নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দুই যুগের পাকিস্তানি শাসনের অবসান ঘটিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিশ্বের মানচিত্রে এ দেশের আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল।
সেই বিজয়ের ৪৫ বছর পূর্তিতে শুক্রবার নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে এ মাটির মুক্তির জন্য প্রাণ দেওয়া ৩০ লাখ শহীদকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছে বাংলাদেশ।
সরকারি-বেসরকারি সব ভবনে দিনভর উড়ছে জাতীয় পতাকা, সাভার স্মৃতিসৌধসহ দেশের সব শহীদ বেদী ভরে উঠছে শ্রদ্ধার ফুলে। পথে পথে চলছে বিজয়ের শোভাযাত্রা।
পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙার এই দিনে শ্রদ্ধা নিবেদন আর বিজয় শোভাযাত্রায় শামিল হওয়া অনেকেরই সাজে ছিল পতাকার লাল-সবুজ, হাতে ছিল লাল-সবুজের পতাকা।
বিজয়ের মিছিলে প্রাণ যুগিয়েছে শিক্ষার্থীদের উচ্ছ্বল তারুণ্য, বাবার কাঁধে চড়ে এসেছিল শিশুরাও। কণ্ঠে কণ্ঠে ছিল ‘বিজয়ের গান’।
পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের স্বাধিকারের চাওয়াকে পশ্চিম পাকিস্তানিরা ১৯৭১ সালে অস্ত্রের মুখে রুদ্ধ করতে প্রয়াস চালিয়ে যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল এই ভূখণ্ডের মানুষের উপর।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সেই প্রতিরোধ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এই বাংলার মানুষ। ন্যায্য অধিকারের সশস্ত্র সেই সংগ্রামে সহায়তার হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এসেছিল প্রতিবেশী ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ।
এরপর ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স (এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে মুক্তিবাহিনী ও ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় সেনা কমান্ডের যৌথ নেতৃত্বের কাছে আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানি বাহিনী; লাল সবুজ পতাকা ওড়ে স্বাধীন ভূমিতে, নতুন দেশে।
স্বাধীনতার চার বছরের মধ্যে জাতির জনককে হত্যার পর বাংলাদেশের উল্টো পথযাত্রায় শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর দোসররা।
সেই পথ শুধরে চার দশক পর শুরু হয়েছে যুদ্ধাপরাধের বিচার; একে একে ছয়জন যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসিকে নতুন বিজয় হিসেবে দেখছেন মুক্তিযোদ্ধারা।
বিজয় দিবসের কর্মসূচি শুরু হয় সকালে রাজধানীর শেরে বাংলা নগরে জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে ৩১ বার তোপধ্বনির মধ্য দিয়ে। তারপরের কর্মসূচি আবর্তিত হয় সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে।
রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সূর্যোদয়ের পরপরই স্বাধীনতার স্মারকে ফুল দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। পরে কিছুটা সময় নীরবে দাঁড়িয়ে জাতির বীর সন্তানদের স্মরণ করেন তারা।
জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া, বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ, মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, সংসদ সদস্য, বিচারপতি, তিন বাহিনীর প্রধান, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ভারতীয় সশস্ত্রবাহিনীর সদস্য ও কূটনীতিকরা শহীদ বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান এরপর।
ভিআইপিদের শ্রদ্ধা জানানোর পর স্মৃতিসৌধ সাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। মুক্তিযোদ্ধা থেকে শুরু করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সংগঠন ও ব্যক্তির শ্রদ্ধার ফুলে ভরে ওঠে স্মৃতিসৌধ।
সরকার যে ইতোমধ্যে যুদ্ধাপরাধীদের সম্পদ বাজেয়াপ্তের প্রক্রিয়া শুরু করেছে, সে কথা বলেন পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন।
বেলা ১১টার দিকে দলের জ্যৈষ্ঠ নেতাদের নিয়ে স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। বেলা গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে মানুষের ঢল।
মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেও শ্রদ্ধা জানানো হয় স্মৃতিসৌধে।
সাভারের বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা ইদ্রিস আলী বলেন, “যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে, এটা বড় স্বস্তি। যাদের বিচার এখনও হয় নাই, তাও শেষ করতে হবে।”
ছয় বছরের শিশু মনি আক্তার ঢাকা থেকে বাবার সঙ্গে এসেছিল স্মৃতিসৌধে। শহীদ বেদীতে ফুল দিয়ে দারুণ খুশি সে।
মনির বাবা সাইফ চৌধুরী বললেন, মুক্তিযুদ্ধ আর জাতির ইতিহাসের সঙ্গে পরিচয় কারিয়ে দিতেই মেয়েকে নিয়ে স্মৃতিসৌধে আসা।
ঢাকার রামপুরার বাসিন্দা আকাশ মাহমুদ বলেন, “প্রতিবছরই শ্রদ্ধা জানাতে আসি। এবার বিজয় দিবসে আমার প্রত্যাশা, বাকি যুদ্ধাপরাধীদেরও বিচার হবে। সাম্প্রদায়িকতা আর উগ্রবাদের অবসান হবে।”
