বদরপ্রধান নিজামীকে যেতে হবে ফাঁসিকাষ্ঠে

মুক্তিযুদ্ধকালে যার পরিকল্পনা, নির্দেশনা ও নেতৃত্বে আলবদর বাহিনী বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা বাস্তবায়ন করেছিল, সেই মতিউর রহমান নিজামীকে যেতে হবে ফাঁসিকাষ্ঠে।

সুলাইমান নিলয়ও কাজী শাহরিন হকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 Oct 2014, 06:27 AM
Updated : 29 Oct 2014, 06:27 AM

মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম বুধবার জনাকীর্ণ আদালতে এই রায় দেন।

মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত ফাঁসির রজ্জুতে ঝুলিয়ে দণ্ড কার্যকর করার আদেশ দিয়ে তিনি বলেন, “আদালত সম্মত হয়েছে যে, তিনি যে মাত্রায় হত্যা, গণহত্যা ঘটিয়েছেন, তাতে সর্বোচ্চ সাজা না দিলে তা হবে ন্যায়বিচারের ব্যর্থতা।”  

জামায়াতের আজকের আমির নিজামী চার দশক আগে ছিলেন জামায়াতেরই ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের নাজিমে আলা বা সভাপতি এবং সেই সূত্রে পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতার জন্য গঠিত আলবদর বাহিনীর প্রধান।

স্বাধীনতাকামী বাঙালির ওপর দমন-পীড়ন চালাতে পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতার জন্য গঠিত রাজাকার বাহিনী ও শান্তি কমিটিতেও তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল বলে মামলার রায়ে উঠে এসেছে।

ট্রাইব্যুনাল বলেছে, বাঙালি জাতিকে সমূলে ধ্বংস করতে ‘স্বেচ্ছায় ও সচেতনভাবে’ নিজামী পবিত্র ধর্ম ইসলামের অপব্যবহার করেন।

মানবতাবিরোধী অপরাধের ১৬টি অভিযোগের মধ্যে বুদ্ধিজীবী গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, সম্পত্তি ধ্বংস, দেশত্যাগে বাধ্য করা, আটক, নির্যাতনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্র ও সংঘটনে সহযোগিতার আটটি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে।

এর মধ্যে বুদ্ধিজীবী গণহত্যাসহ চার অভিযোগের প্রত্যেকটিতে তাকে সর্বোচ্চ সাজা দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল। বাকি চারটি অভিযোগে নিজামীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং আট অভিযোগে তাকে খালাস দেওয়া হয়েছে।  

৭১ বছর বয়সী নিজামী হলেন বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী মর্যাদায় দায়িত্ব পালন করা চতুর্থ রাজনীতিবিদ, আদালত যাকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড দিল। এর আগে চট্টগ্রামের চাঞ্চল্যকর দশ ট্রাক অস্ত্র মামলায়ও তার মৃত্যুদণ্ডের আদেশ হয়।

বিগত চার দলীয় জোট সরকারের শিল্পমন্ত্রী ছিলেন মতিউর রহমান নিজামী। তার আগে ২০০১-০৩ সময়ে ছিলেন কৃষিমন্ত্রী।

বাংলাদেশে স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী এমন একজন ব্যক্তিকে প্রজাতন্ত্রের মন্ত্রী নিয়োগ করার সিদ্ধান্ত মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদ ও সম্ভ্রম হারানো দুই লাখ নারীর প্রতি ‘চপেটাঘাত’ ছিল বলেও রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে।

দণ্ড শুনে জামায়াত আমির উঠে দাঁড়াননি, কোনো কথাও বলেননি। দৃশ্যত বিমর্ষ নিজামীকে শুধু বিচারকের দিকে বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকাতে দেখা যায়।

রায় জানার সঙ্গে সঙ্গে ট্রাইব্যুনালের বাইরে অপেক্ষমাণ মুক্তিযোদ্ধা, রাজধানীর শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আহ্বানে উপস্থিত জনতা এবং আসামির জেলা পাবনাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে এসে উল্লাস প্রকাশ করে।

অন্যদিকে রায়ের প্রতিবাদে নিজামীর দল জামায়াতে ইসলামী ঘোষণা করে তিন দিনের হরতাল। চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে জামায়াতকর্মীরা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষেও জড়ায়।

