বিচারকদের সইয়ের পর যুদ্ধাপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত আমির মতিউর রহমান নিজামীর রিভিউ আবেদন খারিজের রায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল হয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানোর পর পড়ে শোনানো হয়েছে তাকে।
Published : 09 May 2016, 03:49 PM
এখন কারা কর্তৃপক্ষ ফাঁসির আসামি নিজামীর কাছে জানতে চাইবে- তিনি কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনার কথা জানিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইবেন কি না।
আদালতের সব বিচারিক প্রক্রিয়ার নিষ্পত্তি হয়ে যাওয়ায় একাত্তরের বদরপ্রধান নিজামীর সামনে এখন কেবল ক্ষমা প্রার্থনার সুযোগই বাকি।
তিনি ক্ষমা না চাইলে কিংবা তার ক্ষমার আবেদন রাষ্ট্রপতি প্রত্যাখ্যান করলে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের প্রক্রিয়া শুরু করবে কারা কর্তৃপক্ষ।
দণ্ড কার্যকরের জন্য কারা কর্তৃপক্ষ প্রস্তুত জানিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছেন, সব বিধি মেনেই এই যুদ্ধাপরাধীর দণ্ড কার্যকর করা হবে।
বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের দেওয়া রিভিউ খারিজের রায়ে বিচারকদের স্বাক্ষরের পর সোমবার বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে তা প্রকাশ করে সুপ্রিম কোর্ট। ২২ পৃষ্ঠার ওই রায় সুপ্রিম কোর্টের ওয়েব সাইটেও প্রকাশ করা হয়।
আপিল বিভাগের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার অরুনাভ চক্রবর্তী এরপর তা পৌঁছে দেন এ মামলার বিচারিক আদালত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে।
অরুনাভ চক্রবর্তী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, রায়ের তিনটি অনুলিপি দেওয়া হয়েছে ট্রাইব্যুনালে। সেগুলো ট্রাইব্যুনাল, কারা কর্তৃপক্ষ ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের জন্য। পাশাপাশি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও দুই পক্ষের আইনজীবীকেও অনুলিপি পাঠানো হয়েছে।
পরে পৌনে ৭টার দিকে ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার শহীদুল আলম ঝিনুক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রিভিউ আবেদন খারিজ হওয়ার আলোকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে আদেশ দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল। এতে সই হওয়ার পর ওই আদেশ ও রায়ের কপি কারা কতৃপক্ষ, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।”
সন্ধ্যা ৭টায় ট্রাইব্যুনালের ডেপুটি রেজিস্ট্রার কেশব রায় চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দলকে পূর্ণাঙ্গ রায় নিয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকতে দেখা যায়। ৭টা ৫ মিনিটে জ্যেষ্ঠ কারাধ্যক্ষ জাহাঙ্গীর কবির পূর্ণাঙ্গ রায়ের অনুলিপি গ্রহণ করেন।
রাত সাড়ে ৮টার সময় পূর্ণাঙ্গ রায় কারাবন্দি নিজামীকে পড়ে শোনানো হয় বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে নিশ্চিত করেন কারা কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর কবির।
নিজামীর পরিবারের কাউকে দেখা করতে ডাকা হয়েছে কি না- জানতে চাইলে তার উত্তর আসে, “না।”
গত ৫ মে প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের আপিল বেঞ্চ নিজামীর আবেদন খারিজ করে দেয়।
আপিল বিভাগের একই বেঞ্চ গত ৬ জানুয়ারি নিজামীর আপিলের রায় ঘোষণা করে। ২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দেওয়া প্রাণদণ্ডের সাজাই তাতে বহাল থাকে।
