বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ন্যস্ত করে আনা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের আপিল শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষকে ‘রাজনৈতিক বক্তব্য’ না দিতে বলেছে আপিল বিভাগ।
Published : 21 May 2017, 05:55 PM
রোববার প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা নেতৃত্বাধীন সাত বিচারপতির বেঞ্চে রাষ্ট্রপক্ষের তৃতীয় দিনের শুনানি শুরু হওয়ার আগেই এই আহ্বান আসে আদালতের কাছ থেকে।
সংসদে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধন হাই কোর্ট বাতিল করলে তা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গন ও আইন সভায় উত্তাপ ছড়িয়েছিল। ওই রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আপিলেও উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় চলে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে অ্যাটর্নি জেনারেলের।
রোববার আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের সঙ্গে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজাও ছিলেন।
যুক্তিতর্ক শুরুর আগে আদালত অ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ করে বলে, “এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ মামলা। রাজনৈতিক বক্তব্য রাখবেন না, সাইড টক করবেন না। কোর্টের ডেকোরাম মেইনটেইন করতে হবে। ইমোশনকে কন্ট্রোল করতে হবে।”
আপিলের আবেদনের শুনানি গ্রহণের দিন অ্যামিচি কিউরি ঠিক করে দেওয়ার কথা তুলে ধরে আদালত আর কাউকে অ্যামিকাস কিউরিয়া হিসেবে নেওয়ার কিংবা কোনো ‘সাজেশন্স’ থাকলে তা দিতে দিতে মাহবুবে আলমকে আহ্বান জানান।
তখন অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, “সাজেশন্স দিব না।”
আদালত বলে, এখানে পলিটিক্যাল সাবমিশন শুনব না। সাংবিধানিক বিষয়ে শুনানি করতে হবে।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, “সাংবিধানিকভাবে যদি বঙ্গবন্ধুর কথা চলে আসে তখন কী হবে? এছাড়া সাংবিধানিক বিষয় নিয়ে কথা বলতে গেলে পলিটিক্যাল বিষয়গুলো আসবেই।”
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতেই ছিল। বঙ্গবন্ধুর সময় চতুর্থ সংশোধনী হলে তা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত হয়।
জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের ১৫ই অগাস্টের পর থেকে ১৯৭৯ সালের ৫ এপ্রিল পর্যন্ত সামরিক সরকারের যাবতীয় কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দেওয়া হয়। আর তাতে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে ন্যস্ত হয়।
পরে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হয়ে যায়।
২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে উচ্চ আদালতের বিচারক অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে আনা হয়।
এর বিরুদ্ধে কয়েকজন আইনজীবী আদালতে গেলে গত বছরের ৫ মে হাই কোর্টের দেওয়া রায়ে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করা হয়। তার বিরুদ্ধে আপিলের শুনানি এখন চলছে।
রাজনৈতিক বক্তব্য না দেওয়ার নির্দেশনার পর রোববার অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু করেন। প্রথমদিনের যুক্তি তর্ক উপস্থাপন শেষে আদালত সোমবার পর্যন্ত শুনানি মুলতবি করে।
পরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মুরাদ রেজা বলেন, “আজকে আমার মূল বক্তব্য ছিল এই রিট পিটিশনটাই মেইনটেনেবল (গ্রহণযোগ্য) না। এটি কোনো অবস্থায়ই পাবলিক ইন্টারেস্টের (জনস্বার্থের) আওতায় পড়ে না।
“এই কেসেও যদি কেউ এগ্রিভড (সংক্ষুব্ধ) মনে করেন, তাদের সঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের জাজরাও মনে করতে পারেন। কিন্তু বর্তমান মামলাটি কোনোভাবেই পাবলিক ইন্টারেস্ট হতে পারে না, এটা ছিল আমার বক্তব্য।”
তিনি বলেন, “হাই কোর্ট বিভাগ আপিল বিভাগের রায় খণ্ডন করেছেন। হাই কোর্ট বিভাগ আপিল বিভাগের সমস্ত রায় মানতে বাধ্য। হাই কোর্ট বিভাগ এটি খর্ব করেছেন।
“এছাড়াও বলেছি এ মামলাটি প্রিম্যাচিউরড। এখানে একটি আইন পাস করার কথা ছিল, সেটিও করা হয়নি। উদারহণ দিয়ে আমি বলেছি যে শিশুটির জন্মই হয়নি সেই শিশুটিকে গলাটিপে মেরে ফেলার প্রয়াস চালানো হয়েছে এ মামলা করে।” ষোড়শ সংশোধনীতে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদে সংশোধন এনে বলা হয়েছে, বিচারকের অসদাচরণ বা অসামর্থ্য সম্পর্কে তদন্ত ও প্রমাণের পদ্ধতি সংসদ আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।
সংবিধান সংশোধনের পর অপসারণের প্রক্রিয়া ঠিক করে তৈরি একটি আইনের খসড়ায় মন্ত্রিসভা নীতিগত অনুমোদন দিলেও হাই কোর্টের রায়ের পর তা ঝুলে যায়।
অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, “সংবিধানের ৯৬ ধারাটি সংবিধান প্রণেতারা প্রথম থেকেই রেখেছেন। মাঝখানে মার্শাল ল অথরিটি বেআইনিভাবে ক্ষমতা দখল করেছে। তারাই এ সংবিধানকে বিকৃত করে সুপ্রিম জুডিশিয়াল প্রভিশন ঢুকিয়েছেন।
“ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে বরং আমরা সংবিধানের মূল জায়গায় ফিরে গেছি। এতে সংবিধানের বেসিক স্ট্রাকচারের কোনো পরিবর্তন হয়নি। মূল ধারায় ফিরে যাওয়া কোনোভাবেই সাংঘর্ষিক হতে পারে না। হাই কোর্ট ডিভিশন একটি ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে রায় দিয়েছেন।”