স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে আবৃত্তি চর্চাকে শিল্পে রূপান্তর করতে অগ্রণী ভূমিকা রেখে যাওয়া কাজী আরিফ স্মরণে শনিবার রাজধানীতে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে উঠে আসে তার বর্ণাঢ্য জীবনের নানা অজানা অধ্যায়।
বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের আয়োজনে এ স্মরণসভার শিরোনাম ছিল ‘মৃত্যু পেরিয়ে তুমি মৃত্যুঞ্জয়ী’। সমন্বিত আবৃত্তিচর্চার লক্ষ্যে গড়ে উঠা এ সংগঠনটির প্রতিষ্ঠায় বড় ভূমিকা রেখে গেছেন কাজী আরিফ।
শনিবার সকালে জাতীয় জাদুঘরের কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে এ আয়োজনের অতিথি ছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর।
এসেছিলেন সাংস্কৃতিক সংগঠক অভিনেতা হাসান ইমাম, স্বাধীন বাংলার বেতারকেন্দ্রের শব্দসৈনিক ও আবৃত্তিশিল্পী আশরাফুল আলম, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক হাসান আরিফ, স্থপতি শফি আহমেদ, আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ইকবাল খোরশেদ।
সভাপতিত্ব করেন আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য বেলায়েত হোসেন। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন পরিষদের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাসকুর-এ-সাত্তার কল্লোল।
সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের চোখে কাজী আরিফ ছিলেন ‘দায়িত্বশীল, কর্তব্যপরায়ণ ও সমাজ সচেতন’ মানুষ।
তিনি বলেন, “কাজী আরিফ একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন বলে তার আবৃত্তিচর্চায় সবসময় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রকাশিত হয়েছে। তার মধ্যে অসাম্প্রদায়িক ও সমাজকল্যাণমূলক চেতনা সবসময় ছিল।
"পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দেশ যখন উল্টো পথে হাঁটতে শুরু করেছিল, তখন সাংস্কৃতিক আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন আরিফ। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় শুধু আবৃত্তিতে নয়, রাজপথের প্রতিটি আন্দোলনে কাজী আরিফ সবসময় ছিলেন।”
সৈয়দ হাসান ইমাম বলেন, “কাজী আরিফ সযত্নে ভেতরের যন্ত্রনার কথা এড়িয়ে গেছে। তার জীবনের অর্ধেক ছিল অত্যন্ত দুঃখের। কিন্তু সেই দুঃখ কেড়ে নিতে পারেনি তার মুখের হাসি। আরিফ এত কাজ করেছে, কিন্তু তার সেই কাজের প্রচার তেমন নেই। সে পেছনে থেকে কাজ করত।”
কাজী আরিফের আবৃত্তির ধরণ ভীষণ পছন্দ তার অগ্রজ আবৃত্তিশিল্পী সৈয়দ হাসান ইমামের।
“আবৃত্তিতে পরিমিতি জ্ঞান থাকা উচিত। তার স্টাইল আমার ভীষণ পছন্দ। আমি নাটুকে আবৃত্তি মোটেও পছন্দ করি না। তার মধ্যে কখনও জননন্দিত হওয়ার চেষ্টা দেখেনি।”
কাজী আরিফের ইন্দিরা রোডের বাসায় বৈকালিক আড্ডার নানা স্মৃতি মেলে ধরেন আশরাফুল আলম।
আশরাফুল আলম বলেন, “কাজী আরিফের গানের গলা ছিল অসাধারণ। কিন্তু সে গান ছেড়ে কবিতায় এল। গানে খুব সহজে তারকা হওয়া যায়। কিন্তু সে তা না করে কবিতার ঘাটে নৌকা ভেড়াল। এটা আমাকে খুব অবাক করে। আবৃত্তি সে এতটাই ভালোবাসত। তার হৃদয়ের মধ্যে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের একটি নদী প্রবাহিত হয়েছে। তার হৃদয় ছিল বাঙালি চেতনায় পরিপুষ্ট।”
"সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, আবৃত্তি সমন্বয় পরিসদ, বসন্ত উৎসব, কবিতা পরিষদ- সবখানে তার উপস্থিতি এক ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে। তাকে অস্বীকার করার কোনো উপায় ছিল না।”
আবৃত্তিশিল্পে অবদান রেখে যাওয়া কাজী আরিফের রাষ্ট্রীয় পদক না পাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক।
তিনি বলেন, “বিস্ময় লাগে, রাষ্ট্রযন্ত্র কতটা উদাসীন। তাকে অস্বীকার করে বাংলাদেশের আবৃত্তি রচনার ইতিহাস কারা রচনা করেন?”
নগরে বসন্ত উৎসবের সূচনা করেছিলেন কাজী আরিফ। তার সঙ্গে তখন সঙ্গ দিয়েছিলেন স্থপতি শফি আহমেদ।
তিনি বলেন, “পহেলা ফাল্গুনে বসন্ত উৎসব উদযাপনের পরিকল্পনা করছি আমরা, তখন আমরা আরিফকে যুক্ত করলাম। আরিফ আমাদের আর্থিকভাবে সহযোগিতা করেছিল। আজকে রাজধানীতে বসন্ত উৎসবের ব্যাপকতা তার পেছনে কাজী আরিফের বড় অবদান রয়েছে।”
অনুষ্ঠানে ডালিয়া আহমেদ পরিবেশন করেন ‘পারিবারিক চালচ্চিত্র’, গোলাম সারোয়ার আবৃত্তি করেন ‘তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছে অকীর্ণ রেখে’, রেজিনা ওয়ালী লীনা আবৃত্তি করেন জীবনানন্দ দাশের কবিতা ‘অন্ধকার’, মাহিদুল ইসলাম আবৃত্তি করেন কাজী নজরুল ইসলামের ‘যদি আর বাঁশি না বাজে’ ও মজুমদার বিপ্লব আবৃত্তি করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘পরিচয়’ কবিতাটি।
চলতি বছর ২৯ এপ্রিল নিউ ইয়র্কের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান মুক্তিযোদ্ধা-স্থপতি ও আবৃত্তিশিল্পী কাজী আরিফ। ৬৫ বছর বয়সী এই স্থপতি হৃৎযন্ত্রের নানা জটিলতা ভুগেছিলেন।