আতিয়া মহলের স্থানে স্থানে বিস্ফোরক

আতিয়া মহলের ভেতরে থাকা জঙ্গিরা বাড়িটির স্থানে স্থানে বিস্ফোরক বসিয়ে কমান্ডোদের অভিযানকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছিল বলে জানিয়েছে সেনাবাহিনী।

সিলেট প্রতিনিধিমঞ্জুর আহমেদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 March 2017, 04:42 PM
Updated : 29 March 2017, 05:01 AM

সিলেটের দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ি এলাকার পাঁচতলা ওই বাড়িটিতে চার দিনের ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’র আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘোষণা করে মঙ্গলবার এই তথ্য জানান সামরিক গোয়েন্দা পরিদপ্তরের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফখরুল আহসান।

জালালাবাদ সেনানিবাসে এই সংবাদ সম্মেলনের কয়েক ঘণ্টা আগেই ওই বাড়িটি পুলিশকে বুঝিয়ে দেয় সেনাবাহিনী। তখনও ভেতরে ছিল দুটি লাশ। নিহত অন্য দুজনের লাশ আগের দিনই পুলিশকে দেওয়া হয়।

সোমবারই বাড়িটির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পাশাপাশি ভেতরে চার জঙ্গির মারা পড়ার তথ্য জানিয়েছিলেন ব্রিগেডিয়ার ফখরুল। নিহত এক নারী ও তিন পুরুষের কারও পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

গত বছর হলি আর্টিজানে বেকারির পর প্রথম কমোন্ডো অভিযানটি মূলত সোমবার শেষ হলেও তল্লাশি করে নিশ্চিত হওয়ার জন্য একদিন সময় নেওয়া হয় বলে সেনাবাহিনীর সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।

গত বৃহস্পতিবার গভীর রাতে জঙ্গি আস্তানা সন্দেহে ঘিরে ফেলার পরপরই গ্রেনেড ছুড়ে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দিয়েছিল জঙ্গিরা। পরে সেনা অভিযানের মধ্যেও তাদের হাতে প্রচুর বিস্ফোরক থাকার প্রমাণ মেলে।

ব্রিগেডিয়ার ফখরুল বলেন, “জঙ্গিরা ভবনের মূল ফটকে বিশাল আকৃতির বিস্ফোরক স্থাপন করে। এমনকি একটি ফ্রিজ ও মোটর সাইকেলেও বিস্ফোরক লাগিয়ে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। এছাড়া পুরো ভবনের সিঁড়িসহ বিভিন্ন জায়গায় বিস্ফোরক স্থাপন করে পুরো ভবনটিকে অতিমাত্রায় বিপজ্জনক করে ফেলে।”

কত কেজি বিস্ফোরক ভেতরে পাওয়া গেছে- সাংবাদিকদের প্রশ্নে তিনি বলেন, “তা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। তবে বিস্ফোরকের মাত্রা হয়ত আপনারা দূর থেকে টের পেয়েছেন।

“একটা বিস্ফোরণে সামনের কলাপসিবল গেইট উড়ে এসে পাশের বিল্ডিংয়ে পড়েছে। পুরো ভবনটা এখন নড়বড়ে হয়ে গেছে।”

সোমবারও তিনি বলেছিলেন, “সার্বিক যে অবস্থাটা দেখলাম, যে একটা রুমের ভেতরে একটা ডেডবটি, তার পাশেই ছড়ানো ছিটানো আইইডি (ইমপ্রোভাইসড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) লাগানো রয়েছে।

“পুরো বিল্ডিংটায় যে পরিমাণ এক্সপ্লোসিভ আছে এগুলো যদি বিস্ফোরণ হয় তাহলে এই বিল্ডিংয়ের অংশ বিশেষ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। যে অবস্থায় আছে, এটা খুব ঝুঁকিপূর্ণ এবং সতর্কতার সঙ্গে কাজ করতে হচ্ছে।”

‘অপারেশন টোয়াইলাইট’র আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘোষণার সংবাদ সম্মেলন

জঙ্গিরা সুইসাইড ভেস্ট পরে ছিল বলেও জানান ব্রিগেডিয়ার ফখরুল। কমান্ডোরা একজনকে গুলি করার পর তিনি সঙ্গে বাঁধা বিস্ফোরকে নিজেকে উড়িয়ে দিয়েছিলেন বলে জানান তিনি।

এত বিস্ফোরক বসালো কখন- প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “রাতের দেড়টার দিকে তাদের কর্ডন করা হল। তারপর তারা একটা বড় সময় পেয়েছে। এই সময়ের মধ্যে পুরো বিল্ডিংয়ে বিস্ফোরক বসিয়েছে। তবে কখন কী করেছে, তা তো আর দেখিনি।”