স্মৃতিসৌধের অনুষ্ঠান চলার মধ্যেই সকাল ১০টায় রাজধানীতে জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে শুরু হয় বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজ। রাষ্ট্রপতি প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে কুচকাওয়াজ পরিদর্শন ও সালাম গ্রহণ করেন। প্রধানমন্ত্রীও অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় এবং সেনাবাহিনীর নবম পদাতিক ডিভিশনের আয়োজনে সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী, বিএনসিসি, বিজিবি, পুলিশ, র্যাব, আনসার ও ভিডিপি, কোস্ট গার্ড এবং ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সদস্যরা সুসজ্জিতভাবে এই কুচকাওয়াজে অংশ নেন।
আর্মি ও নেভাল এভিয়েশন ও র্যাব ফ্লাই পাস্ট করে কুচকাওয়াজে রাষ্ট্রপতিকে সালাম জানায়। বাংলাদেশ সেনা বাহিনী, নৌ ও বিমান বানিহীতে নতুন সংযোজিত বিভিন্ন যুদ্ধাস্ত্র ও সরঞ্জাম প্রদর্শিত হয়।
পদাতিক বাহিনীর কুচকাওয়াজের পর অত্যাধুনিক রণসাজে সজ্জিত দল রাষ্ট্রপতিকে অভিবাদন জানায়। এছাড়া এছাড়া বিমানবাহিনীর কে-৮ ডব্লিইউ, এফ-৭ বিজিওয়ান ও মিগ-২৯বি যুদ্ধ বিমানের অ্যারোবেটিক ডিসপ্লে এবং জাতীয় পতাকা ও রাষ্ট্রপতির পতাকাসহ প্যারাশুট জাম্প দর্শকদের মুগ্ধ করে।
বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংঠন দিনভর নানা অনুষ্ঠানে বিজয় দিবস উদযাপন করে।
‘ঐক্য গড়ো বাংলাদেশ, সাম্প্রদায়িকতার হবে শেষ’- এই স্লোগান নিয়ে সকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে টিএসসি পর্যন্ত বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা করে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট।
শোভাযাত্রার উদ্বোধন করে নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার বলেন, “আজকের বিজয় রাজনৈতিক কিংবা ভৌগলিক বিজয় নয়, এটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের, হিংসার বিরুদ্ধে অহিংসার, দুরবস্থার বিরুদ্ধে সুস্থ ও সুন্দরের বিজয়।”
জোট সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বলেন, পাকিস্তানের বদলে বাংলাদেশ নাম আর চাঁদ-তারার পরিবর্তে লাল সবুজ পতাকার জন্য শুধু ৩০ লাখ মানুষ জীবন দেয়নি।
“আমরা চেয়েছিলাম এমন একটি দেশ, যেখানে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল সম্প্রদায়ের মানুষ শান্তি ও সম্প্রীতির সঙ্গে বসবাস করবে। যে বাংলাদেশে প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত হবে- এ জন্যই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এদেশ স্বাধীন হয়েছিল। এজন্যই সংবিধানে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদকে মূলনীতি করা হয়েছিল।”
বিজয় দিবস উপলক্ষে রাজধানীতে শোভাযাত্রা করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও। সেখানেও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিহতের আহ্বান এসেছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ বাস্তবায়ন এবং জঙ্গিবাদ নির্মূলে কাজ করার শপথ নেওয়ার আহ্বান জানান সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রাজ্জাক।
বিজয়ের আনন্দ উপযাপনে এদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রাজধানীর মানুষের ঢল নেমেছিল। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছাড়াও বিভিন্ন সংগঠনের নানা আয়োজনে দিনভর মুখর ছিল ক্যাম্পাস।
বিজয়ের গান থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের আলোকচিত্র প্রদর্শনী, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর আন্তসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষরের মুহূর্ত উদযাপন, রক্তদান কর্মসূচি আর প্রীতি ফুটবল ম্যাচ- সব ধরনে আয়েজনই ছিল বিজয়ের এই উদযাপনে।
বিজয় দিবস উদযাপন জাতীয় কমিটি আর ছায়ানটের যৌথ উদ্যোগে বিকালে শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে ছিল বিজয়ক্ষণে জাতীয় সংগীত গাওয়ার আয়োজন।
অধ্যাপক অজয় রায় এ অনুষ্ঠানে জঙ্গিবাদ-মৌলবাদের উত্থান আর তারুণ্যের বিপদগামিতা রুখে দিয়ে মানবিক দেশ গড়ার শপথ পড়ান তরুণদের।
এছাড়া গান, কবিতা, নৃত্যের সমন্বয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা চির জাগরূক রাখার অভয় বাণী ছিল আয়োজনজুড়ে। শীতের কুয়াশাসিক্ত রাতের আকাশে ছিল আতশবাজির ঝলকানি। সবশেষ আয়োজন দেশের জনপ্রিয় ব্যান্ডদলগুলোর অংশগ্রহণে ‘কনসার্ট ফর ফ্রিডম’।
চট্টগ্রামসহ দেশের অধিকাংশ জেলার স্টেডিয়ামে কুচকাওয়াজ আর ডিসপ্লেতে অংশ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বীরত্বগাথা ফুটিয়ে তুলেছে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা।
বিজয় দিবসে কারাগার ও হাসপাতালগুলোতে ছিল বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা। বেতার-টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হয় বিজয়ের অনুষ্ঠানমালা, সংবাদপত্রগুলো বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে।