মৌলবাদমুক্ত মানবিক দেশ গড়ার শপথ তারুণ্যের

জঙ্গিবাদ-মৌলবাদের উত্থানে দেশব্যাপী তারুণ্যের বিপদগামিতা রুখে দিয়ে এক মানবিক দেশ গড়ার শপথ নিল রাজধানীর তরুণরা।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 Dec 2016, 02:00 PM
Updated : 16 Dec 2016, 05:36 PM

বিজয় দিবস উদযাপন জাতীয় কমিটির আয়োজনে তাদের এই শপথবাক্য পাঠ করান শিক্ষাবিদ অজয় রায়।

বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা দিন ১৬ ডিসেম্বর; সাড়ে চার দশক আগের এ দিনটির সূর্য বাংলাদেশের জন্মযুদ্ধের বিজয় সনদ স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে অস্ত গেলেও সেদিনই সূর্যোদয় হয় এই ভূখণ্ডের বাঙালি ও পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর স্বতন্দ্র স্বাধীন সত্তার।

বাঙালি পেয়েছিল আপন জন্মভূমি, চির মাতৃভাষায় চির আপন করে নেওয়া জাতীয় সংগীত। সে সংগীতের প্রতি পঙক্তিতে রয়েছে দেশের প্রতি মমত্ব আর দায়িত্ববোধের সুর। হৃদয়ের সবটুকু আবেগ দিয়ে তরুণরা একসঙ্গে গেয়ে উঠল ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি'।

বিজয় দিবস উদযাপন জাতীয় কমিটির আয়োজনে রাজধানীর শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে ছিল বিজয়ক্ষণে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার এ আয়োজন। আগে থেকেই ঘোষণা ছিল, বিকাল ৪টা ৩১ মিনিটে সম্মিলিত কণ্ঠে গাওয়া হবে জাতীয় সঙ্গীত।

বিকাল হতেই রাজধানীবাসীর গন্তব্যস্থলে পরিণত হয় শাহবাগের সেই মোহনা, যেখানে তরুণ প্রজন্ম হাজির হয়েছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে।

সে সঙ্গে জাতীয় কমিটির আহ্বানে দেশের সীমানারেখা পেরিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তেও ছড়িয়ে পড়ে জাতীয় সংগীতের সুর। সে সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে এবং শহীদদের আত্মত্যাগ বৃথা না করার শপথবাক্যও পাঠ করে তারুণ্য। সে সঙ্গে মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাকে রুখে দেওয়ার দীপ্ত শপথ নেয় তারা।

জাতীয় কমিটির সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ছায়ানটের যৌথ আয়োজনে লাল-সবুজের মানবপতাকা তৈরি করে হাজারও কণ্ঠ এক হয়ে গেয়ে উঠে জাতীয় সংগীত।

সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত একটানা চলে বিজয় দিবস উদযাপন জাতীয় কমিটির বিজয় উৎসব। জাতীয় সংগীত, শপথবাক্য পাঠের সঙ্গে গান, কবিতা, নৃত্যের সমন্বয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা চির জাগরূক রাখারও অভয় বাণী ছিল আয়োজনজুড়ে। শীতের কুয়াশাসিক্ত রাতের আকাশে ছিল আতশবাজির ঝলকানি। সবশেষ আয়োজন দেশের জনপ্রিয় ব্যান্ডদলগুলোর অংশগ্রহণে ‘কনসার্ট ফর ফ্রিডম’।

৪টা ২৫ মিনিটে মঞ্চ থেকে জাতীয় সংগীত গাওয়ার জন্য প্রস্তুত হওয়ার বার্তা এল। অলেক দাশগুপ্তের পরিচালনায় আনন্দননের শিল্পীরা নেতৃত্ব দেয় জাতীয় সংগীত গাওয়ায়। প্রস্তুতিপর্বে তাদের কণ্ঠে ভেসে আসে ‘ধন ধান্য পুষ্পভরা’ গানটি। এর পর নিমেষেই আসন ছেড়ে দাঁড়িয়ে যান উদ্যানে উপস্থিত অগণিত মানুষ।

এরপর নতুন প্রজন্মকে শপথবাক্য পাঠ করান বিজয় দিবস উদ্যাপন জাতীয় কমিটির প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক অজয় রায়। তারুণ্য দীপ্ত শপথ নেয়, মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মাহুতি বৃথা যেতে দেবে না। জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতামুক্ত সুখী ও সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশ গড়ার। সেই সঙ্গে বিশ্ব মানবতাকে শক্তিশালী ও স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠা করারও শপথ নেন তারা।

এর আগে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন ড. অজয় রায়, উদযাপন জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাত, কমিটির সদস্য সচিব ও গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ডা. ইমরান এইচ সরকার, ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিনী, শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী এবং মানবাধিকারকর্মী খুশি কবীর।

উদ্বোধনী আনুষ্ঠানিকতা শেষে শুরু হয় ‘আমাদের সংস্কৃতি’শিরোনামে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। যাতে গান, নৃত্য ও আবৃত্তিতে উঠে আসে মুক্তিযুদ্ধের কথা। সন্ধ্যার আতশবাজির পর জনপ্রিয় ব্যান্ডদলগুলোর অংশগ্রহণে ‘কনসার্ট ফর ফ্রিডম’র মধ্য দিয়ে শেষ হয় এ আয়োজন। এতে অংশ নেয় তাহসান ও তার দল, অর্থহীন, রাফা, লালন, চিরকুট, মিনার্ভা, ওল্ড স্কুল, অরবোভাইরাস, ব্ল্যাকসহ দেশের খ্যাতনামা ব্যান্ডদলগুলো।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ছায়ানটের যৌথ আয়োজন

