শিববাড়িতে অভিযানের অপেক্ষায় নতুন সকাল

সিলেটের দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ি এলাকায় এক জঙ্গি আস্তানার সন্ধান মেলার পর টান টান উত্তেজনার মধ্যে পেরিয়ে গেছে এক দিন এক রাত।

মঞ্জুর আহমেদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 March 2017, 09:52 PM
Updated : 25 March 2017, 02:34 AM

এক ব্যবসায়ীর মালিকানাধীন পাঁচতলা ও চারতলা পাশাপাশি দুই ভবন বৃহস্পতিবার রাত ৩টা থেকে ঘিরে রেখেছে সিলেট নগর পুলিশ ও কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের সদস্যরা। শুক্রবার বিকালে ঢাকা থেকে তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে সোয়াট; রাতে পৌঁছেছে সেনাবাহিনীর একদল প্যারা-কমান্ডো।

শুক্রবার মধ্যরাতের পর কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলামও পৌঁছেছেন ঘটনাস্থলে। তাকে সঙ্গে নিয়ে বিভিন্ন বাহিনীর কর্মকর্তারা চূড়ান্ত অভিযানের ছক আঁকছেন। 

শিববাড়ি পাঠানপাড়া এলাকায় ওই দুই বাড়ির মধ্যে পাঁচতলা ভবনটিতে ৩০টি ফ্ল্যাটে সমান সংখ্যক পরিবারের বসবাস। এর মধ্যে নিচতলার একটি বাসায় জঙ্গিরা আস্তানা গেড়েছে বলে পুলিশ কর্মকর্তাদের ভাষ্য। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের মধ্যে বাকি পরিবারগুলো কার্যত জিম্মি হয়ে আছে এক দিন ধরে।

শুক্রবার সন্ধ্যার পর থেকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা বাড়লে চূড়ান্ত অভিযানের প্রস্তুতির ইংগিত মেলে। এরপর রাত পেরিয়ে নতুন সকাল এলেও সেই অপেক্ষা শেষ হয়নি। 

পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ওই আস্তানায় অন্তত একজন নারী ও একজন পুরুষ জঙ্গি রয়েছেন বলে তারা ধারণা করছেন। কাউছার আলী ও মর্জিনা বেগম নামে ওই দুইজন স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে বাসাটি ভাড়া নিয়েছিলেন কয়েক মাস আগে।

পুলিশের পক্ষ থেকে বৃহস্পতিবার দুপুরে হ্যান্ড মাইকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানানো হলেও জঙ্গিরা তাতে সাড়া দেয়নি। বরং জানালা ফাঁক করে তারা পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি সোয়াট পাঠাতে বলে। 

একজন সোয়াট সদস্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, বাসার ভেতরে জঙ্গিরা শক্তিশালী বোমা রেখেছে বলে তারা আশঙ্কা করছেন। এ কারণেই চূড়ান্ত অভিযানে যাওয়ার আগে সময় নেওয়া হচ্ছে।

দুই সপ্তাহ আগে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের এক বাড়ি ঘিরে চালানো অভিযানের মত সিলেটেও জেনারেটর বসিয়ে ঘটনাস্থল আলোকিত করে রাখা হয় সারা রাত। ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি এনে রাখাসহ অন্যান্য প্রস্তুতিও নিয়ে রাখতে দেখা যায়।

কিন্তু সীতাকুণ্ডের মত ভোরের আলো ফোটার পর চূড়ান্ত অভিযানের পুনরাবৃত্তি দেখা যায়নি সিলেটের শিববাড়িতে।

যেভাবে শুরু

পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের অতিরিক্ত উপ কমিশনার আবদুল মান্নান জানান, সিলেটে জঙ্গি আস্তানা থাকার তথ্য পাওয়ার পর তাদের সদস্যরা সিলেট পুলিশকে নিয়ে গত কয়েকদিন ধরে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় অনুসন্ধান চালাচ্ছিল। এর মধ্যেই বৃহস্পতিবার রাতে শিববাড়ির ওই ভবনের সন্ধান পান তারা।