# রিভিউ রায় লিখেছেন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা।
# এর সঙ্গে সহমত পোষণ করেছেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী।
# আপিলের রায়ে ২, ৬ ও ১৬ নম্বর অভিযোগে হত্যা, ধর্ষণ ও বুদ্ধিজীবী গণহত্যার দায়ে নিজামীর ফাঁসির রায় বহাল থাকে। রিভিউ খারিজ হওয়ায় সেই দণ্ডই এখন তার প্রাপ্য।
# ১, ৩ ও ৪ নম্বর অভিযোগ থেকে নিজামীকে খালাস দেয় আপিল বিভাগ। আর যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা বহাল রাখা হয় ৭ ও ৮ নম্বর অভিযোগে। রিভিউ আবেদনে এই দুটি অভিযোগের বিষয়ে কোনো যুক্তি দেয়নি আসামিপক্ষ।
# রায়ের শেষ অংশে বলা হয়েছে, ৭ ও ৮ নম্বর অভিযোগে নিজামী দোষী সাব্যস্ত হলেও তার আইনজীবীরা এর বিরুদ্ধে কোনো যুক্তি না দিয়ে কার্যত মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যায় তার সম্পৃক্ততা মেনে নিয়েছে। অথচ আসামিপক্ষ দণ্ড কমানোর কথা বলেছে, যদিও আবেদনকারী সেসব অপরাধে সম্পৃক্ততার দায় এড়াতে পারেন না।
# “আমরা এই আবেদনের কোনো সারবত্তা খুঁজে পাইনি। আবেদনটি খারিজ করা হল,” বলেছে আপিল বিভাগ।
জামায়াত আমির নিজামী একাত্তরে ছিলেন দলটির ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের নাজিমে আলা বা সভাপতি এবং সেই সূত্রে পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতার জন্য গঠিত আল বদর বাহিনীর প্রধান।
তার পরিকল্পনা, নির্দেশনা ও নেতৃত্বেই যে আলবদর বাহিনী বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা বাস্তবায়ন করেছিল- এই মামলার বিচারে তা প্রমাণিত হয়।
সুপ্রিম কোর্ট ১৫ মার্চ আপিলের রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করলে ট্রাইব্যুনাল মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে, পরদিন তা পড়ে শোনানো হয় যুদ্ধাপরাধী নিজামীকে। এরপর তিনি রিভিউ আবেদন করেন।
রিভিউ আবেদন খারিজ হয়ে যাওয়ার পর রোববার রাতে তাকে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে নিয়ে আসা হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে।
প্রশ্ন এখন প্রাণভিক্ষা
দণ্ড কার্যকরের আগে যুদ্ধাপরাধী নিজামীর শেষ আইনি সুযোগ ছিল রিভিউ আবেদন। তা খারিজের মধ্য দিয়ে আইনি লড়াইয়ের পরিসমাপ্তি হয়েছে। এখন সংবিধানের ৪৯ অনু্চ্ছেদ অনুসারে শেষ সুযোগে দণ্ডাদেশ পাওয়া আসামি প্রাণভিক্ষা চাইতে পারেন।
আসামি তা না চাইলে বা রাষ্ট্রপতির ক্ষমা না পেলে সরকার দিনক্ষণ ঠিক করে কারা কর্তৃপক্ষকে ফাঁসি কার্যকরের নির্দেশ দেবে। তার আগে স্বজনেরা কারাগারে গিয়ে তার সঙ্গে সাক্ষাত করতে পারবেন।
রিভিউ খারিজের পর এরই মধ্যে স্ত্রী, ছেলে-মেয়েরা কাশিমপুরে গিয়ে নিজামীর সঙ্গে একবার সাক্ষাৎ করেছেন। তবে সে সময় তারা ক্ষমা ভিক্ষার বিষয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কোনো কথা বলেননি।
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এর আগে জানিয়েছেন, রিভিউয়ের রায় কারা কর্তৃপক্ষের কাছে যাবে। দিন তারিখ ঠিক করবে সরকার এবং দণ্ড কার্যকর করবে কারা কর্তৃপক্ষ।
“তবে এর আগে নিজামী যদি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা করতে চান সে সুযোগ তিনি পাবেন। তাকে সেটি জানানো হবে।”
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত প্রথম ব্যক্তি হিসেবে ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর ফাঁসিতে ঝোলানো হয় জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লাকে।
আর ২০১৫ সালের ১১ এপ্রিল জামায়াতের আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে কারা কর্তৃপক্ষ।
তাদের দুজনের রিভিউ আবেদন একদিনের মধ্যে শুনানি শেষে খারিজ হয়ে গিয়েছিল। তারা রাষ্ট্রপতির ক্ষমা চাননি বলে সরকারের পক্ষ থেকে সে সময় জানানো হয়, পরে তাদের ফাঁসিতে ঝোলানো হয়।
এরপর জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও বিএনপির সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় একই দিনে, গতবছর ২১ নভেম্বর। তারা প্রাণভিক্ষার আবেদন করলেও রাষ্ট্রপতি তা নাকচ করে দেন বলে সে সময় সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়।
এর বাইরে যুদ্ধাপরাধ মামলার আসামিদের মধ্যে কেবল জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রায় এসেছে আপিল বিভাগে। ট্রাইব্যুনালে তাকে দেওয়া সর্বোচ্চ সাজার রায় কমিয়ে আপিল বিভাগ আমৃত্যু কারাদণ্ডের যে রায় দিয়েছে, তার রিভিউ চেয়েছে দুই পক্ষই।