পূর্ণাঙ্গ হেরিটেজ তালিকা তৈরির ব্যাপারে উচ্চ আদালতের বেঁধে দেয়া সময় দেড় বছর আগে পেরিয়ে গেলেও তা তৈরির কোনো উদ্যোগ না নেয়ার সুযোগে পুরান ঢাকায় একের পর এক প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে।
Published : 26 May 2014, 09:42 PM
২০১২ সালে পুরান ঢাকার জনসন রোডে অবস্থিত ঢাকা জেলা কাউন্সিল ভবনটি ভেঙ্গে ফেলার উদোগ নেয়া হলে হাই কোর্টে একটি রিট করে ‘আরবান স্টাডি গ্র্রুপ’-এর প্রধান নির্বাহী তৈমুর ইসলাম।
রিটের প্রেক্ষিতে একই বছরের ৮ অক্টোবর বিচারক মির্জা হোসেন হায়দার এবং বিচারক কাজী মো. এজারুল হক আকন্দের হাইকোর্ট বেঞ্চ তিন মাসের মধ্যে হেরিটেজ স্থাপনা এবং এলাকার পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশের জন্য এলজিইডি, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এবং রা্জধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে (রাজউক) নির্দেশ দেয়।
হাই কোর্টে বেঁধে দেয়া সময় প্রায় দেড় বছর আগে পার হয়ে গেলেও এখনো এ বিষয়ে তেমন কোন উদ্যোগ দেখা যায়নি।
আর এ সুযোগে ইতোমধ্যেই অনেকগুলো ভবন ভেঙ্গে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। ঝুঁকির মুখে রয়েছে আরো অন্তত শতাধিক ভবন।
এমনকি ২০০৯ সালে সরকারি গেজেটে যে ৯৩ টি ভবন ও চারটি এলাকাকে হেরিটেজ হিসাবে সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছিলো সেগুলোর স্থাপনাও বাদ যাচ্ছে না ধ্বংসের হাত থেকে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সাধারণত ১০০ বছর বা তার বেশি পুরনো স্থাপনাকে হেরিটেজের তালিকায় রাখা হয়। ওই তালিকাভুক্ত স্থাপনা ভেঙে নতুন স্থাপনা গড়তে বিশেষ অনুমতির প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশে হেরিটেজ তালিকায় থাকা এসব স্থাপনা ভাঙতে হলে রাজউকের বিশেষ অনুমোদনের প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু এ বিষয়ে কোন তদরকি নেই।
সরকারী গেজেটে ফরাশগঞ্জের ঋষি কেশ দাস লেন রোড এলাকাকে হেরিটেজ হিসেবে সংরক্ষণের কথা বলা হলেও, এখানে নিয়ম ও পুরনো স্থাপনা ভেঙে গড়ে উঠেছে নতুন স্থাপনা।
পূর্ণাঙ্গ হেরিটেজ তালিকায় আসতে পারে এমন বেশ কিছু স্থাপনা ভেঙে ফেলা হচ্ছে দীর্ঘসূত্রিতার সুযোগ নিয়ে।
পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, হাফিজুল্লাহ রোডের ‘দারোগা বাড়ি’ নামে পরিচিত শতবর্ষী ভবনটির প্রায় ৫০ শতাংশ ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। ‘হিঙ্গা বিবি’ মসজিদ কেপি ঘোষ লেনের ১৫ নম্বর বাড়িটিও ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে।
এছাড়া একই ঝুঁকিতে রয়েছে ‘শিংটোলা গুরু দুয়ারা’, যেটির বয়স প্রায় ৪শ বছর। হুমকিতে রয়েছে মোহিনী মোহন দাস লেনের ৩ নম্বর বাড়ি ‘মঙ্গলাবাস’।
নিশিকেশ দাস রোডটি সরকারী গেজেটে সংরক্ষিত উল্লেখ করা হলেও এলাকার বেশ কয়েকটি পুরনো ভবন ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে।
