কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শনিবার মহাসমাবেশ থেকে আগামী ৭ জানুয়ারি বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদ দিবস ছাড়া আরও কিছু কর্মসূচি দেন কমিটির সদস্য সচিব আনু মুহাম্মদ।
তিনি বলেন, “রামপাল প্রকল্পসহ সুন্দরবনবিনাশী সব অপতৎপরতা বন্ধ এবং জাতীয় কমিটির ৭ দফা বাস্তবায়নের দাবিতে আগামী ২৬ ডিসেম্বর দেশব্যাপী দাবি দিবস, বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করা হবে। ৭ জানুয়ারি বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদ দিবস পালন করা হবে।”
তেল-গ্যাস কমিটির অন্য কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে ১৪ জানুয়ারি দেশবাসীর সামনে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের জন্য সুলভ, টেকসই, পরিবেশ ও জনস্বার্থ অনুকূল বিকল্প মহাপরিকল্পনা উপস্থাপন, একইসঙ্গে সারা দেশে জেলা ও বিভাগীয় শহরে সমাবেশ।
এই সময়ের মধ্যে দাবি পূরণ না হলে ২৬ জানুয়ারি ঢাকা মহানগরে আধাবলা সাধারণ ধর্মঘট পালন এবং পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে বলে জানান অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ।
ভারতের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে বাস্তবায়নাধীন রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রভাবে বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন হুমকির মুখে পড়বে দাবি করে এই নাগরিক সংগঠনটি এর আগে রামপাল অভিমুখে পদযাত্রা কর্মসূচি পালন করেছিল।
পরিবেশগত ক্ষতি ন্যূনতম মাত্রায় রাখার সব বন্দোবস্ত রেখেই এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হলেও তাতে আশ্বস্ত না হয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে তেল-গ্যাস রক্ষা কমিটি।
সমাবেশে আনু মুহাম্মদ সবার প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, “শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস ও বিজয় দিবসে সুন্দরবন রক্ষার আওয়াজ নিয়ে শহীদদের স্মরণ করুন। সারা দেশে নিজ নিজ উদ্যোগে সুন্দরবনের জন্য গান, নাটক ও তথ্যচিত্র তৈরি করুন। সভা-সমাবেশ, মানববন্ধন, সাইকেল মিছিল ও নৌকা মিছিলসহ বিভিন্নমাত্রিক প্রচার ও প্রতিবাদ কর্মসূচি গ্রহণ করুন।”
পাঁচ বছর ধরে এই আন্দোলন চালিয়ে আসার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “যুক্তি, বৈজ্ঞানিক তথ্য, বাংলাদেশের মানুষের মতামত ও দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে যদি সরকারের গুরুত্ব থাকত তাহলে অনেক আগেই সুন্দরবনবিনাশী রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পসহ বিভিন্ন তৎপরতা সরকার বন্ধ করত। ”
২০১১ সাল থেকে বিভিন্ন গবেষণা সরকারের কাছে উপস্থাপন করা হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, “বাংলাদেশ, ভারত, বিভিন্ন দেশের বিশেষজ্ঞ, এমনকি ইউনেস্কোসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সংস্থা গবেষণা করে দেখিয়েছেন এই প্রকল্পে সুন্দরবনের অপূরণীয় ক্ষতি হবে।
“কোম্পানির স্বার্থভোগীরা ছাড়া এমন একজন বিশেষজ্ঞ পাওয়া যাবে না যিনি রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কথা বলছেন। সরকার জেনেশুনে মানুষের মুখে, বাংলাদেশের মুখে বিষ ঠেলে দিচ্ছে।”
অর্থনীতির অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, “৩৫ লাখ মানুষ জীবিকার জন্য সুন্দরবনের উপর নির্ভর করে। যদি সুন্দরবন না থাকে তাহলে এই ৩৫ লাখসহ আরও কয়েকগুণ মানুষ সরাসরিভাবে উদ্বাস্তু হবে। সুন্দরবন না থাকলে ৫ কোটি মানুষ প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখে অরক্ষিত হয়ে যাবে। ”
‘কালো টাকার’ মালিক ও বিভিন্ন ব্যবসায়ী গোষ্ঠী রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পে আকৃষ্ট হয়ে সুন্দরবন ‘ঘিরে ফেলেছে’ বলে অভিযোগ করেন আনু মুহাম্মদ।
সমাবেশে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, “সুন্দরবন ধ্বংস হলে বাংলাদেশ যে বিপন্ন হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এই উন্নতি এক দলের উন্নতি, পুঁজিবাদের উন্নতি। এই উন্নতি ৯০ শতাংশ মানুষের পাঁজরের উপর পাহাড়ের মত দাঁড়িয়ে থাকবে। এই একদলের উন্নতির জন্য ৯৯ জনকে বঞ্চিত হতে হবে।