এ রায়কে ‘ন্যায়ভ্রষ্ট’ আখ্যায়িত করে নিজামীর আইনজীবী তাজুল ইসলাম আপিল করার সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন। অন্যদিকে প্রসিকিউটর মোহাম্মদ আলী বলেন, এই রায়ে ‘ন্যায়বিচার’ প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।

সরকার, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, ১৪ দল, বিভিন্ন বামদল, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিল, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম এই রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে।

রায়ের পর নিজামীকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। সেখান থেকে রাতে তাকে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে স্থানান্তর করা হয়, যেখানে দশ ট্রাক অস্ত্র মামলার রায়ের পর থেকে তিনি ছিলেন।

রায়ের সময় ট্রাইব্যুনাল এলাকার নিরাপত্তা

ট্রাইব্যুনাল ভবনের বাইরে পুলিশি নিরাপত্তা

 

৮ অভিযোগ প্রমাণিত, ৪ অপরাধে ফাঁসি

সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত আট অভিযোগের মধ্যে ২, ৪, ৬ ও ১৬ নম্বর ঘটনায় নিজামীর ফাঁসির রায় হয়েছে।

এসব ঘটনার মধ্যে সাঁথিয়ার বাউশগাড়ি, ডেমরা ও রূপসী গ্রামের প্রায় সাড়ে ৪০০ মানুষকে হত্যা, ৩০-৪০ জন নারীকে ধর্ষণ; করমজা গ্রামে নয়জনকে হত্যা, একজনকে ধর্ষণ, বাড়িঘরে লুটপাট-অগ্নিসংযোগ; ধুলাউড়ি গ্রামে নারী, পুরুষ ও শিশুসহ ৫২ জনকে হত্যা এবং মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির  বিজয়ের ঊষালগ্নে অসংখ্য বুদ্ধিজীবীকে পরিকল্পিতভাবে হত্যার অভিযোগ রয়েছে।

রায়ে বলা হয়, শত শত নিরস্ত্র মানুষ, অসংখ্য বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবী হত্যার সঙ্গে সম্পর্কিত এই চার অপরাধ ছিল একাত্তরের বড় ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘণের ঘটনা। বুদ্ধিজীবী হত্যা ও নিরস্ত্র মানুষকে গণহত্যা ছিলো ‘ভয়ানক’।

“এটা মানব সভ্যতার মর্যাদাহানিকর অপরাধ হিসাবে মূল্যায়িত হওয়ার দাবি রাখে।”

আর অপরাধে সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হওয়ায় ১, ৩, ৭ ও ৮ নম্বর অভিযোগে জামায়াত আমিরকে দেওয়া হয়েছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।

এসব ঘটনার মধ্যে পাবনা জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক মাওলানা কছিমুদ্দিনকে অপহরণ করে হত্যা; মোহাম্মদপুরের ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর ক্যাম্প খুলে মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্র ও সহযোগিতা;  পাবনার বৃশালিখা গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল লতিফ সেলিমের বাবা সোহরাব আলীকে স্ত্রী-সন্তানদের সামনে হত্যা; ঢাকার নাখালপাড়ার পুরোনো এমপি হোস্টেলে আটক মুক্তিযোদ্ধা জহির উদ্দিন বিচ্ছু জালাল, বদি, রুমি (শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ছেলে), জুয়েল ও আজাদকে হত্যার পরামর্শ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। 

বাকি আট অভিযোগ প্রসিকিউশন প্রমাণ করতে না পারায় এসব অভিযোগ থেকে নিজামীকে খালাস দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল।

রায়ে বলা হয়, একাত্তরে জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি ও আল-বদর বাহিনীর প্রধান নিজামী নিজে বিভিন্ন অপরাধের ঘটনায় অংশগ্রহণ করেন। বুদ্ধিজীবীদের হত্যায় নিজামীর ভূমিকা ‘ডি-জুর ও ডি-ফ্যাক্টো’ (প্রচ্ছন্ন ও সরাসরি)।

“অভিযুক্ত তার কৃতকর্মের ফল সম্পর্কে সচেতন ছিলেন এবং বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীদের হত্যায় তিনি আলবদর সদস্যদের উৎসাহ, সত্যায়ন, অনুমোদন এবং নৈতিক সমর্থন দিয়েছেন।”

