ধসে পড়া ভবনের ধ্বংসস্তূপ থেকে বেরিয়ে আসতে কেউ হারিয়েছেন হাত, কেউবা পা; অনেকের থেতলে গেছে পুরো মুখ।
Published : 01 May 2013, 08:06 AM
এর মধ্যেও হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে অনেকের মাথায় ঘুরছে পরিবার নিয়ে টিকে থাকার চিন্তা।
সাভারের রানা প্লাজা ধসে আহত কয়েকশ’ পোশাক শ্রমিক চিকিৎসা নিচ্ছেন এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে, সারা শরীরে ক্ষত নিয়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন যাদের অনেকেই।
যন্ত্রণাকাতর এইসব মানুষের অবস্থা আর পরিবার-পরিজন নিয়ে ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তার কথা উঠে এসেছে তাদের কথায়। ধ্বংসস্তূপের মাঝে দীর্ঘ সময় টিকে থাকার ভয়াবহ কাহিনীও তারা বলেছেন ।
ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারলেও খুলনার ভবানীপুরের পাখি বেগমের দুই পা কেটে ফেলতে হয়েছে। দুই মেয়েকে আবার দেখতে পাওয়ার সান্ত্বনায় তিনি পা হারানোর কষ্ট ভোলার চেষ্টা করছেন।
এনাম মেডিকেলের আইসিইউতে পাখির বিছানার পাশে দাঁড়াতেই ফুপিয়ে কেঁদে ওঠেন তিনি। কাঁদতে কাঁদতেই বললেন, “জান বাঁচায় মেয়ে দুটোকে দেখতে পাব। কি যে ভালো লাগছে।”
কিন্তু তার এ উচ্ছ্বাস ছাপিয়ে মাথাচাড়া দেয় কাটা পায়ের যন্ত্রণা আর দুশ্চিন্তা।
“দুটো পা-ই তো কেটে ফেলেছে। ভবিষ্যতে কি আছে আল্লাহ জানে। মেয়েদের নিয়ে কীভাবে বাঁচব…”, কান্নায় কথা থেমে যায় এই পোশাক শ্রমিকের, যিনি রানা প্লাজার ষষ্ঠ তলায় মেশিন অপারেটরের কাজ করতেন।
গত ২৪ এপ্রিল ভবন ধসের পর দুই দিন তিনি আটকা পড়ে ছিলেন কংক্রিটের স্তূপের নিচে।
আট ভাই-বোনের সংসারের হালধরা ডিগ্রী দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র হাবিবুর রহমান এক হাত এক পা ভেঙে চোখে অন্ধাকার দেখছেন পুরো পরিবার নিয়ে।
কয়েক বছর আগে বড় ভাই বিয়ে করে আলাদা হওয়ার পর আট ভাই-বোনের সংসারের দায়িত্ব তার কাঁধে চাপে।
ডিগ্রী পড়ার পাশাপাশি নীলফামারীর বিএসডিসির আলুর ফার্মে মাসে পাঁচ হাজার চারশ’ টাকায় চাকরি করতেন হাবিব। ডিগ্রীর প্রথম বর্ষের পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর আরো ভালো রোজগারের আশায় গত ফেব্রুয়ারিতে চাকরি নেন রানা প্লাজার একটি কারখানায়।
ধস শুরুর পর বাঁচার আশায় পাশের ভবনে চলে যাওয়ার চেষ্টা করেন তিনি। কিন্তু এক পর্যায়ে ধ্বংসস্তূপের নিচে পড়ে যান।
“আমি তো আর কখনোই ভারী কাজ করতে পারব না। আমি তাহলে কি করব। কীভাবে চলবে আমার সংসার”, উদ্বেগ ঝরে তার কণ্ঠে।
সরকার আহতদের পুনর্বাসনের ঘোষণা দিলেও সেই আশ্বাসে ভরসা পাচ্ছেন না রংপুরের পারভীন আক্তার।
দেয়াল চাপায় হাঁটুর নিচে ভেঙে যাওয়া এই পোশাককর্মী বলেন, “সব ঠাণ্ডা হয়ে গেলে কেউ আর আমাদের কথা মনে রাখবে না।”
মানিকগঞ্জের দুলাল মিয়া, ধামরাইয়ের আনোয়ারুল ইসলামসহ এ হাসপাতালে ভর্তি অনেক শ্রমিকই ক্ষত শুকানো শুরু হতে না হতেই ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন।
ধ্বংসস্তূপের নিচে তিন দিন কাটার পর ডান হাত কেটে উদ্ধার করা হয় গাইবান্ধার রিক্তা বেগমকে।
রিক্তা জানান, তিনি কাজ করতেন রানা প্লাজার চার তলায়। দেয়াল ধসে তার একটি হাত আটকে যায়।
“মাথার এক ফুট উপরেই দেয়াল। পাশে কয়েক জনের লাশ। তিন দিন পর কয়েকজন এসে লাশগুলো বের করে নিয়ে গেল। হাত আটকা পড়ায় আমাকে রেখেই তারা চলে যাচ্ছিল।
“আমি বললাম হাতটা কেটে ফেল। ওরা হাত কাটে না। চলে যেতে চায়। পা দিয়েই জড়িয়ে ধরলাম। আবারো বললাম হাত কাট। বলে ‘ভয় লাগে’। আমি বললাম ‘বাঁচতে চাই’। পরে ওরা করাত দিয়ে হাত কেটে আমাকে বের করে।”
লাইফ সাপোর্টে থাকা মনোয়ার হোসেন কোনো চিন্তা করার অবস্থায় নেই। ধ্বংসস্তূপের নিচে পার করা দুঃসহ অভিজ্ঞতাও জানাতে পারেননি তিনি।
এনাম মেডিকেলের ভর্তি শাখার কর্মকর্তা হুমায়ুন কবীর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, রানা প্লাজার বিভিন্ন কারখানার ৬৫২ জন শ্রমিক তাদের হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এদের মধ্যে চিকিৎসা নিয়ে মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত ২৯৭ জন চলে গেছেন।
৩৫৫ জন শ্রমিক এখনো এনাম মেডিকেলে চিকিৎসা নিচ্ছেন জানিয়ে এই কর্তকর্তা বলেন, আহতদের মধ্যে পাঁচ জন মারা গেছেন।
আহত শ্রমিকদের অনেকে জানান, তারাই ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্নক্ষম ব্যক্তি।
সারা শরীরে ক্ষত নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রাজুর চাচা আকবর আলী বলেন, “খুবই বিপদে আছি। এত বিপদ আর পৃথিবীতে থাকে না।”
হাসপাতালের চতুর্থ তলায় চিকিৎসাধীন কোনো শ্রমিকই প্রধানমন্ত্রীর দেয়া ১০ হাজার করে টাকা পাননি বলে জানান। সাভার সিএমএইচে ভর্তি অনেক শ্রমিকও বলেন, প্রধানমন্ত্রীর দেয়া ওই টাকা তাদের কাছে পৌঁছায়নি।
অষ্টম দিনেও ধ্বংসস্তূপের নিচে চলছে উদ্ধার অভিযান। এখনো নিখোঁজ শ্রমিকদের খোঁজে সেখানে ভিড় জমাচ্ছেন হাজারো মানুষ।
নিখোঁজদের খোঁজে ছোট ছোট হাজারো পোস্টারে ছেয়ে গেছে সাভারের কয়েক কিলোমিটার রাস্তার দুপাশের দেয়াল।