাদ দেওয়া হয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা জেড এম আলতাফুর রহমানকে এ বিষয়ে ‘সম্পূর্ণ অযোগ্য’ বলেও মন্তব্য করা হয় রায়ে।
প্রসিকিউশনের তৃতীয় অভিযোগে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ২ নভেম্বর বেলা ২টা থেকে পরদিন ৩ নভেম্বর রাত পর্যন্ত শিবগঞ্জ থানাধীন শেরপুর ভাণ্ডার (লক্ষ্মীপুর) আদিনা ফজলুল হক সরকারি কলেজ, শিবগঞ্জ সিও (ডেভ) অফিস আর্মি ক্যাম্প এবং উপজেলা সংলগ্ন ইয়াকুব বিশ্বাসের আমবাগান এলাকায় মাহিদুর ও আফসারের সহায়তায় রাজাকার বাহিনী আটক, নির্যাতন, অপহরণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ করে এবং কলিমুদ্দিন মণ্ডল, তার ছেলে, ভাই ও ভাইয়ের ছেলেকে হত্যা করে।
১৯৭৩ সালের কোনো এক সময় কলিমুদ্দিনের আরেক ছেলে মো. লায়েসউদ্দিন দালাল আইনে একটি মামলা করেন। এক নম্বর সাক্ষী হিসেবে আদালতে তিনি সে সময় সাক্ষ্যও দেন।
ওই মামলায় মাহিদুর ও আফসারকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় রাজশাহীর দুই নম্বর বিশেষ ট্রাইব্যুনাল। পরে আপিলেও তাদের সাজা বহাল থাকে; দুই আসামিকে সাজা খাটতে হয়।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মধ্য দিয়ে আবারও বহু প্রতীক্ষিত সেই বিচার শুরু হয়।
মুক্তিযুদ্ধের সময় শিবগঞ্জ উপজেলার বিনোদপুর স্কুল মাঠ ও আশেপাশের এলাকায় গণহত্যার ঘটনায় ২০১৩ সালে মাহিদুর রহমান ও আফসার হোসেন চুটুসহ ১২ জনকে আসামি করে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আদালতে একটি মামলা হয়।
মামলাটি করেন গণহত্যার শিকার শহীদ পরিবারের সদস্য শিবগঞ্জ উপজেলার মনাকষা ইউনিয়নের পারচৌকা গ্রামের বদিউর রহমান বুদ্ধু। পরে তা ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়।
এ মামলায় ২০১৪ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর শিবগঞ্জের দুর্লভপুর ইউনিয়ন থেকে মাহিদুর এবং বিনোদপুর থেকে আফসারকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
কিন্তু প্রসিকিউশনের ভুলে অন্য দুটি অভিযোগের সঙ্গে তৃতীয় অভিযোগটি রেখেই ২০১৪ সালের ১১ ডিসেম্বর মাহিদুর ও আফসারের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে আদালত, শুরু হয় বিচার।
বর্তমান মামলার যুক্তিতর্ক চলাকালে চলতি বছরের ৫ মার্চ ১৯৭৩ সালে হাই কোর্টের দেওয়া রায়ের অনুলিপি ট্রাইব্যুনালে দাখিল করে আসামিপক্ষ।
এছাড়া প্রথম ও দ্বিতীয় অভিযোগের বিষয়েও ১৯৭২ সালে শিবগঞ্জ পুলিশ স্টেশনে দুটি মামলা হয় বলে আসামিপক্ষের আইনজীবী দাবি করেন। তবে ওই দুই মামলার কোনো কাগজপত্র তিনি দাখিল করতে পারেননি।
বুধবার ট্রাইব্যুনালের রায়ে বলা হয়, “একই অপরাধে কোনো অপরাধীর দুইবার সাজা হতে পারে না। এ কারণে তিন নম্বর অভিযোগটি সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে বাতিল করা হল।”
রায়ের এ অংশের বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের একজন বিচারক অপর দুইজনের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেছেন।
তিনি বলেছেন, প্রাথমিকভাবে প্রসিকিউশনের উপস্থাপিত তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতেই আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ চূড়ান্ত করা হয়েছিল। সুতরাং বাকি দুটি অভিযোগের সঙ্গে তৃতীয় অভিযোগেরও নিষ্পত্তি করতে হবে।
তবে অভিযোগটি প্রমাণ করতে প্রসিকিউশন ‘ব্যর্থ হয়েছে’ বিবেচনা করে বিচারক এ অভিযোগ থেকে আসামিদের অব্যাহতি দেওয়ার কথা বলেন।
তবে অপর দুই বিচারক অভিযোগটি বাদ দেওয়ার পক্ষে মত দেওয়ায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে এই রায় চূড়ান্ত হয়।
রায়ের আরেকটি অংশে মামলার তদন্ত কর্মকর্তার বিষয়ে বলা হয়, “দায়িত্বে পুরোপুরি অবহেলা করার জন্য এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা জবাবদিহি করা উচিৎ।”
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যেহেতু মানবতাবিরোধী অপরাধ, গণহত্যার মতো অত্যন্ত স্পর্শকাতর মামলার বিচার হয়, সেহেতু ‘এমন তদন্তকারী কর্মকর্তাকে’ ভবিষ্যতে ট্রাইব্যুনালের কোনো মামলার তদন্তে রাখা উচিৎ হবে না বলেও রায়ে উল্লেখ করা হয়।
ট্রাইব্যুনাল বলেছে, “যার জন্য জাতি ৪১ বছর ধরে অপেক্ষা করে আছে, এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলার বিষয়ে এমন একজন অযোগ্য ও দায়িত্বজ্ঞানহীন পুলিশ কর্মকর্তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্তে নিয়োগ করার জন্য তদন্ত সংস্থাও দায় এড়াতে পারে না।”
রায়ের আরেকটি অংশে বলা হয়, দীর্ঘদিন ধরে পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োজিত থাকায় তদন্ত কর্মকর্তার বোঝা উচিৎ ছিল যে, একজন ব্যক্তি একই অপরাধে দুইবার সাজা ভোগ করতে পারেন না।
সহকারী পুলিশ সুপার আলতাফুর রহমান দেশের বাইরে থাকায় এ বিষয়ে তার কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান খান রায়ের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, “রায়ের পুরোটা না পড়ে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না। তবে আমরা যখন তদন্ত করি, তখন অনেক কাগজপত্রই আমরা ভালো অবস্থায় পাই না। এ বিষয়ে কাগজপত্রগুলো পাওয়া যায়নি কেন, তা খতিয়ে দেখা হবে।”
এক প্রশ্নের জবাবে প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ বলেন, “ট্রাইব্যুনালের রায়ের প্রতি সম্পূর্ণ সম্মান রেখে বলছি, আমরা আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করেছি, করব। মাননীয় আদালত যে রায় দিয়েছেন, তার প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল।”