আদালত মনে করে, একাত্তরে বুদ্ধিজীবী হত্যার ঘটনা কেবল অপরাধের ভয়াবহতাকেই বৃদ্ধি করেনি, বরং বাঙালি জাতিকে এক অব্যক্ত ‘ট্রমার’ মুখোমুখি করে। শাস্তির ক্ষেত্রে এ বিষয়টিকেও বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।

“দশকের পর দশক ধরে শহীদ বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী ও নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের স্বজন ও জাতির অব্যক্ত ব্যথার ক্ষেত্রে আইনের ভাষা নিষ্ক্রিয় থাকতে পারে না। ন্যায় বিচার হচ্ছে সেটাই, যা অপরাধীকে তার কৃতকর্মের ফল শোধ করে দেয়।”

২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর। বিএনপির পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিলে জোটসঙ্গী জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী।

২০০৭ সালের ১ জানুয়ারি অসুস্থ নিজামীকে দেখতে হাসপাতালে খালেদা জিয়া

 

‘চপেটাঘাত’ ও ধর্মের অপব্যবহার

একাত্তরে ন্যক্কারজনক ভূমিকার পরও বিগত জোট সরকারের আমলে মতিউর রহমান নিজামীকে মন্ত্রিত্ব উপহার দেওয়াকে লাখো শহীদের প্রতি চপেটাঘাত বলে মন্তব্য করেছে আদালত।

রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, “এটা বিশ্বাস করা খুবই কঠিন যে, সক্রিয়ভাবে যিনি বাংলাদেশে স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিলেন, তাকে এই প্রজাতন্ত্রের মন্ত্রী হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল।

“আমাদের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, তৎকালীন সরকার কর্তৃক এই অভিযুক্তকে মন্ত্রী হিসাবে নিয়োগ দেওয়া একটা বড় ধরনের ভুল (ব্লান্ডার) ছিল। পাশাপাশি এটা ৩০ লাখ শহীদ ও সম্ভ্রম হারানো দুই লাখ নারীর প্রতি ছিল সুস্পষ্ট চপেটাঘাত। এই লজ্জাজনক ঘটনা পুরো জাতির জন্য অবমাননাকর।”

স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম সমরনায়ক জিয়াউর রহমানের স্ত্রী খালেদা জিয়া ২০০১ সালে সরকার গঠনের সময় মন্ত্রিসভায় নিয়েছিলেন নিজামীকে। যুদ্ধাপরাধে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মো. মুজাহিদও সে সময় মন্ত্রিত্ব পান।

আদালতের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, মতিউর রহমান নিজামী একজন প্রখ্যাত ইসলামী পণ্ডিত (আসামিপক্ষের দাবি অনুযায়ী) হওয়ার পরও কোরানের আদেশ ও মহানবীর শিক্ষার পরিপন্থী হয়ে আলবদর বাহিনী গঠন করেন, যার মূল উদ্দেশ্য ছিলো বাঙালি বুদ্ধিজীবী ও মুক্তিকামী মানুষদের হত্যা ও নিধন এবং পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বর্বর কর্মকাণ্ডকে সহযোগিতা ও অনুমোদন আদায়।

“আমরা ধরে নিতে বাধ্য হচ্ছি যে মতিউর রহমান নিজামী ইসলামিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও সচেতনভাবে এবং স্বেচ্ছায় ‘আল্লাহ’ ও পবিত্র ধর্ম ‘ইসলাম’ এর নামের অপব্যবহার করে ‘বাঙালি জাতি’কে সমূলে ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন।”

রায়ের আগে প্রিজন ভ্যান থেকে নামছেন মতিউর রহমান নিজামী

ফাঁসির রায় মাথায় নিয়ে আদালত থেকে কারাগারের পথে জামায়াত আমির।

বিহ্বল দৃষ্টি

রায়ের জন্য নিজামীকে মঙ্গলবার রাতেই কাশিমপুর কারাগার থেকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। বুধবার সকাল ৯টা ১৯ মিনিটে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে একটি প্রিজন ভ্যানে করে তাকে নিয়ে আসা হয় ট্রাইব্যুনালে।

