মদ কীভাবে এল, ‘জানেন না’ রেইনট্রির এমডি

ধর্ষণের ঘটনাস্থল হিসেবে আলোচনায় উঠে আসার পর শুল্ক গোয়েন্দাদের অভিযানে জব্দ হওয়া মদ কীভাবে হোটেলে এল, তা জানেন না বলে দাবি করেছেন রেইনট্রির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এইচ এম আদনান হারুন।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 May 2017, 06:24 AM
Updated : 23 May 2017, 06:45 PM

মঙ্গলবার শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরে জিজ্ঞাসাবাদের পর সাংবাদিকদের সামনে এসে হোটেলটির মালিক এমপিপুত্র আদনান বলেন, “ওই দিন শুল্ক গোয়েন্দারা যে সমস্ত মদের বোতল উদ্ধার করেছিলেন, সেটা হোটেল ম্যানেজমেন্টের জানা ছিল না।”

চার তারকা মানের হোটেলটিতে মদ বিক্রির অনুমতি ছিল না বলে স্বীকার করেন আদনান হারুন। সম্প্রতি আসা চীনা কয়েকজন অতিথি ওই মদ এনে থাকতে পারেন বলে তিনি শুল্ক গোয়েন্দাদের জানিয়েছেন।

রেইনট্রি হোটেলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে গত ৬ মে মামলার পর গত ১৪ মে শুল্ক গোয়েন্দারা অভিযান চালিয়ে অবৈধভাবে রাখা ১০ বোতল মদ পাওয়ার কথা জানায়।এছাড়া তাদের ভ্যাট ফাঁকির প্রমাণ পাওয়ার কথাও জানানো হয়।

রাজধানীর বনানীতে আবাসিক এলাকায় গড়ে ওঠা এই হোটেলটির মালিক সরকারদলীয় সংসদ সদস্য বি এইচ হারুনের সন্তানরা। তার ছোট ছেলে ধর্ষণের প্রধান আসামি আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলে সাফাত আহমেদের জন্মদিনে সেদিন কেক পাঠিয়েছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

রেইনট্রি হোটেলে অভিযানের পর মালিক আদনানকে তলব করেছিল শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তর। তা এড়াতে আদালতে গিয়ে ব্যর্থ হওয়ার পর মঙ্গলবার কাকরাইলে অধিদপ্তরে উপস্থিত হন আদনান।

বেলা সোয়া ১১টার দিকে চাচা মুজিবুল হক কামাল, ফুপা আকবর হোসেন মঞ্জু ও ফুপাত ভাই হাসিব রুমিকে সঙ্গে নিয়ে যান তিনি।

শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তরে ঢুকছেন আদনান হারুন

বেলা পৌনে ৩টার দিকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে বেরিয়ে আদনান সাংবাদিকদের বলেন, শুল্ক গোয়েন্দারা যেসব ভ্যাট ও শুল্কের কাগজ চেয়েছিল, সেগুলো জমা দেয়া হয়েছে। তারা কাগজ পেয়ে ‘সন্তোষ’ প্রকাশ করেছেন।

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি মদ রাখার বিষয়টি হোটেল কর্তৃপক্ষের অজানা থাকার কথা বলেন।

এই না জানাটা হোটেলের নিরাপত্তা ব্যবস্থার ত্রুটি নির্দেশক কি না- প্রশ্নে হোটেলের এমডি বলেন, “সিকিউরিটি সিস্টেমে কোনো ল্যাকিং নেই। হোটেলের কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী ওই মদের বোতলগুলো এনেছিল কি না, সেটা তদন্ত করে দেখা হবে।”

শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মইনুল খান সাংবাদিকদের বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে ‘অনেক তথ্য’ বের হয়ে এসেছে। তারা জিজ্ঞাসাবাদে কখনও মৌখিকভাবে এবং কখনও লিখিতভাবে উত্তর দিয়েছেন।

মদের কোনো বৈধ কাগজপত্র রেইনট্রির মালিক দেখাতে পারেননি জানিয়ে তিনি বলেন, “তারা এটাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করেছিল। মদ নয় বরং জুস ছিল বলেও প্রচার করেছিল।

রেইনট্রি হোটেল

“উদ্ধার মদের একটা স্যাম্পল মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে পাঠানোর পর পরীক্ষার প্রতিবেদনও পাওয়া গেছে। সেখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে সেটা বিদেশি তৈরি মদ।”

