বদরপ্রধানের মন্ত্রিত্ব: রূপকথা নয়

ফাঁসির দড়ি এড়াতে পারলেন না বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সাবেক মন্ত্রী একাত্তরের ঘাতক বাহিনী আলবদর প্রধান মতিউর রহমান নিজামী।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 Oct 2014, 08:59 AM
Updated : 11 May 2016, 07:59 AM

অস্ত্র চোরাচালান মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৭৩ বছর বয়সী জামায়াত আমিরকে ফাঁসির দড়ি পরতে হয়েছে চার দশক আগের হত্যা, ধর্ষণ এবং বুদ্ধিজীবী গণহত্যার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে।

যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুদণ্ডের আদেশের চূড়ান্ত বিচার ও আইনি সব প্রক্রিয়ার পর বুধবার প্রথম প্রহরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিজামীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

এর আগে বিচারের সর্বশেষ ধাপে গত বৃহস্পতিবার এই যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন খারিজ করে দেয় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।

নিজামীকে গ্রেপ্তারের চার বছর পর ২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে তাকে মৃতুদণ্ড দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

এই রায়ের বিরুদ্ধে নিজামী উচ্চ আদালতে গেলে ২০১৬ সালের ৬ জানুয়ারি আপিলের রায়ে ফাঁসির দণ্ড বহাল রাখে সুপ্রিম কোর্ট। সব শেষে এই রায় পুনর্বিবেচনার আবেদনও খারিজ হয়।

২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর ট্রাইব্যুনাল যে রায় দিয়েছিল তার পর্যবেক্ষণে বলা হয়, মতিউর রহমান নিজামী একাত্তরে বাঙালি জাতিকে সমূলে ধ্বংস করার লক্ষ্যে তরুণদের উসকে দিতে সচেতনভাবে ইসলাম ধর্মের অপব্যবহার করেন।

আদালত বলে, “আমরা ধরে নিতে বাধ্য হচ্ছি যে, মতিউর রহমান নিজামী ইসলামিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও সচেতনভাবে এবং স্বেচ্ছায় আল্লাহ ও পবিত্র ধর্ম ইসলামের নামের অপব্যবহার করে বাঙালি জাতিকে সমূলে ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন।”

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে সেই নিজামীই বাংলাদেশের মন্ত্রী হয়ে গাড়িতে পতাকা লাগিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন। 

একাত্তরে ন্যাক্কারজনক ভূমিকার পরও তাকে মন্ত্রিত্ব দেওয়াকে লাখো শহীদদের প্রতি চপেটাঘাত বলে মন্তব্য করা হয় ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর্যবেক্ষণে।

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় বিশেষ করে ১৪ ডিসেম্বর শিক্ষক, শিল্পী, সাহিত্যিক ও পেশাজীবীদের হত্যাযজ্ঞে মূল নকশাকারী ও তা বাস্তবায়নকারী বলে প্রমাণিত একাত্তরের আল-বদর প্রধান নিজামী ১৯৪৩ সালের ৩১ মার্চ পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার মনমথপুর গ্রামে জন্ম নেন।

তরুণ বয়সে নিজামী। জামায়াতে ইসলামীর ওয়েবাসাইট থেকে নেওয়া ছবি।

জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের পাকিস্তান প্রধান হিসেবে তিনি আল-বদর বাহিনীর প্রধান নেতা ছিলেন। ১৯৬১ সালে তখনকার জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ, পরে যেটা ইসলামী ছাত্র শিবির নাম পায়, তাতে যুক্ত হন।

১৯৬৬ থেকে ১৯৬৯ পর্যন্ত পরপর তিনবার পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর ২২ এপ্রিল গঠিত হয় আল-বদর বাহিনী এবং এই বাহিনীর সারা পাকিস্তান প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পান নিজামী।

২৩ এপ্রিল ১৯৭১ সালে দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল- ‘যেখানে তথাকথিত মুক্তিবাহিনী আলবদর সেখানেই’। ১৬ অগাস্ট ১৯৭১ সালে দৈনিক সংগ্রামে প্রকাশিত হয়-‘পাকিস্তান ভূখণ্ডের নাম নয় আদর্শের নাম- মতিউর রহমান নিজামী’।

