ফাঁসির পর সহিংসতায় নিহত ৬

যুদ্ধাপরাধের দায়ে আব্দুল কাদের মোল্লাকে ফাঁসিতে ঝোলানোর পর দেশের বিভিন্ন স্থানে জামায়াতকর্মীদের সহিংসতায় ছয় জনের মৃত্যু হয়েছে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 Dec 2013, 07:36 AM
Updated : 13 Dec 2013, 02:42 PM

বৃহস্পতিবার ফাঁসি কার্যকরের পর গভীর রাতে ও ভোরে সাতক্ষীরায় আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের দুই স্থানীয় নেতাকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে জামায়াতকর্মীদের সংঘর্ষের সময় নিহত হন এক চটপটি বিক্রেতা এবং ছাত্রলীগ-শিবির সংঘর্ষে নিহত হন এক যুবক। পিরোজপুরের জিয়ানগর উপজেলায় গুলিতে নিহত বিএনপিকর্মীর লাশ গেছে হাসপাতালে।

এছাড়া যশোরের বাঘারপাড়ায় আগুন দিতে গিয়ে ট্রাক চাপায় নিহত হয়েছেন আশরাফুল (২০) নামে এক জামায়াত কর্মী।

জেলা প্রতিনিধিদের পাঠানো সংবাদ-

সাতক্ষীরা

গভীর রাতে কলারোয়া উপজেলার জয়নগর ইউনিয়ন যুবলীগের সাবেক সভাপতি মেহেদী হাসান জজ বাবুকে (৩৮) বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা।

এর আগে রাত ১২টার দিকে উপজেলার গোপীনাথপুর গ্রামে পিটিয়ে হত্যা করে কলারোয়া পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি আজহারুল ইসলাম আজুকে (৪৮)।

কলারোয়া থানার ওসি শাহাদারা খান জানান, হামলার খবর পেলেও অবরোধকারীরা রাস্তায় গাছ ফেলে অবরোধ সৃষ্টি করায় পুলিশ ঘটনাস্থলে তাৎক্ষণিকভাবে পৌঁছাতে পারেনি।

সকালে ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ নিহত দুই আওয়ামী লীগ নেতার লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য সাতক্ষীরা সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে।

প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ নেতা আজহারুল ইসলামকে মুখোশধারী সন্ত্রাসীরা ও অপর নেতা মেহেদী হাসানকে জামায়াত-শিবির কর্মীরা হত্যা করেছে।

কলারোয়া উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা ও উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম লাল্টু জানান, মধ্যরাতে একদল দূর্বৃত্ত জয়নগর ইউনিয়নের সরসকাঠি গ্রামের বাড়ি থেকে মেহেদী হাসানকে জোর করে ধরে নিয়ে যায়।

ভোর ৫টার দিকে বাড়ির পাশে একটি মাঠে তার ক্ষত-বিক্ষত লাশ পাওয়া যায়।

ধারনা করা হচ্ছে, মধ্যরাতের কোনো এক সময় তাকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে।

আমিনুল ইসলাম আরো জানান, এর আগে রাত ১২টার দিকে উপজেলার গোপীনাথপুর গ্রামে মুখোশধারী দূর্বৃত্তরা আজহারুল ইসলাম আজুর বাড়িঘর ভেঙেচুরে ফেলে। এরপর আজহারুল ইসলামকে টেনেহিঁচড়ে বাড়ি থেকে বের করে পিটিয়ে হত্যা করে।

জামায়াত-শিবিরের ক্যাডাররা এই হত্যাকাণ্ড দুটি ঘটিয়েছে বলে তিনি দাবি করেন।

এদিকে, সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার পারুলিয়া, জগন্নাথপুর, গাজিরহাট, আশাশুনি উপজেলার বুধহাটা, প্রতাপনগর, কল্যাণপুর, সদরের আগরদাঁড়ি, শ্যামনগরের কাশিমাড়ি এবং কালিগঞ্জ উপজেলার কৃষ্ণনগরসহ কয়েকটি স্থানে দৃর্বৃত্তরা দলবদ্ধ হয়ে দোকানপাট ও বাড়িঘরে আগুন দেয়।