মঙ্গলবার বাড়িটির দোতলা, তিন তলা, চার তলায় ১০টি স্থানে বসানো বিস্ফোরক নিস্ক্রিয় করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

“সারা ভবনের বিভিন্ন জায়গায় ছিল। সঠিক সংখ্যা এই মুহূর্তে বলতে পারব না। এখনও বিস্ফোরক আছে। ডিটেইলড তল্লাশি হবে।”

দক্ষ ছিল জঙ্গিরা

পরিচয় জানা না গেলেও যে জঙ্গিরা আতিয়া মহলে ছিল, তারা বিস্ফোরক ব্যবহারে বেশ দক্ষ বলে মনে করেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফখরুল আহসান।

তিনি বলেন, “আমরা আগেই বলেছি, আমাদের ধারণা হয়েছে, জঙ্গিরা বেশ প্রশিক্ষিত। তাদের কাছে বিশাল পরিমাণে বিস্ফোরক ছিল। সেগুলো ব্যবহার করে পুরো ভবনটাকে তারা ঝুঁকিপূর্ণ করে দিয়েছে।”

“পুরো একটা ফ্রিজকে তারা বিস্ফোরক হিসাবে তৈরি করেছে। তাদের এ বিষয়ে যথেষ্ট দক্ষতা আছে বলে আমি মনে করি।”

সেনা কর্মকর্তা ফখরুল দুদিন আগেও এই জঙ্গিদের বিস্ফোরক ব্যবহারে দক্ষতার কথা বলতে গিয়ে কমান্ডোদের ছোড়া গ্রেনেড ধরে পাল্টা হামলার কথা বলেছিলেন।

অ্যাম্বুলেন্সে দুই জঙ্গির লাশ

তিনি বলেন, “এত এক্সপ্লোসিভ রেডিমেইড অবস্থায় আসে না। এটা কীভাবে তৈরি করতে হয়, সে বিষয়ে জ্ঞান থাকতে হয়। কত মাত্রার কী পরিমাণ মেটেরিয়াল যোগ করা হল, সেগুলো দিয়ে বিভিন্নভাবে একটু তৈরি করা হয়। এগুলোকে আবার বিভিন্নভাবে সুইচ যোগ করা হয়। এভাবে অনেক কিছু হয়। ডেফিনেটলি ঘরে বসেই তারা এগুলো তৈরি করেছে।”

এই জঙ্গিরা বাইরে থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছিল কি না- প্রশ্ন করা হলে ব্রিগেডিয়ার ফখরুল বলেন, “এটা বলা মুশকিল। বাইরে কোত্থেকে প্রশিক্ষণ নেবে? এরকম কোনো উচ্চতর প্রশিক্ষণের জায়গা আমাদের জানা নাই।”

এই বাড়িটির মালিক উস্তার আলীর তথ্য অনুযায়ী, নিচ তলার একটি ফ্ল্যাট কাউছার আলী ও মর্জিনা বেগম নামে এক দম্পতি তিন মাস আগে ভাড়া নিয়ে জঙ্গি আস্তানা গড়ে তুলেছিলেন।

ঘিরে ফেলার পরদিন পুলিশের আত্মসমর্পণের আহ্বানে সাড়া না দিয়ে তারা উল্টো সোয়াট বাহিনীকে পাঠাতে বলেছিল।

আতিয়া মহলে অভিযানের মধ্যে কাছেই একটি স্থানে দুটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটে, যে হামলার দায় স্বীকার করে আইএসের নামে ইন্টারনেটে বার্তা এলেও তা সরকারের পক্ষ থেকে নাকচ করা হয়।

জিম্মিদের অক্ষত উদ্ধার ছিল অগ্রাধিকারে

এই অভিযানের ক্ষেত্রে ভবনটিতে আটকেপড়াদের নিরাপদে উদ্ধারকেই অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ শুরু হয়েছিল বলে জানান ব্রিগেডিয়ার ফখরুল।

জঙ্গি আস্তানায় আটকে পড়েছিল এই শিশুটি; তাকে কোলে করে বের করে আনেন এক সেনা কমান্ডো

পাঁচ তলা বাড়িটির প্রতি তলায় ছয়টি করে মোট ৩০টি ফ্ল্যাট রয়েছে। ২৮টি ফ্ল্যাটে বাসিন্দারা তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে আটকা পড়েছিলেন।

পুলিশ তাদের দরজা-জানালা বন্ধ করে রাখতে বলেছিল। পরে সেনা কমান্ডোদের অভিযানের প্রথম দিন আটকেপড়া ৭৮ জনকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করে আনা হয়।