এরপর দেড় ঘণ্টারও বেশি সময় নিজামীকে রাখা হয় ট্রাইব্যুনালের হাজতখানায়। সাদা পাঞ্জাবির ওপর কফি রংয়ের কোটি পরিহিত জামায়াত আমিরের মাথায় এ সময় ছিল একটি জিন্নাহ টুপি।

বেলা ১১টায় আদালত কক্ষে নেওয়ার পর নিজামীকে বসতে দেওয়া হয় আসামির কাঠগড়ায় রাখা চেয়ারে। কয়েক মিনিটের মধ্যে এজলাসে আসেন ট্রাইব্যুনাল-১ এর তিন বিচারক এম ইনায়েতুর রহিম, জাহাঙ্গীর হোসেন ও মো. আনোয়ারুল হক।

২০৪ পৃষ্ঠার রায়ের সংক্ষিপ্তসারের ভূমিকা ও অভিযোগ পড়ে শোনান বিচারপতি আনোয়ারুল হক। এরপর বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন পড়েন রায়ের পর্যবেক্ষণ।

সোয়া এক ঘণ্টা রায় পাঠের প্রায় পুরোটা সময় চেয়ারের ডান হাতলে ভর দিয়ে পেছন দিকে শরীর এলিয়ে চোখ বন্ধ করে থাকতে দেখা যায় নিজামীকে। মাঝে মধ্যে চোখ মেলে তাকালেও খুব একটা নড়াচড়া দেখা যায়নি তার মধ্যে।   

ফাঁসির আদেশ হওয়ার পর চোখ মেলে বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকাতে দেখা যায় জামায়াতের এই শীর্ষ নেতাকে। এ সময় চেয়ার থেকে মাথা তুললেও তার জোরালো কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি।

পরে তার আইনজীবী তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, “নিজামী সাহেব বলেছেন, ‘আমার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ মিথ্যা’। রায়ের প্রতিক্রিয়ায় কোনও উসকানিতে পা না দিতে তিনি কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি সবাইকে শান্ত থাকতে বলেছেন।”

রায়ের পর সাংবাদিকদের সামনে প্রসিকিউটর হায়দার আলী ও মোহাম্মদ আলী

রায়ের পর প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন নিজামীর আইনজীবী তাজুল ইসলাম

 

প্রতিক্রিয়া

রায়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় নিজামীর আইনজীবী তাজুল ইসলাম বলেন, “এ জাজমেন্ট ন্যায়ভ্রষ্ট জাজমেন্ট। আপিলে অবশ্যই এ জাজমেন্ট টিকবে না। আমরা অত্যন্ত সংক্ষুব্ধ। এ রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করব।”

অন্যদিকে প্রসিকিউটর মো. আলী বলেন, “এই রায়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।”

এ মামলার সাক্ষী মুক্তিযুদ্ধের গেরিলা যোদ্ধা বিচ্ছু জালাল বলেন, “মৃত্যুদণ্ডটা নিজামীর প্রাপ্য ছিল। একাত্তরে আমরা ঢাকার গেরিলারা এবং সাধারণ মানুষ এই নিজামী-মুজাহিদদের আতঙ্কে ছিলাম।

“এ আতঙ্ক এবং তার অপরাধের হাত থেকে মানুষকে বাঁচাতে তাকে আমরা ওই সময়ে কয়েক বার হত্যার চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমরা পারিনি। আজ আদালত রায়ের মাধ্যমে তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করল।"

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন আলবদর বাহিনীর প্রধান মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদণ্ডের রায়ে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ।

রায়ে সরকার সন্তুষ্ট জানিয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, এ রায় দ্রুত কার্যকর করতে সরকার পদক্ষেপ নেবে।

তবে জামায়াতের জোটসঙ্গী বিএনপি এবারো রায় নিয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি।

যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ সাজার দাবিতে আন্দোলনরত গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীরা এ রায়ের পর শাহবাগে আনন্দ মিছিল বের করে। মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান  এইচ সরকার বলেন, তারা প্রত্যাশিত রায় পেয়েছেন। এখন দ্রুততম সময়ের মধ্যে রায় কার্যকর হবে বলে আশা করছেন।