যশোর

শুক্রবার ভোরে বাঘারপাড়া উপজেলার বাঘারপাড়া-চাড়াভিটা সড়কের বোলতেঘাটা মোড়ে আগুন দিতে গিয়ে ট্রাকচাপায় জামায়াতকর্মী আশরাফুল (২০) নিহত হয়েছেন। পরে অবরোধকারীরা ট্রাক দুইতে অগ্নিসংযোগ এবং চারটি ট্রাক ভাংচুর করা হয়।

এদিকে, যশোর-১ আসনের সংসদ সদস্য শেখ আফিল উদ্দিনের ফিলিং স্টেশন ভাংচুর করেছে দুর্বৃত্তরা।

বাঘারপাড়া থানার ওসি গণেশ গোবিন্দ বিশ্বাস সাংবাদিকদের জানান, ভোরে জামায়াতের একদল কর্মী গাছের গুড়ি ফেলে বাঘারপাড়া-চাড়াভিটা সড়ক অবরোধ করছিল।

এ সময় দুইটি ট্রাক সেখানে আসলে অবরোধকারীরা তাদের উপর হামলা চালায় ও আগুন দেয়ার চেষ্টা চালায়।

ওসি বলেন, এ সময় চালকরা দ্রুত ট্রাক চালিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় একটি ট্রাকে চাপা পড়ে ঘটনাস্থলে আশরাফুলের মৃত্যু হয়।

এরপর পলায়নরত ট্রাক দুটি কিছুদূর গিয়ে রাস্তায় ফেলে রাখা গাছে বাধা পেয়ে যেতে না পেরে চালক দুজন নেমে পালিয়ে যান।

পরে জামায়াত-শিবিরকর্মীরা গিয়ে ট্রাক দুটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়।

ওসি জানান, নিহত আশরাফুল বাঘারপাড়ার মহিরন গ্রামের মকবুল দর্জির ছেলে। 

যশোরের সহকারী পুলিশ সুপার (সদর) রেশমা শারমিন জানান, বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে যশোর সদরে যশোর-বেনাপোল সড়কের গাজীর দরগাহ এলাকায় যশোর-১ (শার্শা) আসনের সংসদ সদস্য শেখ আফিল উদ্দিনের মালিকানাধীন দরগাহ ফিলিং স্টেশনে হামলা চালায় জামায়াত কর্মীরা।

ব্যাপক ভাংচুরের পর পেট্রোল পাম্পের পাশে থাকা দুটি ট্রাকে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। ভাংচুর করা হয় আরও চারটি ট্রাকে।

নোয়াখালী

সোনাইমুড়ি উপজেলার সোনাপুর বাজারে শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় ছাত্রলীগ ও ছাত্রশিবিরের সংঘর্ষে একজন নিহত ও অন্তত ১০ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছে।

নিহত যুবকের নাম হাফেজ মো. জোবায়ের। তার রাজনৈতিক পরিচয় জানাতে পারেনি পুলিশ।

পুলিশ সুপার আনিসুর রহমান সংঘর্ষ ও হতাতের খবর নিশ্চিত করেছেন।

প্রত্যক্ষদর্শীর বরাত দিয়ে তিনি জানান, বিকালে শিবিরকর্মীরা সোনাপুর বাজারের মিছিল বের করে। এ সময় স্থানীয় যুবলীগ ও ছাত্রলীগ কর্মীদের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষে শিবিরের দুই কর্মী আহত হন।

এরপর সন্ধ্যায় উভয় পক্ষের মধ্যে আবারও সংঘর্ষ ও গোলাগুলি হয়। এতে হাফেজ মো. জোবায়ের প্রতিপক্ষের গুলিতে নিহত হন।

এর আগে বৃহস্পতিবার রাতে বেগমগঞ্জের আপানিয়া বাজারে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে অবরোধকারীদের সংঘর্ষে খোরশেদ আলম (৩৫) নামে এক চটপটি বিক্রেতা নিহত হয়েছেন।

গুলিবিদ্ধ হন ইমাম ইদ্দিন (৪০) নামে এক রিকশাচালক, যিনি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।

আহত ইমাম উদ্দিন এবং প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বৃহস্পতিবার রাত ২টার দিকে বিক্ষুদ্ধ জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা আপানিয়া বাজার এলাকায় চাটখিল-সোনাইমুড়ি সড়কে গাছ ফেলে অবরোধ করে।