সে সময় নিজামী জনসম্মুখে মুক্তিকামী বাঙালি ও মুক্তিযোদ্ধাদের ‘দুর্বৃত্ত’ আখ্যায়িত করে তাদের নিশ্চিহ্ন করতে নিজের সংগঠনের সদস্যদের উৎসাহিত করতেন এবং উসকানি দিতেন বলে এ মামলার বিচারে প্রমাণিত হয়।

নিজামী বিভিন্ন সময়ে তার বক্তৃতায় ‘পাকিস্তান আল্লাহর ঘর’, ‘হিন্দুরা সবসময়ই মুসলিমদের শত্রু’ এবং ‘ইসলাম আর পাকিস্তান এক ও অভিন্ন' বলেও জনসভায় প্রচার করতেন।

দেশ স্বাধীনের পরপরই জামায়াতে ইসলামী ও তার সহযোগী সংগঠনগুলোর কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেন তখনকার সরকার প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

১৯৭৫ এর ১৫ অগাস্ট ক্ষমতার পালাবদলের পর ক্ষমতায় আসীন জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালে গোলাম আযম ও মতিউর রহমান নিজামীকে দেশে ফিরে আসার অনুমতি দেয়ার মাধ্যমে আবার বৈধভাবে দেশে রাজনীতি শুরু হয় দলটির।

সামরিক সরকারের সেই বৈধতার সুযোগে মতিউর রহমান নিজামী প্রথমে ১৯৭৮ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত জামায়াতের ঢাকা মহানগরীর আমির ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ১৯৮৩ সালে দলের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এবং ১৯৮৮ সালে সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব পান।

‘জামায়াতগুরু’ গোলাম আযম আমিরের পদ থেকে অবসরে গেলে ২০০০ সাল থেকে নিজামীর নেতৃত্বেই পরিচালিত হয় জামায়াতে ইসলামী।

১৯৯১ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত চার বার জামায়াতে ইসলামীর হয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচনে অংশ নিয়ে নিজামী দুই বার নির্বাচিত হন তার নির্বাচনী এলাকা পাবনা-১ আসন থেকে।

এর মাঝে ১৯৯৫-৯৬ সালে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে যুগপৎভাবে সরকারবিরোধী আন্দোলন করে আওয়ামী লীগ, যা নিয়ে দলটির সমালোচনা হয়, কেননা এর মাত্র কয়েক বছর আগে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধের বিচারের আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সমর্থন দিয়েছিল।

২০০১ সালে জামায়াত বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়ে জয় পাওয়ার পর নিজামীকে প্রথমে কৃষিমন্ত্রী (২০০১-২০০৩) ও পরে শিল্পমন্ত্রীর (২০০৩-২০০৬) দায়িত্ব দেন তখনকার প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া।

১০ ট্রাক অস্ত্র মামলার শুনানিতে জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামী ও সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরকে সোমবার চট্টগ্রাম আদালতে হাজির করা হয়। ছবি: সুমন বাবু/ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম/ চট্টগ্রাম, নভেম্বর ১৪, ২০১১

এ বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের রায়ে বলা হয়, “এটা বিশ্বাস করা খুবই কঠিন যে, সক্রিয়ভাবে যিনি বাংলাদেশে স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিলেন, তাকে এই প্রজাতন্ত্রের মন্ত্রী হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল।

“আমাদের পর‌্যবেক্ষণ হচ্ছে, তৎকালীন সরকার কর্তৃক এই অভিযুক্তকে মন্ত্রী হিসাবে নিয়োগ দেওয়া একটা বড় ধরনের ভুল (ব্লান্ডার) ছিল। পাশাপাশি এটা ৩০ লাখ শহীদ ও সম্ভ্রম হারানো দুই লাখ নারীর প্রতি ছিল সুস্পষ্ট চপেটাঘাত। এই লজ্জাজনক ঘটনা পুরো জাতির জন্য অবমাননাকর।”

ওই সময়েই ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার জন্য পাচারের পথে চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্র ধরা পড়ে, যে মামলার রায়ে ২০১৪ সালে নিজামীর ফাঁসির রায় আসে। কন্টেইনার ডিপোর ইজারা নিয়ে গেটকো দুর্নীতি মামলারও আসামি সাবেক শিল্পমন্ত্রী নিজামী।

২০১০ সালের ২৯ জুন ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার একটি মামলায় গ্রেপ্তারের পর ওই বছরের ২ অগাস্ট মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয় জামায়াতের আমির নিজামীকে।