বৃহস্পতিবার রাত ৩টার দিকে পুলিশ সদস্যরা ওই ভবন ঘিরে ফেলে প্রধান ফটকে তালা লাগিয়ে দেন। ভোরের দিকে নিচতলার এক বাসার জানালা খুলে ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি দিয়ে ছোড়া হয় গ্রেনেড।

পরে পুলিশও পাল্টা গুলি চালায় এবং পুরো এলাকা ঘিরে ফেলা হয় বলে সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্তি কমিশনার রোকনউদ্দিন জানান।

‘অবরুদ্ধ’ এক দিন

ছুটির দিনের সকালে বিস্ফোরণ ও গুলির শব্দের মধ্যে ঘুম ভাঙার পর স্থানীয় বাসিন্দারা নিজেদের আবিস্কার করেন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিপুল সংখ্যক সদস্যের ঘেরাওয়ের মধ্যে কার্যত অবরুদ্ধ অবস্থায়।

ওই বাড়িতে যাওয়ার দুটি সড়কে চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয় সকালেই। আশপাশের কয়েকটি বাড়ি থেকে বাসিন্দাদের সরিয়ে নিয়ে বিভিন্ন ভবনের ছাদে অবস্থান নিতে দেখা যায় সশস্ত্র পুলিশ সদস্যদের।

স্থানীয় সাংবাদিকদের কাছে জানা যায়, চারতলা ভবনটি থেকে ১৭টি পরিবারের সদস্যদের সকালেই সরিয়ে নিয়ে যান পুলিশ কর্মকর্তারা। পাশের একটি স্কুলে সারা দিন রেখে সন্ধ্যায় তাদের এলাকা থেকে সরিয়ে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে রাত কাটাতে বলা হয়।

ওই সময় বেশ কিছু মানুষকে এলাকা থেকে সরিয়ে নিতে দেখা যায় পুলিশ সদস্যদের। তবে তাদের বিষয়ে কোনো কথা বলেননি পুলিশ কর্মকর্তার।

পাঁচতলা ভবনটির অন্যান্য ফ্ল্যাটে যে পরিবারগুলো আটকে আছে, তাদের দরজা-জানালা বন্ধ করে ভেতর থাকার পরামর্শ দেওয়া হয় পুলিশের হ্যান্ড মাইক থেকে।

সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ওই এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়। উদ্বেগ আর আতঙ্কের মধ্যে দুর্ভোগের একটি দিন পার করতে হয় স্থানীয় বাসিন্দাদের।  

‘আরেক জঙ্গি দম্পতি’

বাড়ির মালিক উস্তার আলী জানান, তিন মাস আগে কাউছার আলী ও মর্জিনা বেগম নামে দুইজন স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে তার পাঁচ তলা বাড়ির নিচতলার চার নম্বর বাসাটি ভাড়া নেন। সে সময় কাউছার নিজেকে একটি বেসরকারি কোম্পানির অডিট অফিসার হিসেবে পরিচয় দেন।

আমদানি-রপ্তানি ব্যবসায় জড়িত উস্তার বলেন, “সব নিয়ম মেনেই তাদের বাসা ভাড়া দেওয়া হয়েছিল। দুজনের জাতীয় পরিচয়পত্রের কপিও রাখা হয়েছে। তারা নিয়মিত ভাড়াও দিয়ে আসছে।”

এর আগে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডসহ বিভিন্ন ঘটনায় স্বামী স্ত্রী মিলে ‘জঙ্গি পরিবার’ গড়ে তুলতে দেখা গেছে। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, বিয়ের মাধ্যমে আত্মীয়তা করে ছোট ছোট ইউনিট গড়ে তোলার কৌশল নিয়ে নিয়েছে জঙ্গিরা। 

‘সোয়াট পাঠাও, সময় কম’

পুরো এলাকা ঘিরে ফেলার কথা জানিয়ে দুপুরের দিকে ‘জঙ্গিদের’ আত্মসমর্পণের আহ্বান জানানো হয় পুলিশের পক্ষ থেকে।

সন্দেহভাজন ওই নারী জঙ্গির নাম উল্লেখ করে পুলিশের হ্যান্ড মাইকে বলা হয়, “মর্জিনা বেগম, আপনাদের চারদিক দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। আপনারা শান্তিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করুন।”

এক পর্যায়ে বেলা দেড়টার দিকে পুলিশের একজন এসআই সন্দেহভাজন জঙ্গিদের উদ্দেশে মাইকে বলেন, “আপনারা মুসলমান, আমরাও মুসলমান। আপনাদের কোনো বক্তব্য থাকলে মিডিয়ার ভাইয়েরা আছেন, আপনারা কথা বলুন।”

এ সময় ওই বাড়ি থেকে জানালা ফাঁক করে নারী কণ্ঠ জবাব দেন, “আপনারা শয়তানের পথে, আমরা আল্লাহর পথে।”

এর পরপরই আরেক পুরুষকণ্ঠে পুলিশের উদ্দেশে বলা হয়, “দেরি করছ কেন? আমাদের সময় কম। তাড়াতাড়ি সোয়াট পাঠাও।”

চূড়ান্ত প্রস্তুতি, আটক ১

বিকাল পৌনে ৪টার দিকে অতিরিক্ত উপ কমিশনার আশিকুর রহমানের নেতৃত্বে সোয়াট ও পুলিশের বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দল ঘটনাস্থলে পৌঁছালে শুরু হয় চূড়ান্ত অভিযানের প্রস্তুতি।

রাত পৌনে ৮টার দিকে মেজর রোকন ও মেজর রাব্বীর নেতৃত্বে প্যারা-কমান্ডো ব্যাটালিয়নের সদস্যরা ঘটনাস্থলে পৌঁছান।

সিলেটের পুলিশ কমিশনার গোলাম কিবরিয়া সাংবাদিকদের বলেন, “সোয়াট ও পুলিশকে সহযোগিতা দিতেই তারা এখানে এসেছেন।”

সারাদিন বিদ্যুৎ না থাকলেও সন্ধ্যায় আলোকিত হয় পাঠানপাড়া এলাকা।পাশাপাশি একটি জেনারেটর বসিয়ে পাঁচতলা ওই বাড়ি ও আশপাশের এলাকা আলোকিত করার ব্যাবস্থা হয়।

একটু দূরে ফায়ার সার্ভিসের কয়েকটি গাড়ির পাশাপাশি একটি ক্রেনও এনে রাখতে দেখা যায়।

এ মাসের মাঝামাঝি সময়ে সীতাকুণ্ডের জঙ্গি আস্তানায় অভিযানের আগেও একই ধরনের প্রস্তুতি দেখা গিয়েছিল। তবে ওই অভিযানে প্যারা কমান্ডোদের দেখা যায়নি।

সন্ধ্যার আগে আগে হাতকড়া পরিয়ে লুঙ্গি পড়া এক যুবককে ওই বাড়ির দিক থেকে নিয়ে আসেন পুলিশ সদস্যরা। 

তার পরিচয় জানতে চাইলে পুলিশ কমিশনার শুধু বলেন, জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তারা ওই যুবককে আটক করেছেন।

জঙ্গিদের নতুন তৎপরতা

গতবছর জুলাই মাসে গুলশান ও শোলাকিয়ায় হামলার পর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক অভিযানের মধ্যে বেশ কিছুদিন পরিস্থিতি শান্ত থাকলেও এ বছর মার্চের শুরু থেকে জঙ্গিরা নতুন করে তাদের তৎপরতার জানান দিতে শুরু করে।