এ সময় টহলরত র্যাব, পুলিশ ও বিজিবির সঙ্গে অবরোধকারীদের সংঘর্ষে চটপটি বিক্রেতা খোরশেদ আলম ও রিকশাচালক ইমাম উদ্দিন গুলিবিদ্ধ হন।

ভোরে খোরশেদ আলমের মৃত্যু হয়। খোরশেদের বাড়ি সোনাইমুড়ি উপজেলার বজরা ইউনিয়নের রসুলপুর গ্রামে।

আহত ইমাম উদ্দিনের বাড়ি বেগমগঞ্জের মিরওয়ারিশপুর ইউনিয়নের মিয়াপুর গ্রামে।

পুলিশ সুপার আনিসুর রহমান জানান, গভীর রাতে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা গাছ ফেলে সড়ক অবরোধ করে রাখে। এ সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে অবরোধকারীদের সংর্ঘ হয়।

তিনি হাসপাতালে একটি লাশ আনার কথা শুনেছেন বলে সাংবাদিকদের জানান।

সেনবাগে আ. লীগ নেতাকে কুপিয়ে জখম

সেনবাগ উপজেলা সদরে কাদের মোল্লার গায়েবানা জানাজা শেষে কাদরা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি আবদুল হাইকে কুপিয়ে গুরুতর জখম করা হয়েছে। এ সময় তার মোটরসাইকেলটি জ্বালিয়ে দেয়া হয়।

আবদুল হাইকে প্রথমে সেনবাগ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। পরে ফেনী সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।

সেনবাগ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক সোহেল জানান, আবদুল হাইয়ের ডান হাতের কব্জির নিজের অংশ এবং ডান পায়ের গোড়ালির নিচের অংশ কেটে ফেলতে হতে পারে।

কোম্পানীগঞ্জে ভাংচুর

কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি সাজেদুর রহমান সাজিদ জানান, কোম্পানীগঞ্জে আওয়ামী লীগ অফিসসহ অর্ধশতাধিক দোকান ভাংচুর করা হয়। বসুরহাট-চাপচাশিরহাট সড়ক কেটে দেয়া হয়।

পিরোজপুর

জিয়ানগর উপজেলার ঘোষেরহাট বাজারে বৃহস্পতিবার গভীর রাতে ১৮ দলের বিক্ষোভ মিছিল চলাকালে গুলিতে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। আহত হন অন্তত ছয় জন।

নিহত শুক্কুর আলী হাওলাদারকে (২৮) ঘোষেরহাটের সিদ্দিক হাওলাদারের ছেলে এবং বিএনপিকর্মী বলে স্থানীয়রা জানান।

ভাণ্ডারিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. সাহাদাৎ জানান, নিহত শুক্কুর আলীর মাথা ও বুকে ছররা গুলি লেগেছে।

আহত হাসান (২০), নাইম (১৮), শফিকুল (২২), সিদ্দিক (৪৫), তৌহিদুল (২৪) ও লুৎফরকে (২০)  বরিশাল ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

এলাকাবাসী জানান, কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের পর রাত আড়াইটার দিকে জিয়ানগর উপজেলার ঘোষেরহাট বাজারে ১৮ দল মিছিল বের করে। এ সময় বাইরে থেকে ওই মিছিলে গুলি চালানো হয়।

জিয়ানগর থানার ওসি কামরুজ্জামান তালুকদার জানান, এ ধরনের গোলাগুলির ঘটনা তাদের কেউ জানায়নি।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের পর পিরোজপুর-নাজিরপুর সড়কে ভৈরমপুরে স্টিল ব্রিজের প্লেট তুলে, গাছ কেটে ও রাস্তা খনন করে এবং পিরোজপুর- শ্রীরামকাঠী সড়কে তেজদাসকাঠী ও বাবলায় গাছ কেটে, আগুন দিয়ে সড়কে অবরোধ করেছে জামায়াত-বিএনপি কর্মীরা।

এছাড়া তেজদাসকাঠীতে আওয়ামী লীগ অফিস ও মালামাল ভাংচুর করেছে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা। শিয়ালকাঠী-ভাণ্ডারিয়া সড়কের বেলতলা স্টিল ব্রিজের পাটাতন খুলে ফেলেছে জামায়াত-শিবির কর্মীরা।

থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করায় জেলায় বিজিবি, র্যাব ও পুলিশের টহল বাড়ানো হয়েছে।