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ রুমির বন্ধু সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাবেক সভাপতি নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু বাস্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলেন, “রুমি, বদি, জুয়েলকে ধরে যে ক্যাম্পে নেওয়া হয়েছিল সেখানে নিজামী প্রায়ই যেত।... তাদের হত্যার পরে তাদের পরিবারও কাদঁতে কাঁদতে মারা যায়। আমরা বন্ধুরাও ঠিক থাকতে পারিনি ওই সময়। বাংলাদেশের মানুষও কেঁদেছে।”

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক বলেন, “আদালত রায়ে বলেছে, ধর্মকে ব্যবহার করে একাত্তরে বুদ্ধিজীবী হত্যা, হত্যা, ধর্ষণসহ মানবতাবিরোধী অপরাধ সংগঠিত করেছে নিজামী। চারটি অভিযোগে তার মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। এটি একটি ব্যতিক্রমী রায়।”

রায়ের পর গণজাগরণ মঞ্চের আনন্দ মিছিল

ট্রাইব্যুনালের বাইরে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান

 

স্বাধীনতাবিরোধী থেকে জনপ্রতিনিধি

শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের উত্তরসূরি হিসাবে ২০০০ সালে জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে আসা মতিউর রহমান নিজামীর জন্ম ১৯৪৩ সালের ৩১ মার্চ, পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার মনমথপুর গ্রামে।

স্থানীয় বোয়ালমারি মাদ্রাসায় শিক্ষাজীবন শুরু করা নিজামী কামিল পাস করেন ১৯৬৩ সালে ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে।  মাদ্রাসার ছাত্র থাকা অবস্থায় নিজামী ১৯৬১ সালে জামায়াতে ইসলামীর তখনকার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের সঙ্গে যুক্ত হন।

১৯৬৬ থেকে তিন বছর পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতির দায়িত্ব পালনের পর একাত্তরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নিখিল পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি ছিলেন নিজামী। বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের স্বাধীনতার লড়াই তখন চূড়ান্ত পর্যায়ে।

১৯৭১ সালের মার্চে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর এপ্রিলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করতে মূলত ছাত্রসংঘের কর্মীদের নিয়ে গড়ে তোলা হয় আলবদর বাহিনী। ছাত্রসংঘের নেতা হিসাবে আলবদরের নেতৃত্বও নিজামীর কাঁধে বর্তায়। 

আলবদর গঠিত হওয়ার পর ২৩ শে এপ্রিল দৈনিক পাকিস্তানে ছাত্রসংঘের সভাপতি নিজামীর একটি  বিবৃতি প্রকাশিত হয়, যাতে বলা হয়, “আলবদর একটি নাম, একটি বিস্ময়। আলবদর একটি প্রতিজ্ঞা। যেখানে তথাকথিত মুক্তিবাহিনী সেখানেই আলবদর। যেখানে দুস্কৃতকারী সেখানেই আলবদর। ভারতীয় চরদের কাছে আলবদর সাক্ষাৎ আজরাইল।”

স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয়ের পর বাংলাদেশ সরকার জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি নিষিদ্ধ করে।

বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পর জিয়াউর রহমানের আমলে দেশে ফেরার সুযোগ পান জামায়াতের মুক্তিযুদ্ধকালীন আমির গোলাম আযম। স্বাধীন বাংলায় প্রকাশ্যে রাজনীতিতে ফেরে স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী দলটি।

ওই সময় ১৯৭৮ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত জামায়াতের ঢাকা মহানগর শাখার আমির ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য ছিলেন মতিউর রহমান নিজামী। এরপর ১৯৮৩ সালে পদোন্নতি পেয়ে দলের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হন।

১৯৮৮ সাল পর্যন্ত ওই পদে থেকে দলের সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব পান নিজামী। গোলাম আযম আমিরের পদ থেকে অবসরে গেলে ২০০০ সাল থেকে নিজামীর নেতৃত্বেই পরিচালিত হয় জামায়াতে ইসলামী।

পাবনা-১ আসন থেকে তিনবার সাংসদ নির্বাচিত হওয়া নিজামীকে ২০০১ সালে মন্ত্রিত্ব দেন বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়া। প্রথমে দুই বছর কৃষি মন্ত্রীর দায়িত্বে থেকে সরকারের পরের তিন বছর ছিলেন শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্বে।

