রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের আবাসিক ভবন থেকে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আকতার জাহান জলির লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ।
Published : 09 Sep 2016, 11:01 PM
ওই ঘরের টেবিলে একটি চিরকুট পাওয়া গেছে, যেখানে ‘আত্মহত্যার’ কথা জানিয়ে ‘কেউ দায়ী নয়’ বলা হলেও নিজের সন্তানের গলায় ‘ছুরি ধরার’ অভিযোগ আনা হয়েছে সাবেক স্বামীর বিরুদ্ধে।
ডায়েরির সঙ্গে মিলিয়ে পুলিশ বলেছে, আকতার জাহানের হাতের লেখার সঙ্গে মিলে গেছে তা।
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান সহযোগী অধ্যাপক মশিহুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, শুক্রবার বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে জুবেরী ভবনে আকতার জাহানের কক্ষের দরজা ভেঙে ভেতরে তার লাশ পাওয়া যায়।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক জানান, অনেক আগেই তার মৃত্যু হয়েছে।
সহযোগী অধ্যাপক দুলাল চন্দ্র বিশ্বাস জানান, আকতার জাহানকে তার ঘরে মশারির ভেতরে শোয়া অবস্থায় পাওয়া যায়। তার মুখে ফেনা ও রক্ত বেরিয়ে আসার মতো কালো দাগ ছিল।
তবে ময়নাতদন্ত না করে মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয় বলে রাজশাহী মেডিকেলের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক মহিনুল ইসলাম জানিয়েছেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “তাকে আমাদের কাছে আনা হয়েছে মৃত অবস্থায়। হাত-পা শক্ত হয়ে গিয়েছিল। দেখে মনে হয়েছে, দুই-একদিন আগেই তার মৃত্যু হয়ে থাকতে পারে।”
জীবন কাটছিল ‘জটিলতায়’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করে ১৯৯৭ সালে শিক্ষক হিসেবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন আকতার জাহান। চাকরিতে যোগ দেওয়ার আগেই তার বিয়ে হয় তানভীর আহমেদের সঙ্গে, যিনি বর্তমানে একই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক।
সহকর্মীরা জানান, তানভীরের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হলে ২০১২ সালে জুবেরী ভবনের ৩০৩ নম্বর কক্ষে ওঠেন আকতার জাহান। স্কুলপড়ুয়া ছেলে তখন বাবার সঙ্গে থাকলেও মাঝেমাঝে মায়ের কাছে আসত।
এরমধ্যে গত বছরের শেষ দিকে তানভীর আবার বিয়ে করেন। এরপর চলতি বছরের শুরুতে ছেলেকে ঢাকায় তার নানার বাড়িতে পাঠিয়ে দেন আকতার জাহান।
গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ঈদের ছুটি শুরু হয়ে যাওয়ায় সহকর্মীদের ধারণা ছিল আকতার জাহান ঢাকায় তার বাবার বাড়িতে গেছেন। কিন্তু তার ছেলে শুক্রবার কয়েকজন শিক্ষককে ফোন করে জানায়, বুধবার সন্ধ্যার পর থেকে সে তার মাকে ফোনে পাচ্ছে না। এরপর শিক্ষকরাও ফোন করে না পেয়ে বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে জানায়।
সহযোগী অধ্যাপক মশিহুর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জুবেরী ভবনে গিয়ে ঘরের দরজায় নক করে সাড়া পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আর পুলিশ এলে দরজা ভেঙে তাকে ওই কক্ষ থেকে অচেতন অবস্থায় বের করা হয়।”
সহযোগী অধ্যাপক আ. আল মামুন বলেন, “জলি আপা শান্ত অবস্থায় এক হাত অন্য হাতের উপর দিয়ে শুয়ে ছিলেন। সব কিছু সাজানো গোছানো, পাশে একটা গোছানো ব্যাগও ছিল।”
তিনি জানান, মাঝেমধ্যেই প্রচণ্ড ‘ব্যাক পেইনে’ ভুগতেন আকতার জাহান। তাছাড়া ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি।
লাশ উদ্ধারের পর শিক্ষকদের উপস্থিতিতে ওই ঘরে তল্লাশি চালানোর সময় টেবিলে ল্যাপপটের নিচে চাপা দেওয়া একটি চিরকুট পায় পুলিশ।
সেখানে লেখা হয়েছে, “আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। শারীরিক, মানসিক চাপের কারণে আত্মহত্যা করলাম।”
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কাজী মামুন হায়দার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, চিঠিতে সই না থাকলেও হাতের লেখা আকতার জাহানের বলেই তাদের মনে হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী মহানগর পুলিশের কমিশনার শফিকুল ইসলাম বলেন, “যে সুইসাইড নোট আমরা পেয়েছি, সেটা উনার ডায়েরির সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হয়েছে। হাতের লেখা একই মনে হয়েছে।”
সাবেক একজন সহপাঠী জানান, আকতার জাহানের বাবা একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা। তিনি ঢাকায় থাকেন। গত কয়েক মাস ধরে ঢাকায় থেকেই একটি ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে পড়ছে এই শিক্ষকের ছেলে।
চিরকুটে লেখা হয়েছে, “সোয়াদকে যেন ওর বাবা কোনোভাবেই নিজের হেফাজতে নিতে না পারে। যে বাবা সন্তানের গলায় ছুরি ধরতে পারে, সে যে কোনো সময় সন্তানকে মেরেও ফেলতে পারে বা মরতে বাধ্য করতে পারে।”
মৃতদেহ ঢাকায় না পাঠিয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দিতেও অনুরোধ করা হয়েছে ওই চিরকুটে।
তানভীর যা বললেন
কথিত সেই চিরকুটের বিষয়ে তানভীর আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সোয়াদ তো অনেকদিন আমার কাছেই ছিল। কিছুদিন আগে সে নানুর বাড়িতে বেড়াতে যায়। ওর মা চাচ্ছিল ঢাকাতেই ও লেখাপড়া করুক। একজন মানুষ মরে যাওয়ার আগে কেন এরকম নোট লিখে গেল তা আমার বোধগম্য নয়।”
রাজশাহীর পুলিশ কমিশনার শফিকুল ইসলাম বলেন, “পরিবার বা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমাদের কাছে কোনো অভিযোগ করেনি। অভিযোগ পেলে সে অনুযায়ী আমরা ব্যবস্থা নেব।”
আকতার জাহানের মৃতদেহ রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হিমঘরে রাখা হয়েছে। ঢাকা থেকে পরিবারের সদস্যরা রাজশাহী পৌঁছালে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে বিভাগের শিক্ষকরা জানিয়েছেন।