ব্রিগেডিয়ার ফখরুল বলেন, “অপারেশনের প্রথম পর্বটি ছিল সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। কমান্ডোরা তাদের জীবন বাজি রেখে অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে অভিনব কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে ২৫ মার্চ আনুমানিক দুপুর ১টার মধ্যে ভবন থেকে ৩০ জন পুরুষ, ২৭ জন মহিলা ও ২১ জন শিশুসহ মোট ৭৮ জনকে নিরাপদে উদ্ধার করে।”

বৈরী আবহাওয়া মধ্যে এই অভিযান চালানোর কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “পাঁচতলা থেকে দোতলা পর্যন্ত উদ্ধার কাজ অত্যন্ত সন্তর্পণে সম্পন্ন করা সম্ভব হয়। নিচতলার উদ্ধার অভিযান ছিল সবচেয়ে ঝুঁকিপুর্ণ। কমান্ডো সদস্যরা অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অভিনব পন্থা অবলম্বন করে সকল বাসিন্দাকে নিরাপদে সরিয়ে আনে।”

কেন সেনাবাহিনী?

গত বছরের জুলাইয়ে গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার পর টানা কয়েকটি এবং সম্প্রতি সীতাকুণ্ডেও র‌্যাব-পুলিশ-সোয়াট অভিযান চালালেও সিলেটের এই অভিযান চালিয়েছিল সেনাবাহিনী।

শুরুতে পুলিশ ঘিরে ফেলার পর কাউন্টার টেররিজম ইউনিট ও সোয়াট অভিযান শুরুর পর প্রস্তুতি নিয়েছিল। কিন্তু পরিস্থিতি বেগতিক দেখার পর সেনাবাহিনীকে অভিযানের দায়িত্ব দেওয়া হয় বলে সেনা কর্মকর্তারা জানান।

এর কারণ ব্যাখ্যা করে ব্রিগেডিয়ার ফখরুল বলেন, “পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা দেশব্যাপী অনেক সফল অভিযান পরিচালনা করছেন। ১৫ মার্চে সীতাকুণ্ডে অলমোস্ট সিমিলার একটা অভিযান তারা করেছেন।

“তবে এখানে এসে যেই অবস্থাটা দেখেছেন সেখানে তাদের বিবেচনা হয়েছে যে, তাদের যে এক্সপার্টাইজ আছে, তার থেকে সেনাবাহিনীর এক্সপার্টাইজ ব্যবহার করলে সফলভাবে অপারেশনটা পরিচালনা করা যাবে।”

অভিযানে সেনা সদস্যরা

“বিশেষ করে যে ৭৮ জন বাসিন্দা ওই বাসায় ছিলেন, তাদের নিরাপত্তা বিবেচনায়, তাদেরকে ওখান থেকে বের করে নিয়ে আসাটা ছিল সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। সেজন্য আমি বলছি যে অনেক কেয়ারফুললি, টেকনিক ফলো করে অভিযানটা পরিচালনা করতে হয়েছে। যাতে আলটিমেটলি সেনাবাহিনীকে ইনভলব করতে হয়েছে।”

পুলিশ তাদের পর্যবেক্ষণ ও বিচার-বিশ্লেষণ শেষে বাসিন্দাদের নিরাপত্তা, বিস্ফোরক ঝুঁকি ইত্যাদি বিবেচনা করে সেনাবাহিনীর সহায়তা কামনা করেন বলে জানান ব্রিগেডিয়ার ফখরুল।

অভিযানে সময় লাগার বিষয়ে তিনি বলেন, “৫ তলা একটা ভবন, ৩০টা ফ্ল্যাট, সেখানে ১৫০টার মতো কক্ষ। এখানে কোথায় কোন অবস্থায় কোথায় লুকিয়ে আছে, কী অবস্থায় আছে, তা বুঝতে প্রতিটা স্টেপ ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। সেজন্য আমি বলেছি, যে অপারেশনটা একটা বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।”

প্রধানমন্ত্রীর সুনির্দিষ্ট দিক-নির্দেশনার আলোকে সেনাবাহিনী এই অভিযানের পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছিল বলে জানান এই সেনা কর্মকর্তা।

পুরো অভিযানে পুলিশ, র‌্যাব, ফায়ার সার্ভিস, বিভিন্ন সেবা প্রদানকারী সংস্থা, স্থানীয় প্রশাসনসহ এলাকাবাসীর সহায়তার জন্য কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করেন ব্রিগেডিয়ার ফখরুল।

“অপারেশন টোয়াইলাইট যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনের সমন্বিত প্রচেষ্টার একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে বলে সেনাবাহিনী বিশ্বাস করে।”