ওই সময়েই ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার জন্য পাচারের পথে চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্র ধরা পড়ে, যে মামলার রায়ে চলতি বছর নিজামীর ফাঁসির আদেশ হয়। কন্টেইনার ডিপোর ইজারা নিয়ে গেটকো দুর্নীতি মামলারও আসামি সাবেক শিল্পমন্ত্রী নিজামী।

শিল্পমন্ত্রী থাকাকলে জামায়াতের এক সমাবেশে মতিউর রহমান নিজামী

২০০৮ সালে বড় পুকুরিয়া খনি দুর্নীতি মামলায় হাজিরা দিতে আদালতে নিজামী

 

মামলার পূর্বাপর

২০১০ সালের ২৯ জুন ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের একটি মামলায় মতিউর রহমান নিজামীকে গ্রেপ্তার করার পর একই বছরের ২ অগাস্ট তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

এরপর ২০১২ সালের ১১ ডিসেম্বর জামায়াতের আমিরের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ উপস্থাপন করে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন। অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে গত বছরের ২৮ মে জামায়াত আমিরের বিচার শুরু হয়।

তদন্ত কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক খানের জবানবন্দি উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে গত বছর ২৬ অগাস্ট এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। প্রসিকিউশনের পক্ষে সাক্ষ্য দেন মোট ২৬ জন।

আর নিজামীর পক্ষে তার ছেলে মো. নাজিবুর রহমানসহ মোট চারজন সাফাই সাক্ষ্য দেন।

বাকি তিনজন হলেন- অ্যাডভোকেট কে এ হামিদুর রহমান, মো. শামসুল আলম ও আবদুস সালাম মুকুল।

সাক্ষ্য ও জেরা শেষে গতবছর ৩ থেকে ৬ নভেম্বর প্রসিকিউশনের পক্ষে প্রথম দফা যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করা হয়। আসামিপক্ষের আইনজীবীরা উপস্থিত না হওয়ায় তাদের লিখিত যুক্তিতর্ক জমা দিতে বলে ১৩ নভেম্বর মামলা রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখে ট্রাইব্যুনাল।

এরপর ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বদল হওয়ায় চলতি বছর ১৬ থেকে ২৪ মার্চ নতুন করে এ মামলার যুক্তিতর্ক হয়। দ্বিতীয়বারের মতো  অপেক্ষায় রাখা হয় মামলার রায়।

চলতি বছর ২৪ জুন রায়ের তারিখ রাখা হলেও অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে কারা কর্তৃপক্ষ নিজামীকে হাজির না করায় রায় আবারো পিছিয়ে যায়।

বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালের ২৫ মার্চ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মধ্য দিয়ে যুদ্ধাপরাধের বহু প্রতীক্ষিত বিচার শুরুর পর এটি ছিল দশম রায়।

এর আগের নয়টি রায়ে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক রুকন আবুল কালাম আজাদ, নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামান, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং একাত্তরের দুই বদর নেতা আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মুঈনুদ্দীনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।

আর মুক্তিযুদ্ধকালীন জামায়াত আমির গোলাম আযমকে ৯০ বছরের কারাদণ্ড, দলের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং বিএনপির সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীমকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয় আদালত।

এর মধ্যে আপিলের রায়ে কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড হলে গত  ১২ ডিসেম্বর তা কার্যকর করা হয়। আর সাঈদীর আপিলে সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ডের আদেশ দেয় সর্বোচ্চ আদালত।

যুদ্ধাপরাধের দণ্ড ভোগের মধ্যেই গত ৩০ অগাস্ট ৮৩ বছর বয়সে মারা যান আলীম। ১১ মাস কারাবন্দি অবস্থায় হাসপাতালের প্রিজন সেলে ছিলেন তিনি। আর রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের শুনানি চলার মধ্যেই গত ২৩ অক্টোবর রাতে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ৯২ বছর বয়সী জামায়াতগুরু গোলাম আযম।

 

[এই প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন কামাল তালুকদার, গোলাম মুজতবা ধ্রুব, ম্ঈনুল হক চৌধুরী, সাজিদুল হক, সালাউদ্দিন ওয়াহিদ প্রীতম, আশিক হোসেন, আজিজ হাসান, নাহিদ আশরাফী ও মাহমুদ মুরাদ।]

</div>  </p><p> <div class="embed"> <iframe height="315" src="https://www.youtube.com/embed/FKcjkGbHvOk" width="640"/> </div>  </p>