লাল রঙে মোড়ানো মঞ্চ, তার চারপাশে সবুজ শাড়ি আর পাঞ্জাবি পরিহিত শিল্পীরা। পাখির চোখে দৃশ্যমান হয়ে উঠে লাল-সবুজের পতাকা, যা অর্জন হয়েছিল ৪৫ বছর আগের এই দিনটি।

মানবপতাকা বিজয়ক্ষণ বিকাল ৪টা ৩১ মিনিটে ভেসে এল ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি'। এভাবেই বিজয় দিবসকে যৌথভাবে উদযাপন করল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ছায়ানট। 

শুক্রবার বিজয়ের দিনের এ আয়োজনে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের অমর সব গান পরিবেশন করেন ছায়ানট শিল্পীরা।

‘সকলে মিলে দেশ-গান গাইবার, দেশ-কথা বলবার’ শিরোনামের এ আয়োজন শুরু হয় ঠিক বিকাল ৩টা ৪০ মিনিটে। ছায়ানটের শিল্পীদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে উপস্থিত হাজারও দর্শকশ্রোতা প্রথমবারের মতো গেয়ে উঠেন জাতীয় সঙ্গীত। সে সঙ্গে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে আয়োজনের উদ্বোধন করেন ছায়ানট সভাপতি ড. সনজীদা খাতুন।এ আয়োজনের সমাপ্তিও জাতীয় সংগীতের সুরে; বিকেল ৪টা ৩১ মিনিটে।

উদ্বোধনের আনুষ্ঠানিকতা শেষে মঞ্চ থেকে গীত হয় ‘মোরা ঝঞ্ঝার মত উদ্দাম’ গানটি, যার সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করেন নৃত্যনন্দনের শিল্পীরা। ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু’ গানটির সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করেন ছায়ানটের ভরতনাট্যম বিভাগের বিদ্যার্থীরা। এর পর নাসিমা শাহিন ফ্যান্সি ও শারমিন সাথী ইসলামের যুগল কণ্ঠে গীত হয় ‘অবাক পৃথিবী অবাক করলে তুমি’। এরপর ‘এবার তোর মরা গাঙে’ গানের সঙ্গে ছিল ছায়ানটের মণিপুরী বিভাগের শিক্ষার্থীদের নৃত্য। চন্দনা মজুমদারের কণ্ঠে এর পর শোনা গেলো ‘এই না বাংলাদেশের গান’ গানটি। এরপর তিনটি গান ও নৃত্য।

‘আমরা তো উজ্জ্বল সূর্য’ গানের সঙ্গে নৃত্যম নৃত্যশীলন কেন্দ্র, ‘কলকল ছলছল’ গানের সঙ্গে জাগো আর্ট সেন্টার এবং ‘এখন আর দেরি নয়’ গানের সঙ্গে ছায়ানটের মণিপুরী নৃত্য বিভাগের শিল্পীরা নৃত্য পরিবেশন করেন। এরপর জহিরুল হক খানের সঙ্গে সবাই একসঙ্গে বলে উঠে মুক্তিযুদ্ধের অমর স্লোগান ‘জয় বাংলা। স্লোগান থামতেই ব্রতচারী নৃত্য দল ‘বাংলা মার দুর্নিবার’ গানের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করে। এরপর কবির বকুলের কথা ও সুজেয় শ্যামের সঙ্গীত পরিচালনায় শাহিন সামাদ গেয়ে শোনান এ আয়োজন উপলক্ষে তৈরি করা নতুন গান ‘এই পৃথিবীটা যদি হয়'।

ছায়ানটের ভরতনাট্যম বিভাগের শিল্পীরা ‘তিরিশ লক্ষ জীবন দিয়া’ গানের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করেন। ছায়ানটের নৃত্যশিল্পীতের নৃত্যের সঙ্গে সৈয়দ শামসুল হকের ‘ব্রহ্মপুত্রের প্রতি’ কবিতাটি আবৃত্তি করেন লিয়াকত আলী। এরপর ছায়ানটের মণিপুরী বিভাগের নৃত্য শিল্পীরা ‘লাখো লাখো শহীদের রক্তমাখা’। গান আর নৃত্য থামতেই আবারও জহিরুল হক খানের সঙ্গে কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে উঠেন উপস্থিত সকলে। এর পরেই আসে বিজয়ের ক্ষণ বিকেল ৪টা ৩১ মিনিট। সবাই মিলে একসঙ্গে হৃদয়ের সবটুকু আবেগ গেয়ে উঠেন ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’।

এবারের আয়োজনে ছায়ানটের শিক্ষক, শিল্পী ও শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি আরও অংশ নেয় ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, শান্ত মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি, লালমাটিয়া মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, আটি ভাওয়াল উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়, ইমপিরিয়াল কলেজ, ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি স্কুল ও কলেজ, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, লালমাটিয়া হাউজিং সোসাইটি লিমিটেড স্কুল অ্যান্ড কলেজ, হলিক্রস স্কুল ও কলেজ এবং অরণি, উদয়ন ও উদ্দীপন বিদ্যালয়, একাডেমিয়া, এক্সেল একাডেমি, সাউথ ব্রিজ, সানবিমস্, সানিডেল, মিরপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ এবং স্কলাসটিকা স্কুলের শিক্ষার্থীরা।