“যারা এ দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করে, যারা মনে করে এ দেশের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। যাদের সন্তান- সন্তুতি ইতোমধ্যে বিদেশে চলে গেছে, সেই শতকরা একজনরা এই কাজটি করছে। তার বিপক্ষে শতকরা নিরানব্বই জন মানুষ দাঁড়িয়েছে।”
প্রধানমন্ত্রীকে চ্যালেঞ্জ
এই প্রকল্প নিয়ে সরকারকে উন্মুক্ত বিতর্কের আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম।
তিনি বলেন, “যুক্তিতর্ক অনেক দেওয়া হয়েছে। অবিলম্বে সিদ্ধান্ত নেন, বিদ্যুৎকেন্দ্র রামপালে স্থাপন না করে স্থানান্তর করবেন। যদি আরও বিতর্ক করতে চান আমি চ্যালেঞ্জ দিচ্ছি এই শহীদ মিনারে আপনিও থাকবেন আমিও থাকব, জনগণের সামনে সরাসরি বিতর্ক হবে। জনগণ বিচার করে দেখবে কোনটা সঠিক। যদি এখানে আসতে আপত্তি থাকে আপনি ক্যামেরাতে, টেলিভিশনে বক্তৃতা করেন আমাকেও ব্যবস্থা করে দিন একইসঙ্গে যুক্তিতর্ক দিয়ে এই বিষয়ের মীমাংসা হোক ।”
সুন্দরবনের কাছে এই প্রকল্পের বিরোধিতার পক্ষে যুক্তি দিয়ে তিনি বলেন, “সরকার বলছে সুপার ক্রিটিক্যাল টেকনোলজি ব্যবহার করলে দূষণ হবে না। এ কথাই যদি সত্য হয় তবে ঢাকা থেকে এত দূরে সেই রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন না করে শেরেবাংলা নগরে কিংবা ক্যান্টনমেন্টের কাছে দূষণমুক্ত বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করেন না কেন? যদি রাজি হন বুঝব- আপনাদের ঈমানের জোর আছে।”
রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পে বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশ্যে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, “মিথ্যা যুক্তি দিয়ে লাভ নাই। আমরা দেশ রক্ষার জন্য লড়াই করেছি, সুন্দরবন রক্ষার জন্য লড়াই চালিয়ে যাব। যারা এই প্রকল্পে টাকা ঢালছেন তারা হুঁশিয়ার হয়ে যান। পরে দোষ দিতে পারবেন না, যদি আমরা বামপন্থিরা ক্ষমতায় যাই রামপাল থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্র সরিয়ে নেওয়া হবে।”
জাতীয় স্বার্থে বামপন্থিদের রাজনৈতিক ঐক্যের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “এই ইস্যুতে সরকার যদি নতি স্বীকার না করে তাহলে এই আন্দোলন রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপান্তরিত হবে। রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের আন্দোলনে রূপান্তরিত হবে।”
এই বিদ্যুৎ প্রকল্প প্রশ্নে সরকারকে গণভোট দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন কলামনিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ।
তিনি বলেন, “এই গণজমায়েত দেখেও যদি মানুষের মুখের ভাষা, বুকের ভাষা বুঝতে না পারেন তাহলে গণভোট দেন। কত শতাংশ মানুষ ওইখানে (রামপালে) বিদ্যুৎকেন্দ্র করার পক্ষে ভোট দেয়, সেটা দেখার পরে হয় আমাদের আন্দোলন চলবে নয় আন্দোলন থেকে বিরত থাকব।”
‘পরিবেশের ক্ষতি না করেই দ্বিগুণ বিদ্যুৎ’
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বিরোধী আন্দোলনের কথা তুলে ধরে পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক প্রকৌশলী বিডি রহমতুল্লাহ বলেন, “একমাত্র আমাদের প্রধানমন্ত্রী ছাড়া দ্বিতীয় ব্যক্তি পাচ্ছি না যে, ওই খানে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন হলে সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হবে না- একথা বলছেন। এটা নির্ভেজাল মিথ্যে কথা। একজন প্রধানমন্ত্রী না জেনে এ ধরনের মিথ্যা কথা বলতে পারে, তা ধারণার বাইরে ।”
তিনি বলেন, “কয়লা হচ্ছে পৃথিবীর অন্যতম বিষাক্ত জ্বালানি, যা সালফার ডাই অক্সাইড, সালফার অক্সাইড, কার্বন ডাই অক্সাইড এবং কার্বন মনোক্সাইড উৎপাদন করে। প্রতি মুহূর্তে এগুলোর উৎপাদন হয়। এমনকি ব্যবহারের আগে স্টোরে রাখলেও এগুলোর উদ্গীরণ ঘটে। আর এ দিয়ে আমরা সুন্দরবনের মত স্পর্শকাতর জায়গায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য উদ্যোগ নিয়েছি। এই চারটা জিনিস প্রাণ-প্রকৃতি নষ্ট করে, পানি নষ্ট করে, গাছ-গাছালি নষ্ট করে, মাটির উর্বরা শক্তি নষ্ট করে।”
“বাংলাদেশ যে বাতাস ধারণ করে তার বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা (ইনস্যুলেশন পাওয়ার) বিশ্বে সর্বোচ্চ। সাড়ে চার কিলোওয়াট পার স্কয়ার মিটারে গড়ে সাড়ে ছয় কিলোওয়াট আওয়ার। আমরা কেন এটিতে যাচ্ছি না?