লিখিত বক্তব্যে রেইনট্রির মালিক মদের বিষয়ে হোটেল পরিচালনায় যুক্ত বিদেশি ব্যবস্থাপক ফ্রাংক হেনরি ফরগেইট এবং ফুড ও বেভারেজ বিভাগের দায়িত্বে থাকা ব্যবস্থাপক ইমদাদুল হকের উপর দায় দিয়েছেন।

লিখিত বক্তব্যে আরও বলা হয়, “এপ্রিলের শেষদিকে বেশ কয়েকজন চীনা নাগরিক হোটেলে এসেছিলেন। তারা হয়ত বা সেগুলো এনেছিলেন। রুম পরিষ্কার করার সময় এগুলো উদ্ধার করে ১০১ নম্বর কক্ষে রাখা হয়েছিল।”

ব্যবস্থাপক ফ্রাংক ফরগেইট ও ইমদাদুল হককে ডেকে এনে মদ নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে মইনুল খান জানান।

রেইনট্রি কর্তৃপক্ষ অস্বীকার করলেও ওই মদ বিক্রির জন্যই রাখা ছিল বলে এখনও মনে করছেন মইনুল খান।

“এখানে অতীতেও মদ পরিবেশন হয়েছে এমন তথ্যও পাওয়া গেছে। অবৈধ মদ উদ্ধারের তথ্য তারা সংশ্লিষ্ট কাউকে জানিয়েছিলেন কি না, জানতে চাইলেও তারা সদুত্তর দিতে পারেননি। এখানে একটা অস্পষ্টতা রয়েছে।”

রেইনট্রি হোটেলে অভিযানে জব্দ মদ

মদের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে মইনুল খান বলেন, “আমরা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছি এই কারণে যে যেখানে ঘটনাটি ঘটেছে বলে অভিযোগ উঠেছে, ভিকটিম বলেছে সেখানে মদের ব্যবহার হয়েছে। তাই এটি উদ্ধারকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আলামত হিসেবে দেখা হচ্ছে।”

রেইনট্রিতে ভ্যাট ফাঁকির প্রমাণ পাওয়ার দাবি করে মইনুল খান বলেন, “তারা ( গত জানুয়ারি মাসে ভ্যাট নিবন্ধন নেওয়ার পর থেকে) তাদের কাস্টমারদের থেকে ৮ লাখ ২৭ হাজার টাকার ভ্যাট সংগ্রহ করে সরকারি কোষাগারে ১০ হাজার জমা দিয়েছে। বাকি টাকা তারা মুনাফা হিসেবে দেখিয়েছে। এটা আত্মসাতের পর্যায়ে পড়ে।”

রেইনট্রি হোটেলের বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, শুল্ক আইন ও ভ্যাট আইনে ‘যথাযথ ব্যবস্থা নেব’, বলেন মইনুল খান।

আপন জুয়েলার্সের মালিকের পাশাপাশি রেইনট্রির মালিককে গত ১৭ মে শুল্ক গোয়েন্দা কার্যালয়ে হাজির হলে বলা হয়েছিল। কিন্তু রেইনট্রির এমডি আদনান সেদিন অসুস্থতার কথা বলে নিজে না গিয়ে আইনজীবীর মাধ্যমে সময়ের আবেদন পাঠিয়েছিলেন। এরপর তাকে ২৩ মে যেতে বলা হয়।

তলবের ওই নোটিস আটকাতে গত রোববার হাই কোর্টে আবেদন করেন এমপিপুত্র আদনান। তার আবেদন শুনে হাই কোর্ট সোমবার শুল্ক গোয়েন্দা দপ্তরের নোটিসের কার্যকারিতা এক মাসের জন্য স্থগিত করলেও কয়েক ঘণ্টার মধ্যে চেম্বার আদালতে ওই আদেশ আটকে যায়।

চেম্বার আদালতের বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার হাই কোর্টের ওই আদেশ ছয় সপ্তাহের জন্য স্থগিত করে দিলে আদনানের হাজির এড়ানোর পথ বন্ধ হয়ে যায়।

আদনান হারুন মঙ্গলবার শুল্ক গোয়েন্দা কার্যালয়ে আসার পর তার অসুস্থতার বিষয়ে জানতে চাইলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আগের চেয়ে বেটার।”