৭ মার্চ কুমিল্লায় একটি বাসে তল্লাশির সময় পুলিশের দিকে বোমা ছোড়ার পর ধরা পড়ে ‘নব্য জেএমবির’ দুই জঙ্গি। তাদের মধ্যে একজনকে সঙ্গে নিয়ে ওই রাতে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে অস্ত্র ও বোমা উদ্ধার করে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট।

১৫ মার্চ সীতাকুণ্ড পৌর এলাকার আমিরাবাদের এক বাড়ি থেকে বিস্ফোরকসহ এক জঙ্গি দম্পতিকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে প্রেমতলা এলাকায় আরেক বাড়িতে অভিযানে যায় পুলিশ।

১৬ মার্চ দীর্ঘ ১৯ ঘণ্টা ঘেরাও করে রাখার পর প্রেমতলার ওই বাড়িতে শুরু হয় ‘অপারেশন অ্যাসল্ট সিক্সটিন’। আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ও গুলিতে এক নারীসহ চার জঙ্গি নিহত হন। এছাড়া ভেতরে বোমায় বিক্ষত এক শিশুর লাশ পাওয়া যায়।

১৭ মার্চ শুক্রবার দুপুরে জুমার নামাজের সময় আশকোনায় র‌্যাবের একটি ব্যারাকে ঢুকে পড়ার পর শরীরে বাঁধা বোমার বিস্ফোরণে নিহত হয় সন্দেহভাজন এক জঙ্গি।

১৮ মার্চ মোটর সাইকেল আরোহী এক ব্যক্তি ভোর সাড়ে ৪টার দিকে খিলগাঁওয়ের ‘শেখের জায়গা’ মোড়ের কাছে চেক পোস্টে ঢুকে পড়ার পর র‌্যাব সদস্যদের গুলিতে নিহত হন এক ব্যক্তি। হামলাকারীর দেহে বিস্ফোরক বাঁধা ছিল বলে র‌্যাব কর্মকর্তাদের ভাষ্য।

২০ মার্চ চট্টগ্রাম নগরীর আকবর শাহ থানা এলাকায় জঙ্গি আস্তানা সন্দেহে দুটি বাড়িতে তল্লাশি চালায় পুলিশ। তবে সেখানে সন্দেহজনক কিছু পাওয়া যায়নি।

২৪ মার্চ সিলেটের দক্ষিণ সুরমায় অভিযানের সময়ই ঢাকার বিমানবন্দর পুলিশ বক্সের সামনে বিস্ফোরণে নিহত হন এক যুবক। তার সঙ্গে থাকা একটি ট্রলি ব্যাগে পাওয়া যায় আরও কয়েকটি বিস্ফোরক।

পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও ঢাকায় চলতি মাসের ঘটনাগুলোতে গ্রেপ্তার ও নিহত জঙ্গিদের সবাই নব্য জেএমবির সদস্য বলে তাদের ধারণা।

২০০৫ সালের ১৭ অগাস্ট দেশের ৬৩টি জেলায় একযোগে বোমা হামলা চালিয়ে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দিয়েছিল নিষিদ্ধ সংগঠন জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ- জেএমবি।

ওই সংগঠনের একটি নতুন অংশই গত দুই বছরে গুলশান হামলাসহ অধিকাংশ জঙ্গি হামলা ও হত্যার ঘটনা ঘটিয়েছে বলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের ভাষ্য। 

পুরনো জেএমবির শীর্ষ নেতা শায়খ আবদুর রহমান ও তার স্ত্রী-সন্তানকে ২০০৬ সালের ২ মার্চ এই সিলেটেরই পূর্ব শাপলাবাগের সূর্যদীঘল বাড়ি নামের এক ভবন থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।

তবে এরপর দীর্ঘ সময়ে সিলেটে কোনো জঙ্গি হামলা বা হত্যাকাণ্ড অথবা কোনো জঙ্গি আস্তানার কথা শোনা যায়নি।