“বর্জ্য দিয়ে আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারি। শুধু বর্জ্য দিয়ে আমরা কমপক্ষে ১০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারি। সূর্য থেকেও আমরা ১০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারি।”
পরিবেশের ক্ষতি না করে রামপালেই এর দ্বিগুণ বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব বলে মনে করেন বিডি রহমাতুল্লাহ।
“আমরা জাতীয় কমিটি থেকে চ্যালেঞ্জ দিচ্ছি, আমরা শুধু আন্দোলন করে ঠেকাবই না, প্রয়োজনে রামপালে ২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের দ্বিগুণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করে দেখাব। কোনো পয়সা না নিয়ে গায়ে-গতরে খেটে ছয়মাসের মধ্যে তৈরি করে দেব। আপনি মালামাল এনে দেন। ক্ষমতা রক্ষার জন্য এ পথে যাবেন না,” প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে বলেন তিনি।
এই প্রকৌশলীর সঙ্গে সুর মিলিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক এমএম আকাশ বলেন, “বিকল্প ব্যবস্থায় আমরা রামপালের চেয়ে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারি। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করে সুন্দরবনের অপূরণীয় ক্ষতি করা হবে নিছক বোকামি, অবিমৃশ্যকারিতা এবং একটি প্রতিক্রিয়াশীল সিদ্ধান্ত।”
তিনি বলেন, “সরকার বলছে- তাদের কাছে আলট্রা সুপার টেকনোলজি আছে, যা দিয়ে সুন্দরবনের বিনাশ ঠেকানো সম্ভব। যে কোনো নিরপেক্ষ বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, এই তথ্য মিথ্যা। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা তা দেখিয়েছেন, সর্বশেষ জাতিসংঘের গবেষকরাও তা দেখিয়েছেন।
“সরকার যে আল্ট্রাসুপার টেকনোলজির কথা বলছে, তার যন্ত্রপাতি টেন্ডারের মাধ্যমে আনার কথা। আমরা টেন্ডারের স্পেসিফিকেশন পরীক্ষা করে দেখেছি। সে ধরনের কোনো যন্ত্রপাতি আসছে না। রামপালের ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করা হয়েছে, আপনি কি আল্ট্রাসুপার টেকনোলজি ব্যবহার করছেন? তিনি বলেছেন, আল্ট্রাসুপার টেকনোলজি বলে কোনো কিছু নেই। তাহলে আমরা কার কথা বিশ্বাস করব? সরকার কি ভাওতাবাজি করছে জনগণের সঙ্গে? প্রধানমন্ত্রী এক কথা বলবে আর রামপালের ম্যানেজার আরেক কথা বলবে আমরা কাকে মিথ্যাবাদী বলব?”
তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক প্রকৌশলী শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর সভাপতিত্বে সমাবেশে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ, পরিবেশবিদ ছাড়াও বিভিন্ন বাম রাজনৈতিক দলের নেতারা বক্তব্য রাখেন।
বেলা আড়াইটায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় সমাবেশ। সমাবেশকে ঘিরে প্রশাসনের নিরাপত্তা ছিল চোখে পড়ার মত। বেলা ১১টা থেকেই বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন ও বাম রাজনৈতিক দলগুলো খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে জড়ো হতে থাকে শহীদ মিনার প্রাঙ্গনে। চলতে থাকে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক দলের প্রতিবাদী পরিবেশনা। সমাবেশ শুরুর আগেই রামপালবিরোধী ব্যানার, ফেস্টুন, প্ল্যাকার্ডে ছেয়ে যায় গোটা সমাবেশস্থল।
সমাবেশ শেষে মিছিল বের করে জাতীয় কমিটি। সমাবেশস্থল থেকে শুরু হয়ে মিছিলটি শাহবাগ, মৎস্য ভবন হয়ে হাই কোর্ট মোড়ে কদম ফোয়ারার কাছে শহীদ মতিউল-কাদের চত্বরে এসে শেষ হয়।