নিয়মনীতির তোয়ক্কা না করে ভবন নির্মান চলছে মোঘল স্থাপত্য ছোট কাটরার ভেতরেও। চার-পাঁচ মাস আগে একটি ভবন নির্মিত হয়েছে বড় কাটরার ভেতরেও।
টিকাটুলির শহীদ নজরুল ইসলাম রোডের ৩৬ এবং ৩৭ নম্বর বাড়ি দুটি ভেঙ্গে উঠছে বহুতল ভবন। হুমকিতে রয়েছে এলাকার ৩৪/১ ভবনটি।
টিপু সুলতার রোডের একশ’ বছরেরও বেশি পুরনো শঙ্খনীধি মন্দিরটি রয়েছে ভেঙ্গে ফেলার ঝুঁকিতে।
লাল মোহন শাহা রোডের ঠাকুরবাড়ির চারটি ভবন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় সংরক্ষণের ঘোষণা দিলেও এগুলোর কোনো অস্তিত্ব এখন চোখে পড়ে না।
কালিচরণ শাহা রোডের তিনশ’ বছর পুরোনো মিল ব্যারাকটিও রয়েছে ভেঙ্গে ফেলার ঝুঁকিতে।
তাঁতি বজার এলাকাটিকে সংরক্ষিত ঘোষণা করা হলেও ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে ৭৫ ও ৭৬ নম্বর ভবনটি। ঝুঁকিতে রয়েছে ৬৭ ও ৬৮ নম্বর ভবন দুটি।
এগুলোকে ভেঙ্গে নতুন ভবন নির্মানের কাজ চলছে, যদিও এলাকাটি সংরক্ষিত হিসেবে গ্যাজেটভুক্ত হযেছে।
এগুলো ছাড়াও ঝুঁকির মুখে রয়েছে আরো অন্তত কয়েকশ’ ভবন।
পুরান ঢাকার ঐতিহ্য সংরক্ষণে কাজ করা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আরবান স্টাডি গ্রুপের প্রধান নির্বাহী তৈমুর ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ”পুরান ঢাকার অসংখ্য ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা তালিকাভুক্ত নয়। সরকার ও রাজউকের উদাসিনতার সুযোগে ডেভেলপার ফার্মগুলো একের পর এক প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা ভেঙেই চলেছে।
“এমনিতেই অনেক সময় পেড়িয়ে গেছে, অনেকগুলো স্থাপনা ইতিমধ্যেই ধ্বংস হয়ে গেছে। আর কিছুদিন পরে হয়তো আর কোন স্থাপনাই থাকবে না। সবগুলো চলে যাবে ডেভেলপার কোম্পানিগুলোর হাতে।”
ট্যুর অপারেটরদের সংগঠন টোয়াব এর পরিচালক (টেনিং এন্ড রিসার্চ) এবং বেঙ্গল ট্যুরস এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুদ হোসেন বলেন, “ঢাকার বয়স প্রায় চারশ’ বছর। এর চেয়েও নবীন অনেক শহরকে হেরিটেজ হিসাবে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। তাহলে ঢাকা কেন নয়?
এ বিষয়ে রাজউকের সদস্য (পরিকল্পনা) এবং হেরিটেজ কমিটির সদস্য আব্দুল মান্নান বলেন, “প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধীনে তালিকা তৈরির কাজ চলছে। ঢাকার ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাগুলো রক্ষার জন্য একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালাও প্রণয়ন করা প্রয়োজন।
“কোন ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা ভাঙ্গার ক্ষেত্রে আমরা জানতে পারার সাথে সাথে ব্যবস্থা নিচ্ছি। কিন্তু যারা স্থানীয় বাসিন্দা তারা সব সময় এ সব বিধিনিষেধ মানতে চান না।”
তিনি বলেন, “আমি মনে করি প্রাচীন এ নিদর্শনগুলো রক্ষা করার জন্য একটি বড় ধরনের বিনিয়োগ করতে হবে যেন ভবন মালিককে একটি ক্ষতিপুরণ দেয়া যায়।
“পৃথিবীর অনেক দেশে সংরক্ষিত ঐতিহ্যবাহী এলাকা আছে। আমাদের দেশেও এটি করা সম্ভব। এতে করে আমাদের ঐতিহ্য সংরক্ষণের পাশাপাশি বিদেশি অনেক পর্যটককে আকর্ষণ করা সম্ভব।”